অস্ট্রেলিয়া শুধু খেলায় হারেনি , হেরেছে রাজনীতিতেও

শেখ আদনান ফাহাদ
| আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০১৭, ২২:২৩ | প্রকাশিত : ৩০ আগস্ট ২০১৭, ২১:৩৭

অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এ জয় শুধু নিছক একটা খেলোয়াড়ি জয় নয়। এ জয় একটা উন্নাসিক, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে একটি উন্নয়নকামী, শান্তিপ্রিয় ও প্রগতিশীল জাতির বিজয়। ভাবছেন ক্রিকেটকে পুঁজি করে একটু রাজনীতি করে নিচ্ছি? মোটেও না। সাকিব-তামিমরা শুধু মাঠের খেলায় আপনাকে বিজয়ী করেনি, আপনাকে বিশ্ব রাজনীতির মাঠেও বিজয়ী করেছে। এই বিজয় শুধু ক্রিকেটের নয়, এ বিজয় বিশ্ব রাজনীতিতে পশ্চিমাদের আধিপত্যবাদী নাকউঁচু আচরণের প্রতিও এক কঠিন জবাব।

বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছিল ২০০০ সালে। এখন ২০১৭ সাল। এই ১৭ বছরে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশে টেস্ট খেলেছে মোটে পাঁচটা! এর মধ্যে ১১ বছর কোনো টেস্ট ম্যাচ খেলতে বাংলাদেশে আসেনি অজিরা! সর্বশেষ ২০০৬ সালে বাংলাদেশে টেস্ট খেলতে এসেছিল ন্যাটো জোটভুক্ত অস্ট্রেলিয়া। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগী অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশে খেলতে আসার আগে সবসময় একটা অপমানজনক পরিস্থিতি তৈরি করে। এমন উন্নাসিক আচরণ করে যেন, বাংলাদেশ যেন পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান। অথচ বাংলাদেশ তা নয়। কয়েকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারত থেকেও অনেক এগিয়ে আছে।

বাংলাদেশ অনেক রাজনৈতিক সমস্যা থাকলেও পরিষ্কারভাবে উন্নতি ও প্রগতির দিকে ধাবমান একটি রাষ্ট্র। এটি কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশ কোনো ব্যর্থ রাষ্ট্র নয়। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে এদেশে যে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছিল, ৯০-পরবর্তী সময়ে অনেকখানি কাটিয়ে উঠেছি আমরা। বিশেষ করে গত আট বছরে বাংলাদেশ নানা বিতর্ক থাকার পরেও রাষ্ট্র হিসেবে অনেক এগিয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইশারায় পদ্মা সেতু ইস্যুতে রাষ্ট্রকে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে বিব্রত করা বিশ্বব্যাংক পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে স্বীকৃতি দিয়ে একাধিক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ছিল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের হার বিবেচনায় বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি। ৭.১ শতাংশ হারে গত বছর বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। হ্যা, আমাদের বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে যেতে হলে আরও অনেক সময় লাগবে। সময় লাগবে বলেই তো সরকার ভিশন ২০২১ এবং রোড টু ২০৪১ ঘোষণা করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে ভারতের পরেই বৃহৎ রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক বিবেচনায় মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া কিংবা ফিলিপাইন এর মত অনেক উন্নয়নশীল রাষ্ট্র থেকেও পিছিয়ে আছে, সত্য। কিন্তু ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিচারে বাংলাদেশ অবশ্যই বিশ্ব সভ্যতার অন্যতম সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরে বাংলাদেশ হল দ্বিতীয় রাষ্ট্র যা একটি সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। আমাদের ভূখণ্ডে সভ্যতার বয়স তিন হাজার বছর পুরনো বলে ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের এখানে যখন মানুষ সভ্যতা সৃষ্টি করছে, তখন অস্ট্রেলিয়ায় কী ছিল জানেন?

অস্ট্রেলিয়া এখন নিজেদের সভ্য বলে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হলেও বর্তমান স্মিথ-ম্যাক্সওয়েলদের পূর্ব-পুরুষরা তিনশ বছর আগেও ছিল গ্রেট ব্রিটেন থেকে নির্বাসিত কয়েদি। ১৭৮৮ সালে দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার পোর্ট জ্যাকসনে প্রথম স্থায়ী উপনিবেশ সৃষ্টি করা হয়; এটি ছিল ব্রিটিশ কয়েদিদের উপনিবেশ। এটিই পরবর্তীকালে বড় হয়ে সিডনী শহরে পরিণত হয়। ১৯শ শতক জুড়ে অস্ট্রেলিয়া এক গুচ্ছ ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে কাজ করত। ১৯০১ সালে এগুলি একত্র হয়ে স্বাধীন অস্ট্রেলিয়া গঠন করে। ব্রিটিশ অপরাধীরা ধীরে ধীরে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের কোণঠাসা করে দখলের রাজত্ব কায়েম করে। এই অস্ট্রেলিয়া এখন বিশ্বের অন্যতম উন্নত রাষ্ট্র। কিন্তু তাদের মানসিক উন্নয়ন হয়নি খুব একটা। আদিবাসীদের রক্তে রঞ্জিত শ্বেতাঙ্গ অস্ট্রেলিয়ানরা যখন বাংলাদেশে আসতে গেলে নাক সিটকায় তখন প্রতিটি বাঙালি এবং বাংলাদেশির একটু আত্মঅনুসন্ধানী হওয়াই লাগে।

প্রতিবেশী ভারতের দিকে তাকান। জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নানা মানদণ্ডে ভারত বিশ্বের অন্যতম বিপদজনক রাষ্ট্র। বিশ্বের ২৫টি ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রের একটি ভারত। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার হিসেবে ভারত বিশ্বের চতুর্থ রাষ্ট্র। এ তালিকায় বাংলাদেশের নামই খুঁজে পাওয়া যায়না। ভারতের নানা রাজ্যে কারফিউ পরিস্থিতি থাকে সারা বছর। বিজেপির মত উগ্রবাদী দল এখন ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতায়। সারাবছর নানা স্থানে বিস্ফোরিত বোমার সংখ্যা বিবেচনায় ভারতের অবস্থান আফগানিস্তানেরও ওপরে। এক ভণ্ড বাবার বিরুদ্ধে আদালতের রায় ঠেকাতে গিয়ে এই সেদিন ৩৮ জন মানুষ মারা গেছে। মাওবাদীদের হামলায় ভারতের পুলিশ এবং আর্মির শত শত সদস্য মারা যায়। এই ভারতে খেলতে আসলে অস্ট্রেলিয়া টু শব্দটি পর্যন্ত করে না। আর বাংলাদেশে খেলতে আসলে অস্ট্রেলিয়া নিরাপত্তার কথা বলে সফর স্থগিত করে।

যে অস্ট্রেলিয়া নিরাপত্তার অজুহাত দেয়, সে অস্ট্রেলিয়াতেই সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে সাম্প্রতিককালে। গত বিশ্বকাপ চলাকালে ইংল্যান্ডে একাধিক বড় সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। অথচ ইংল্যান্ড নিয়ে এই অস্ট্রেলিয়ার কোনো নেতিবাচক কথাবার্তা নেই। ভারতে একবার সফরে আসলে ৫/৬টি টেস্ট ম্যাচ খেলে। আমাদের সাথে খেলতেই আসতে চায়না। পুরো ক্রিকেট খেলা নিয়ে ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করতে চায় এই অস্ট্রেলিয়া-ভারত-ইংল্যান্ড। ভারত আমাদের ‘বন্ধু’ রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশের একযুগেরও বেশি সময় লেগেছে ভারতে গিয়ে একটা টেস্ট ম্যাচ খেলতে! বাংলাদেশ বছরের পর বছর টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় না। সেখানে ভারত-অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড একবার খেলা শুরু করলে, যেন থামতেই চায় না! ক্রিকেটকে নিজেদের পকেটে রাখতে চায় এরা। সেই সাম্রাজ্যেই আঘাত করে চলেছে বাংলাদেশ। নানা অজুহাতে তাই বাংলাদেশকে পিছিয়ে রাখতে চায় এই তিন মোড়ল।

ক্রিকেটে বাংলাদেশ যখন ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয় তখন সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়াগুলোর গালেও বড় চপেটাঘাত পড়ে। পশ্চিমা মিডিয়া কেন, ভারতের গণমাধ্যমেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি একটু উজ্জ্বল হবে এমন নিউজ দেখা যায়না। একটা নেতিবাচক ঘটনা ঘটলে ফলাও করে প্রচার করা হয়। বাংলাদেশের বড় বড় অর্জন সামান্যতম কাভারেজও পায়না। আমাদের সাকিব-তামিম এদের চোখে কখনোই বড় তারকা নয়। আমরা যেমন ভারতের খেলোয়াড়দের ছবি, নিউজ ছাড়া পত্রিকা বের করতে পারিনা, ভারতের দিক থেকে বিষয়টি এমন নয়।

সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাশরাফিরা তাই শুধু আমাদের খেলোয়াড় নয়। এরা বহির্বিশ্বে আমাদের একেকজন রাষ্ট্রদূত। এরা যখন জিতে যায়, তখন জিতে যায় বাংলাদেশ, পরাজিত হয় পুরনো ও নতুন সব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।

লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

খেলাধুলা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

খেলাধুলা এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :