মানুষের ধর্ম, রবীন্দ্রনাথ ও সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা

হায়াৎ মামুদ
 | প্রকাশিত : ০২ জুলাই ২০১৭, ০৮:২৭

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তার প্রয়াত কন্যা কমলার নামে একটি বাৎসরিক বক্তৃতার আয়োজন করেছিলেন। ১৯৩২ সালের কমলা বক্তৃতা প্রদানের জন্য রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কবি ১৯৩৩ সালের ১৬, ১৮ ও ২০ জানুয়ারি (৩, ৫ ও ৭ মাঘ ১৩৩৯) তারিখে তিনটি রচনা পাঠ করেন। এই ভাষণপত্রের সংকলনই ‘মানুষের ধর্ম’, অর্থাৎ ‘কমলা বক্তৃতা’রই একটি অংশ এগুলো।

‘মানুষের ধর্ম’- এই মাত্র দুটি শব্দের স্বাভাবিক অর্থ : মানুষ যে ধর্ম পালন করছে। অর্থাৎ মুসলমানরা ইসলাম ধর্ম, হিন্দুরা তাদের সনাতন ধর্ম, খ্রিস্টানরা খ্রিস্টধর্ম, বৌদ্ধগণ বুদ্ধধর্ম ইত্যাদি। এক এক ধর্ম সম্প্রদায়ের আচরিত ধর্মের সাধারণ লক্ষণকে বিচারে না এনে ‘মানুষ’ নামক বিশেষ প্রাণীটির দৈহিক ও মনোজাগতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থাকারে প্রকাশের কালে কবি ‘ভূমিকা’স্বরূপ কিছু কথা বলা যোগ করেছিলেন, তার কিয়দংশ উদ্ধৃতিযোগ্য। তিনি বলেছেন:

মানুষের একটা দিক আছে যেখানে বিষয়বুদ্ধি নিয়ে সে আপন সিদ্ধি খোঁজে। সেইখানে আপন ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা নির্বাহে তার জ্ঞান, কর্ম, রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত। সেখানে সে জীবনরূপে বাঁচতে চায়।

কিন্তু মানুষের আর-একটা দিক আছে যা এই ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে যাকে বলি ক্ষতি তাই লাভ, যাকে বলি মৃত্যু সেই অমরতা। সেখানে বর্তমান কালের জন্য বস্তু-সংগ্রহ করার চেয়ে অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে আত্মত্যাগ করার মূল্য বেশি। সেখানে জ্ঞান উপস্থিত-প্রয়োজনের সীমা পেরিয়ে যায়, কর্ম স্বার্থের প্রবর্তনাকে অস্বীকার করে। সেখানে আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড় জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।

স্বার্থ আমাদের যে-সব প্রয়াসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তার মূল প্রেরণা দেখি জীবপ্রকৃতিতে, যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।

কোন মানুষের ধর্ম। এতে কার পাই পরিচয়। এ তো সাধারণ মানুষের ধর্ম নয়, তা হলে এর জন্য সাধনা করতে হতো না।

আমাদের অন্তরে এমন কে আছেন যিনি মানব অথচ যিনি ব্যক্তিগত মানবকে অতিক্রম করে ‘সদা জানানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট।’ তিনি সর্বজনীন সর্বকালীন মানব। তাঁরই আকর্ষণে মানুষের চিন্তায় ভাবে কর্মে সর্বজনীনতার আবির্ভাব। মহাত্মারা সহজে তাঁকে অনুভব করেন সকল মানুষের মধ্যে, তার প্রেমে সহজে জীবন উৎসর্গ করেন। সেই মানুষের উপলব্ধিতেই মানুষ আপন জীবসীমা অতিক্রম করে মানবসীমায় উত্তীর্ণ হয়। সেই মানুষের উপলব্ধি সর্বত্র সমান নয় ও অনেক স্থলে বিকৃত বলেই সব মানুষ আজও মানুষ হয়নি। কিন্তু তার আকর্ষণ নিয়ত মানুষের অন্তর থেকে কাজ করছে বলেই আত্মপ্রকাশের প্রত্যাশায় ও প্রয়াসে মানুষ কোথাও সীমাকে স্বীকার করছে না। সেই মানবকেই মানুষ নানা নামে পূজা করেছে, তাকেই বলেছে ‘এষ দেবো বিশ্বকর্মা মহাত্মা’। সকল মানবের ঐক্যের মধ্যে নিজের বিচ্ছিন্নতাকে পেরিয়ে তাঁকে পাবে আশা করে তার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানিয়েছে-

...সেই মানব, সেই দেবতা, য এক: যিনি এক, ...।

রবীন্দ্রনাথ এ-প্রবন্ধের এক স্থানে বলেছেন: ‘রাজ্যের বা সমাজের উপযোগিতারূপে শ্রেয়ের মূল্যবিচার এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। শ্রেয়কে মানুষ যে স্বীকার করেছে, সেই স্বীকৃতির আশ্রয় কোথায়, সত্য কোথায়, সেটিই আমার আলোচ্য। রাজ্যে সমাজে নানা প্রকার স্বার্থসাধনের ক্ষেত্রে প্রতিদিনের ব্যবহারে তার প্রতিবাদ পদে পদে, তবুও আত্মপরিচয়ে মানুষ তাকে শ্রেষ্ঠ স্থান দিয়েছে, তাকেই বলেছে ধর্ম অর্থাৎ নিজের চরম স্বভাব; শ্রেয়ের আদর্শ সম্বন্ধে দেশকাল পাত্রভেদে যথেষ্ট মতভেদ সত্ত্বেও সেই শ্রেয়ের সত্যকে সকল মানুষই শ্রদ্ধা করছে, এতে মানুষের ধর্মের কোন স্বরূপ প্রমাণিত হয় সেটি আমি বিচার করেছি। ‘হয়’ এবং ‘হওয়া উচিত’ এই দ্বন্দ্ব মানব-ইতিহাসের আরম্ভকাল থেকেই প্রবলভাবে চলছে, তার কারণে বিচার করতে গিয়ে বলেছিÑ মানুষের অন্তরে এক দিকে পরম মানব, আর এক দিকে স্বার্থসীমাবদ্ধ জীবমানব, এই উভয়ের সামঞ্জস্য চেষ্টাই মানব-মনের নানা অবস্থা-অনুসারে নানা আকারে প্রকারে স্বতন্ত্ররূপে অভিব্যক্ত। নইলে কেবল সুবিধা-অসুবিধা প্রিয়-অপ্রিয় প্রবল থাকত জৈবিক ক্ষেত্রে জীবধর্মে, পাপ-পুণ্য কল্যাণ-অকল্যাণের কোনো অর্থই থাকত না।’

দর্শনচিন্তাশ্রয়ী এ রচনা পাঠকের গভীর মনোসংযোগ দাবি করে। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধেরই এক স্থানে তিনি লিখছেন: ‘শত্রুহননের সহজ প্রবৃত্তি মানুষের জীবধর্মে, তাকে উত্তীর্ণ হয়ে মানুষে অদ্ভুত কথা বললে, ‘শত্রুকে ক্ষমা করো।’ এ কথাটা জীবধর্মের হানিকর, কিন্তু মানবধর্মের উৎকর্ষ লক্ষণ।’

ব্যাখ্যা করেছেন তিনি এইভাবে:

আমাদের ধর্মশাস্ত্রে বলে, যুদ্ধকালে যে মানুষ রথে নেই, যে আছে ভূতলে, রথী তাকে মারবে না। যে ক্লীব, যে কৃতাঞ্জলি, যে মুক্তকেশ, যে আসীন, যে সানুনয়ে বলে ‘আমি তোমারই’, তাকেও মারবে না। যে ঘুমাচ্ছে, যে বর্মহীন, যে নগ্ন, যে নিরস্ত্র, যে অযুধ্যমান, যে যুদ্ধ দেখছে মাত্র, যে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত, তাকেও মারবে না। যার অস্ত্র গেছে ভেঙে, যে শোকার্ত, যে পরীক্ষিত, যে ভীত, যে পরাবৃত্ত, সত্যের ধর্ম অনুসরণ করে তাকেও মারবে না।

সত্যের ধর্ম বলতে বোঝায় মানুষের মধ্যে যে সত্য তাঁরই ধর্ম, মানুষের মধ্যে যে মহৎ তাঁরই ধর্ম। যুদ্ধ করতে গিয়ে মানুষ যদি তাঁকে অস্বীকার করে তবে ছোট দিকে তার জিত হলেও বড় দিকে তার হার। উপকরণের দিকে তার সিদ্ধি, অমৃতের দিকে সে বঞ্চিত, সেই অমৃতের আদর্শ মাপজোখের বাইরে।

... আত্মার মহিমার পরিমাণ নেই। শত্রুকে নিধনের পরিমাপ আছে, শত্রুকে ক্ষমার পরিমাপ নেই। ... মানুষের কাছে শুনেছি, ন পাপে প্রতিপাপ: সাৎ- তোমার প্রতি পাপ যে করে তার প্রতি ফিরে পাপ করো না। কথাটাকে ব্যবহারে যুক্তিবিশেষ মানে বা নাই মানে, তবু মন তাকে পাগলের প্রলাপ বলে হেসে ওঠে না।...

আত্মা যার পাপ থেকে বিরত ও কল্যাণে নিবিষ্ট তিনি সমস্তকে বুঝেছেন। তাই তিনি জানেন কোনটা স্বভাবসিদ্ধ, কোনটা স্বভাববিরুদ্ধ।

মানুষ আপনার স্বভাবকে তখনই জানে যখন পাপ থেকে নিবৃত্ত হয়ে কল্যাণের অর্থাৎ সর্বজনের হিতসাধন করে। অর্থাৎ মানুষের স্বভাবকে জানে মানুষের মধ্যে যারা মহাপুরুষ।

রবীন্দ্রনাথের কিঞ্চিতধিক অশীতিবর্ষব্যাপী জীবনের সবটুকু একনজরে দেখলে মানতেই হবে তার জীবন সুখে কাটেনি। তার একান্ত ব্যক্তিগত দুঃখশোক হিসাবের বাইরে রাখলেও বলা চলে ‘দুঃখী মানুষ’ হওয়াই তার ললাটলিপি ছিল। তার ন্যায় শান্তিব্রতী মানুষকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দেখতে হয়েছিল এবং মৃত্যুর (১৯৪১ খ্রি.) কয়েক বছর পরেই আসন্ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।

কিন্তু কবিগুরুর অসামান্য প্রতিভা ছিল ‘ক্ষণিকে’র ভিতরেও ‘শাশ্বত’কে উপলব্ধি করার। সুদীর্ঘ ‘মানুষের ধর্ম’ রচনার শেষ অনুচ্ছেদে বলছেন: ‘মানব নাট্যমঞ্চের মাঝখানে যে লীলা তার অংশের অংশ আমি। সব জড়িয়ে দেখলুম সকলকে। এই- যে দেখা একে ছোট বলব না। এও সত্য। জীবনদেবতার সঙ্গে জীবনকে পৃথক করে দেখলেই দুঃখ, মিলিয়ে দেখলেই মুক্তি।’

হায়াৎ মামুদ: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :