পুরান ঢাকার বুদ্ধদেব সুর : একাত্তরের প্রথম শহীদ শিশু

মাহবুব রেজা
  প্রকাশিত : ২৭ মার্চ ২০১৭, ১৪:১১
অ- অ+

ওপরে দেবদূতের মতো যে শিশুটির ছবি আপনারা দেখছেন তার নাম বুদ্ধদেব সুর। ডাক নাম বুদ্ধু। বয়স আনুমানিক তিন- সাড়ে তিন বছর। বাবা প্রাণ গোপাল সুর। মা ভগবতী সুর। ঠিকানা ৩৬ নম্বর শাঁখারীবাজার। ছবির এই শিশুটি আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম স্বীকৃত শহীদ শিশু।

ইতিহাসের পাতায় বুদ্ধদেব সুর ওরফে বুদ্ধুর নামটি অমর, অজেয় হয়ে থাকবে। কি ঘটেছিল সেদিন শাঁখারীবাজারে? কিভাবে, কেমন করে শহীদ হলেন এই শিশু?

২৫ মার্চ রাতে ঘটনার পূর্বাপর আঁচ পেয়ে পাকিস্তানি জন্তুরূপী সেনারা অসহায় বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। প্রথমেই তারা টার্গেট করে সাধারণ মানুষ। ঢাকায় থাকা সাধারণ মানুষের ওপর হায়েনার মতো হামলে পড়ে তারা। কেন হায়েনারা ঢাকার সাধারণ মানুষের ওপর ইতিহাসের জঘন্যতম এই পৈশাচিক, বর্বর হত্যাকা- চালিয়েছিল?

তারা চেয়েছিল ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে ঢাকাসহ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম হত্যাকা- চালালে তার নেতিবাচক প্রভাব অন্যদের মধ্যে পড়বে এবং এতে করে তারা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ভীত হবে। কিন্তু তাদের চিন্তা-ভাবনা যে মোটেও সঠিক ছিল না তা ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়।

২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া হত্যাকা- নির্বিচারেই চলতে থাকে ঢাকায়। ঢাকার বিভিন্ন অংশে এই হত্যাকা- চললেও বিশেষ করে পুরান ঢাকায় এর মাত্রা ছিল অনেক বেশি। পাকিস্তানি সেনাদের কাছে রাজাকার, আলবদররা তথ্য দিয়েছিল যে, পুরান ঢাকায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের বসবাস ছিল অনেক বেশি। সুতরাং এখানকার হিন্দুদের আগে মেরে ফেলতে হবে।

পাকিস্তানি সেনারা সেই মেরে ফেলার কাজটি বেশ ভালো মতোই করেছিল পুরান ঢাকায়। তারা স্মরণকালের জঘন্য হত্যাকা- চালায় পুরান ঢাকায়। মেজর জেনারেল (অব.) আমিন আহমেদ চৌধুরী বীরপ্রতীক এ প্রসঙ্গে জানান, ২৬ মার্চ সবচেয়ে বেশি কিলিং হয়েছে জগন্নাথ হল, রাজারবাগ, সুইপার কলোনি, ফার্মগেট ও শাঁখারীবাজারে। শাঁখারীবাজার ছাড়া অন্য জায়গায় হত্যার পর সব লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিল।

জানা যায়, পাকিস্তানি সেনারা ২৫ মার্চ পুরান ঢাকা বিশেষ করে শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুরসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে ভয়াবহ নারকীয় হত্যাকা- চালায়। মূলত ২৬ মার্চ ছিল পুরান ঢাকাবাসীর জন্য আতংকের। উৎকণ্ঠার। এদিন তাদের ওপর নেমে আসে মৃত্যুর হিমশীতল দিন।

দুই.

মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ও সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে জানা যায়, পাকিস্তানি সেনারা ১৯৭১ সালের মার্চের ২৬ তারিখ প্রথম প্রহরে অর্থাৎ ২৫ তারিখ রাত ২-৩টার দিকে শাঁখারীবাজারের পশ্চিম মাথার কোতোয়ালি থানা অ্যামবুশ করে এবং বাঙালি পুলিশ সদস্যদের হত্যা করে। পুরান ঢাকার এই এলাকায় ভোর পর্যন্ত চলে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড।

শুধু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তারা ক্ষান্ত হয়নি, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নিরীহ মানুষজনের বাড়িঘর। আতংক এমন পর্যায়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল যে, মানুষ দিশেহারা হয়ে যে যেভাবে পেরেছে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদে আশ্রয় নিতে নদী পার হয়ে চলে যায় কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরায়। পাকিস্তানি বাহিনী শাঁখারীবাজারের ৫২ নম্বর বাড়িতে প্রথম আগুন দেয় এবং বেশ কয়েকজনকে গুলি করে মেরে ফেলে।

শাঁখারীবাজারের ৬৩ নম্বর দোকানটি চালাতেন প্রাণ গোপাল সুর। দোকানটি বাদ্যযন্ত্রের। দোকানের নাম সুর প্রোডাক্টস। বর্তমানে দোকানটির দেখাশোনা করেন প্রাণ গোপাল সুরের ছেলে বাসুদেব সুর। এই বাসুদেব সুরই স্বাধীনতার প্রথম শহীদ শিশু বুদ্ধদেব সুরের বড় ভাই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে নিজের ছোট ভাইকে পাক সেনারা কিভাবে মেরেছে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে একাত্তরের সেই লোমহর্ষক ঘটনার বিস্তৃত জানান- ‘সেদিন (২৬ মার্চ) ভোর রাতে কোতোয়ালি থানা দখলে নেওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় দুপুরের পর থেকে হত্যাকাণ্ড আর অগ্নিসংযোগ শুরু করে।

বিকেলের দিকে বেশিরভাগ বাড়িতে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। সিমেন্টের বাড়ি হলেও ঘরের দরজা ছিল কাঠের, যার কারণে দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ৫২ নম্বর বাড়িটিতেও ছোবল পড়ে ওদের। গোটা শাঁখারীবাজার এলাকায় আগুন দেওয়া, হত্যা এবং লুটপাটের যেন উৎসব শুরু হয়। পাকিস্তানিরা কাজগুলো করে এই এলাকারই নাম জানা-মুখ চেনা কিছু লোকের মাধ্যমে। একাত্তরে আমার বয়স তখন ছয়-সাত বছর হবে।

২৬ তারিখ সন্ধ্যার একটু আগের কথা। আমি গিয়েছি আমাদের বাড়িতে। বাবা, মা, মেসো মশাই আর আমার ছোট ভাই বুদ্ধু (বুদ্ধদেব সুর) ছিল মেসোর বাড়িতে। তখন বুদ্ধুর বয়স তিন কি সাড়ে তিন বছর। হঠাৎ পাকিস্তানি সৈন্যরা মেসোর বাসার ছাদে উঠে ‘চন্দন কোন হে’ বলে নাম ধরে ডাকতে শুরু করে। সেই সময় বুদ্ধু ছিল আমার মেসো চন্দন সুরের কোলে। ওরা মেসোকে নিচে নামিয়ে আনে। রাস্তায় নেমেই মেসোকে ওরা গুলি করে হত্যা করে। মেসোর কোলে তখনও বুদ্ধু। ওকে রাস্তায় ফেলে নিষ্পাপ শিশুটির বুকে বেয়নেট চালায় পশুরা। মুহূর্তেই এ ফোঁড়-ও ফোঁড় হয়ে যায় বুদ্ধদেব সুর ওরফে বুদ্ধুর বুক।’

সেদিন এই নৃশংস ঘটনা এই অনেকেই খুব কাছ থেকে দেখেছেন। বুদ্ধুর মা ভগবতী সুর ছাদের ওপর থেকে অসহায়ের মতো নিজের ছেলেকে মেরে ফেলতে দেখেছেন। ভগবতী সুর ওপর থেকে নেমে আসতে আসতে তার আদরের ছোট ছেলে বুদ্ধুকে মেরে ফেলেছিল জানোয়ারেরা।

শিশু বুদ্ধদেব সুরের এই ছবি যুদ্ধকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিশ্বের মানুষের টনক নড়ে। এই ছবি দেখে তাদের আর বুঝতে বাকি থাকে না বাংলাদেশে কি জঘন্য হত্যাকা- ঘটে চলেছে। যুদ্ধদিনের এই ছবি বিশ্বের মানুষকে বাংলাদেশের প্রতি মানবিক হতে প্রভাবিত করে।

তিন.

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে অনেক ছবির ভিড়ে শিশু বুদ্ধদেব সুরের এই ছবির দিকে তাকালে মনটা এক অজানা ব্যথায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। খুব ভালো করে তাকালে ছবিতে দৃশ্যমান হয়, পড়ে থাকা একজন বয়স্ক মানুষের দুই পায়ের পাতা। পায়ের ওপরের অংশ লুঙ্গিতে ঢাকা।

মানুষটির উরু পর্যন্ত ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা পড়েছে। ঠিক তার পায়ের পাতা দুটোর পাশে চোখ পড়তে শরীরে এক অদ্ভুত আলোড়ন তৈরি করে এবং তারপরই গা শিউরে ওঠে। ছোট্ট একটা শিশু পড়ে আছে। ঊর্ধ্বমুখী দৃষ্টি।

আরও ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যায় শিশুটির বুকের মাঝখানে এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করা একটা গর্ত। নীরব-নিথর দেহ। শিশু বুদ্ধদেব সুরের এই অসহায়, নিথর, ভাবলেশহীন ছবি দেখলে যে কারোরই বুকের হাড় নড়েচড়ে উঠবে। বুক ভেঙে যাবে।

বাংলাদেশ, এই দেশের শ্যামল বরণ প্রকৃতি আর এর মায়াবতী শরীর বুদ্ধদেব সুরের মতো শিশুকে ভুলে যায়নি। বুদ্ধদেব সুরের মতো নাম না জানা লক্ষ মানুষের দেহকে পরম মমতায় ঠাঁই দিয়েছে এই দেশের মাটি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খোঁজ নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব সুরের। বঙ্গবন্ধু বুদ্ধদেব সুরের বাবা প্রাণ গোপাল সুরের ৩৬ নম্বর শাঁখারীবাজারের ঠিকানায় দুই হাজার টাকার একটি চেক পাঠিয়ে সহমর্মিতা জানিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে একটি চিঠিও লিখেছিলেন বুদ্ধদেবের বাবাকে।

বুদ্ধদেব সুরের বাবা প্রাণ গোপাল সুর মারা গেছেন অনেক আগে। বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা সেই চিঠি বুদ্ধদেবের ভাই বাসুদেব সুর এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছেন।

পুরান ঢাকার ছোট শিশু বুদ্ধদেব সুর একাত্তরের ২৬ মার্চ নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছিল- এই দেশ আমার। এই মাটি আমার। এই নদী আমার। এই আকাশ আমার। এই বাতাস আমার। এই স্বাধীনতা আমার। এই অর্জন আমার।

মাহবুব রেজা : কথাসাহিত্যিক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

ঢাকাটাইমস/২৭মার্চ/এমআর/টিএমএইচ

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
রেললাইনে ভিডিও করতে গিয়ে ফটোগ্রাফারের মর্মান্তিক মৃত্যু
‘সাময়িকভাবে’ ফ্লাইট বন্ধ করলো নভোএয়ার
সিরাজগঞ্জে নেশার টাকা না দেওয়ায় ছেলের মারধরে প্রাণ গেল বাবার, মা আহত
আফতাবনগরে পশুর হাট না বসানোর দাবিতে মানববন্ধন
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা