আইভীর ভরসা ব্যক্তিত্বে, সাখাওয়াতের দল

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বাকি আর মাত্র তিন দিন। মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় সরগরম নগরী। বিরামহীন প্রচারণা চলছে প্রার্থীদের। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকাজুড়ে নির্বাচনী প্রচারণার আলোচনার কেন্দ্রে দুই প্রধান দলের মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও সাখাওয়াত হোসেন। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেও মেয়র পদে ভোট প্রার্থনায় সেলিনা হায়াৎ আইভীর ভরসা দলীয় পরিচয়ের চেয়ে ব্যক্তিগত ইমেজ। আর নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানের ভরসা দলীয় পরিচয়।
সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট গ্রহণের ব্যাপারে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের শঙ্কায় রয়েছেন আইভীর। প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ থাকলেও এদিক থেকে অনেকটাই নির্ভার সাখাওয়াত। তবে সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচন হলে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটযুদ্ধের আশা করছেন নগরবাসী।
আগামী বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠেয় নারায়ণগঞ্জ সিটির দ্বিতীয় নির্বাচনে এবারের মেয়র প্রার্থী সাতজন। তাদের মধ্যে মূল প্রতিযোগিতা হবে আইভী ও সাখাওয়াতের মধ্যে।
গত নির্বাচনে নিজ দল আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেয়ে সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের ব্যানারে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন আইভী। এবার দলের মনোনয়নে প্রার্থী হলেও তা তার জন্য আশীর্বাদ না হয়ে বরং চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত নির্বাচনে আইভীর কাছে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত প্রার্থী সাংসদ শামীম ওসমানকে ডেকে আইভীর পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দিলেও তা তেমন কাজে আসেনি। যদিও আইভীর পক্ষে নামার জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন শামীম, কিন্তু মাঠে কোনো সক্রিয় ভূমিকা নেই তার। ব্যক্তি ইমেজের কারণে আইভীর বড় একটি ভোট ব্যাংক থাকলেও দলীয় কর্মী বাহিনী বড় শামীমের। মহানগর থেকে শুরু করে কর্মীপর্যায়ে শামীম সমর্থকদের আইভীর পক্ষে প্রচারণা নেই।
আবার গত নির্বাচনে স্থানীয় সুশীল সমাজসহ শামীমবিরোধী আওয়ামী লীগের একটি অংশ আইভীর পক্ষে প্রচারণায় বেশ সক্রিয় ছিলেন। এবার দলীয় পরিচয়ে নির্বাচনের ঘোষণায় এ অংশটিকে পাশে পাচ্ছেন না আইভী। তবে দিনরাত ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে আইভী দলীয় পরিচয় নয়, ব্যক্তিত্ব বিবেচনায় সাধারণ ভোটারদের ভোট প্রার্থনা করছেন। নিজের ভোট ব্যাংক অটুট রাখার পাশাপাশি সাধারণ ভোটার ও বিরোধী শিবিরের ভোট সংগ্রহে দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি।
আবার দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিতে কেন্দ্রে পাঠানো স্থানীয় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আনোয়ার হোসেনকেও দেখা যাচ্ছে না তেমন। তাকে মেয়র পদে মনোনয়ন না দিলেও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করে আইভির পক্ষে নামার নির্দেশনা দেয় দলীয় হাইকমান্ড। এর পরও তিনি নির্বাচনী মাঠে নিষ্ক্রয়।
এদিকে বড় ভোট ব্যাংক থাকলেও তাদের গোছানো ও মাঠে নির্বাচনীকাজে লাগানোর মতো নেতার অভাবে ফল নেতিবাচকও হতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয় রাজনীতি বিশ্লেষকরা। উদ্যোগের অভাবে আওয়ামী সমর্থকদের সঙ্গে সাধারণ ভোটারদের নিয়ে আইভীর পক্ষে বড় প্লাটফর্ম গড়ার সুযোগটি হাতছাড়া হচ্ছে আওয়ামী লীগের। একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক হায়দার আকবর ঢাকাটাইমসকে জানান, ব্যক্তিগত বিরোধ থাকলেও দলীয় পরিচয় আইভীকে শামীম ওসমানের সঙ্গে এক করে দিয়েছে। আওয়ামী সমর্থকরা এতে উজ্জীবিত হলেও সাধারণ ভোটাররা বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন না। শামীম ওসমানের বিতর্কিত কর্মকা- তাদের মনে শঙ্কা তৈরি করেছে।
এমন অবস্থায় ব্যক্তিগত ইমেজের ওপরই জোর দিচ্ছেন আইভী। সাধারণ ভোটারদের কাছেও তার প্রচারণা ব্যক্তি আইভীকে বিবেচনার।
সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের সিদ্ধিরগঞ্জ ও কদমরসুল অঞ্চলে গত ৪০ বছরে যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ হয়নি, আমি পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনকালে সেই কাজ হয়েছে। তবে এখনো অনেক কাজ রয়েছে। অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্যই পুনরায় আমাকে দরকার।’ আওয়ামী সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ ভোটাররাও ভোট দিয়ে তাকে নির্বাচিত করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এদিকে নির্বাচনকে নিজের ক্যারিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট হিসেবেই দেখছেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন। নগরীর সাত খুন মামলা রাজনীতির মাঠে সাখাওয়াতকে সামনে ঠেলে দেয়। এ ঘটনায় হত্যার শিকার পরিবারের পক্ষে বিনা পয়সায় আইনি লড়াই, জেলা আইনজীবী সমিতির নেতা হিসেবে খুনিদের পক্ষে লড়াই না করার ঘোষণা ও র্যাবের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিটের ঘটনায় নেতৃত্ব প্রদান সাখাওয়াতের ব্যক্তিগত ইমেজ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। সঙ্গে রয়েছে বিএনপির দলীয় সমর্থন।
জেলা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে না থাকলেও মেয়র পদে প্রার্থিতা সাখাওয়াতকে রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। এটিকে জেলা বিএনপির বড় নেতারা ইতিবাচকভাবে দেখছেন না। ভবিষ্যতে নিজেদের পদ হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে তাদের মনে। তবে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য না থাকায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা সাখাওয়াতের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে পলাতক ও আত্মগোপনে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীরাও এখন সক্রিয় নির্বাচনী মাঠে। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ঘোষণা থাকায় মামলা সত্ত্বেও এসব নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ সুযোগে তারা দাপটে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছেন। আবার সঙ্গে রয়েছে দলীয় শীর্ষ নেতাদের প্রচারণা। কথা রয়েছে বিএনপি দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রচারণায় অংশ নেয়ার। খালেদা জিয়া যদি সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর আর রূপগঞ্জে পথসভা করেন, তবে সাধারণ ভোটারদের ভোট বিবেচনা পুরো সাখাওয়াতের পক্ষে চলে যাবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
এ ছাড়া আওয়ামী সরকারের সময় গুম ও নির্যাতনের শিকার পরিবারের সদস্যদের ক্ষোভ রয়েছে। আইভীকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করলেও দলীয় পরিচয় এসব পরিবারের ভোটকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। আবার সাখাওয়াতের ভোটব্যাংকে যোগ হবে জামায়াতসহ ২০-দলীয় জোটের সমর্থকদের ভোট। অথচ ব্যক্তিগতভাবে এসব পরিবারের অনেক ভোটারই আইভীকে পছন্দ করেন।
সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, ‘নির্বাচিত হলে আধুনিক ও ডিজিটাল নগরী গড়ে তুলব। অন্যায়, নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে অতীতের মতো লড়াই করে যাব। নারায়ণগঞ্জে চাঁদামুক্ত একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করব।’ দলীয় পরিচয় নয়, দলমত-নির্বিশেষে সব শ্রেণির ভোটার তাকে ভোট দিবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
উদ্বেগ তৃতীয় পক্ষ নিয়ে
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের প্রচারণার এমন অবস্থায় ভোটের দিন তৃতীয় পক্ষ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে এ অংশটি এখনো সক্রিয়। এমন শঙ্কার কথা প্রকাশ পেয়েছে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর কথাতেও। একটি জাতীয় দৈনিকের গোলটেবিল বৈঠকে আইভী বলেন, ‘আমি কখনোই দুর্নীতি, অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা করে ভোট নিজের পক্ষে নিতে চাই না। প্রার্থী হিসেবে সাখাওয়াত হোসেনও ক্লিন ইমেজের। তবে আমাদের ইতিবাচক ব্যক্তিত্বের সুযোগ নিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষ যেন সুযোগ নিতে না পারে, সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সজাগ থাকতে হবে। তবে প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রয়েছে সাখাওয়াতের। তিনি বলেন, ‘সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে আচরণবিধি লঙ্ঘন করা হলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আবার প্রশাসনের চাপে অনেক নেতাকর্মী তার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারছে না।’
সতর্ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের সুষ্ঠু পরিবেশে ভোটগ্রহণের ঘোষণার নির্দেশের পর সতর্ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। নির্বাচনে সব প্রার্থীর সমান সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছেন তারা। পুলিশের গ্রেপ্তারি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত বিএনপিদলীয় অনেক নেতাকর্মী প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য উদ্বেগজনক কিছু হলে আবার কঠোর হওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা।
ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার হেলালুদ্দিন বলেন, নির্বাচনী আচরণবিধি ও আইনশৃঙ্খলা পর্যবেক্ষণে ২৭টি ওয়ার্ডে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছে। এগুলো কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সতর্ক রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার নুরুজ্জামান তালুকদার বলেন, নির্বাচনী পরিবেশে প্রভাব বিস্তার ব্যাপারে এখনো বড় ধরনের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। ছোটখাটো কিছু অভিযোগ পাওয়ার পর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/১৭ডিসেম্বর/মোআ)

মন্তব্য করুন