সীমান্ত হাট: দুই দেশের মানুষের হৃদয়েরও সেতু

প্রদীপ চক্রবর্তী, আগরতলা থেকে
  প্রকাশিত : ১০ মার্চ ২০১৭, ০৮:৪৬
অ- অ+

ত্রিপুরা ও বাংলাদেশ সীমান্তের দুটি সীমান্ত হাটই দুই সীমান্ত পাড়ের স্বজনদের দীর্ঘকাল বাদে ফিরে পাওয়া, স্বজনদের সুখ দুঃখের কথা জানা-শোনা, ব্যথা-বেদনা ভাগাভাগি করা, ক্ষণিকের জন্য এক সাথে প্রায় এক পাতে খাওয়া-দাওয়া, বাড়ি-ঘর থেকে আনা পিঠে পুলিসহ অন্যান্য উপহার সম্ভারের বিনিময়, সূর্য অস্তমিত হওয়ার আগে চোখের জলে বারবার পেছন ফিরে তাকাতে তাকাতে নিজ দেশের বাড়ির পথে পা বাড়ানোর এক মিলন কেন্দ্র হয়ে উঠছে।

এ মিলন হৃদয়ের অন্তস্থলের দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোনো একসময়ের একান্নবর্তী পরিবারের লোকজন, যাঁরা প্রতিবেশী দু'দেশে থাকেন। এদেরই মিলনের সুযোগ করে দিয়েছে ফেনীর ছাগলনাইযা ত্রিপুরার শ্রীনগর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা সীমান্ত-বাণিজ্য কেন্দ্র, যার পোশাকি নাম সীমান্ত হাট।

বিএসএফ এবং বিজিবির সতর্ক প্রহরার মাঝেই চলে ব্যবসা বাণিজ্য। অনুমতিপত্র নিয়ে হাটে আসা দুই দেশের ব্যবসায়ীরা দুই দিকে পসরা নিয়ে বসেন। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা নিয়ে আসছেন হরলিক্স, প্যাকেটজাত দুধ, বিস্কুট, প্রসাধন সামগ্রী, টফি, পোষাক, আতর, সুগন্ধী, মশলা, ঘি, চকলেটসহ নানা সম্ভার। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সাজিয়ে বসেন বিস্কুট, চানাচুর, পোশাক, প্লাস্টিক সামগ্রী এবং লোহার সম্ভার যেমন দা, কুড়াল, খুন্তি, হাতা, করাই। বাংলাদেশের সেরা আকর্ষণ ভোজনবিলাসী বাঙালির সেরা মৎস্য। নানা জাতের মাছের টানে সীমান্ত হাটে ছুটে যান এপারের লোকজন। রুপোলি ইলিশ ভারতীয় লোকজনের চোখ জুড়িয়ে দেয়, রসনা নিবৃত্তি করাই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। দাম তেমন নয়। অনেকেই নিয়ে আসেন পদ্মা, তিতাসের ইলিশ। শুধু ইলিশ কেন কৈ, মাগুর, সিঙ বিকোচ্ছে দেদার।

তবে বেশি কেনা যায় না, পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। শহর আগরতলার লোকজন যেমন ছুটেন সীমান্ত হাটে তেমনি দূর-দূরান্তের লোকজনের কমতি নেই হাটে। কেননা পূর্বেকার পূর্ববঙ্গে বসবাসকারী বাঙালি, যেখানে যাঁদের পিতৃপুরুষের ভিটে ছিল বা এখনো আছে জীবনানন্দের রূপসী বাংলাদেশে, যাদের পাসপোর্ট নেই তারা ভিড় জমান দুই হাটে। মোবাইলে যোগাযোগ করেই এরা আসেন এখানে। পরিচয়পত্র থাকলেই চলে। সীমান্ত রক্ষীরা পাস দিয়ে থাকেন। দুই দেশের ক্ষেত্রে একই নিয়ম।

সকাল ১০টা থেকে শুরু হওয়া হাট বিকাল সাড়ে চারটে পর্যন্ত চলে। আমবাসা থেকে কসবা হাটে আসা তরুণ দাস বলছিলেন, বাড়িঘর ছিল আশুগঞ্জে। এখনো কাকারা আছেন। সবাই এসেছেন। দেখা হলো, এক সাথে খাওয়া দাওয়া হলো। কত কিছু দিয়েছেন। আমরা গরিব। পাসপোর্ট নেই, যেতে পারি না। তাই হাটই আমাদের ভরসা।

শ্রীমঙ্গলের বসিত আলী। বয়স ৬৫ এর কাছাকাছি। আসামের করিমগঞ্জে ছিলেন। আসাম ছেড়ে তিনি শ্রীমঙ্গল চলে যান। ভাইপোরা এসেছেন, দেখা হলো, হলো কথা, খাওয়া এক সাথে। দুই ভাইপো বলল, দেখিনি কখনো। আজ দেখলাম। বললেন, এত ভালো লাগল, এ রিউনিয়ন। এবার পাসপোর্ট করবেন এরা।

দোকানিরা বললেন অভিজ্ঞতা। মধুপুরের বিজিত মালাকার, স্টেশনারি দোকানি। বললেন আমরা প্রতি হাটেই দেখি হাসি-কান্না। সেকি কান্না, বলা যায় না। ভাবি কেন দেশ ভাগ হলো? সীমান্ত হাটে গেলে এই প্রশ্নটা হৃদয় তোলপাড় করে তুলে।

সীমান্ত হাট ২০১৫ থেকে চালু হয়েছে। ২০১০ এর সম্পাদিত স্মারক চুক্তি অনুযায়ী এই সীমান্ত হাট হয়েছে। ত্রিপুরার সীমান্ত সন্নিহিত এলাকার দাবি এ ধরনের আরও কিছু সীমান্ত হাট স্থাপনের। এই দুই সীমান্ত হাটের ব্যবসা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ত্রিপুরা-বাংলাদেশ সীমান্তে এ ধরনের দুটি সীমান্ত হাট রয়েছে। আরও চারটি হাট শিগগির হবে।

খবর হলো চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৮.৬৩ কোটি টাকা মূল্যের ভারতীয় পণ্য বিক্রি হয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ বাণিজ্য করেছে ৮৭ লাখ টাকার।

বাণিজ্য মন্ত্রকের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন রাজ্যে আরও চারটি সীমান্ত হাট হচ্ছে। এগুলো হবে একিনপুর, বামুটিয়া, বক্সনগর, হাওড়া। এগুলো হলে সীমান্ত হাটের সংখ্যা দাঁড়াবে ৬। কিন্তু আরও চারটি হাট হলেও খোয়াই সীমান্তে কোনো হাট হবে বলে খবর নেই। অথচ খোয়াই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খোয়াই এর পহরমুরা, হাতকাটা, বাচাইবারী, আশারামবারীতে হাট হতে পারে। ওপারে রয়েছে মাধবপুর, শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, চুনারুঘাট, বাল্লা, তদুপরি সিলেট। জনতার দাবি যত পারা যায়, বেশি করে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে দুই দেশের বাজার স্থাপন করা হোক। বাণিজ্য তো হবেই, দুই দেশের মানুষের হৃদয়ের বন্ধন আরও শক্ত হবে এতে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে ভারত সফরকালে ইস্যুকৃত জয়েন্ট কমিউনিকের ৩৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত জনগণের সুবিধার জন্য পাইলট ভিত্তিতে সীমান্ত হাট স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। একই বছরের ২৩ অক্টোবর দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত হাট সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক সই হয়। ওই চুক্তিতে পাইলটভিত্তিতে দুটি সীমান্ত হাট স্থাপনের কথা থাকলেও এরপর দুই দেশের সরকারের সম্মতিতে এ পর্যন্ত চারটি বর্ডার হাট স্থাপন হয়েছে। কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলা সদর থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার দূরে ভারতের কালাইরচর সীমান্তের বিপরীতে বাংলাদেশের বালিয়ামারী সীমান্তে প্রথম সীমান্ত হাট উদ্বোধন করা হয়।

(ঢাকাটাইমস/১০মার্চ/প্রতিনিধি/এসএএফ/জেবি)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
সিরাজগঞ্জে গৃহকর্মীকে ধর্ষণের অভিযোগে বাবা-ছেলে গ্রেপ্তার
মেস থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
খিলগাঁওয়ে নির্মাণাধীন ভবনে আগুন
কারামুক্ত হলেন মডেল মেঘনা আলম
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা