অধ্যাপকদম্পতির ভালোবাসায় অন্তর্লীন এক পাখিদম্পতির কথকতা...

মোসলিমা খাতুন
| আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৩ | প্রকাশিত : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৩৬

‘প্রেম’ শব্দটি শুনলেই মন ফুরফুর করে ওঠে। শুনতে ইচ্ছে করে যেকোনো প্রেমের কাহিনি। তাই আজ দুজন অধ্যাপকের একটি প্রেমের গল্প শোনাবো পাঠককুলকে। একজন সরকারি কলেজের অধ্যাপক। এই বয়সে এসেও সে রীতিমতো সুদর্শন। দীর্ঘদিন অদেখার পর দেখা হলেই নারী-পুরুষ যে-কেউ একবার অন্তত বলেই ফেলে- স্যার, আপনার বয়স তো বাড়ছে না। কোনো রহস্য আছে কি? থাকলে বলুন স্যার, প্লিজ! অধ্যাপক প্রত্যুত্তর না করে শুধু হা.. হা.. হা.. করে হাসে।

বড়ো রোমান্টিক পুরুষ অধ্যাপক মহাশয়। শিল্প-প্রেম, সাহিত্য-প্রেম, সংগীত-প্রেম, নারী-প্রেম, নদী-প্রেম, শিশু-প্রেম, ফুল-প্রেম, ফল-প্রেম, পাখি-প্রেম, সর্বোপরি মানুষ-প্রেম তো বটেই- প্রচণ্ড দায়িত্বশীলও বটে। বৈষয়িক অনিচ্ছা আছে প্রচুর- তবে বিষয়ের প্রতি একনিষ্ঠ নিবদ্ধ দৃষ্টি তার। প্রাকৃতিক পরিবেশ-অন্তপ্রাণ এই অধ্যাপকের রুচির প্রশংসা করতে হয়। ফুলে-ফলে নেতিয়েপড়া বৃক্ষকুঞ্জে আবৃত তার ছোট্ট বাড়ির আঙিনা। প্রায় সময়ই শিশুদের কলকাকলিতে থাকে কলতান-মুখর। এ-বাড়িকে পাখিদেরও অভয়ারণ্য বলা চলে। কত রকমের যে পাখি। ঘুঘু, দোয়েল, ময়না, বুলবুলি, চড়ুই, শালিক, বউ-কথা-কউ, কাকাতুয়া, কবুতর, কোকিল আরো আরো নাম না জানা পাখিরাও আসে এখানে। তবে একটিও খাঁচায় পোষা নয়। মনে হয় অধ্যাপকের আন্তরিক আতিথেয়তার কারণেই এই পাখিরাজ্য তার প্রেমে পড়েছে। ফলে তার বিস্তর আঙিনার বৃক্ষডালপালা আর ঘরের ছাদই পাখিদের বসবার, খুনশুটি করবার আর নির্বিঘ্ন বংশবিস্তারের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছে। সকাল-বিকাল এমনকি নির্জন দুপুরেও পাখিদের নিরন্তর আসা-যাওয়া নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে ওঠেছে।

হঠাৎই একদিন অধ্যাপক খেয়াল করলেন- দুটি পাখি স্ট্রিট লাইটের মাথায় বসে কী যেন শলাপরামর্শ করছে। সেই থেকে পাখি দুটির প্রতি তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অব্যাহতভাবে চলমান থাকে। দেখা গেল দুদিন পর পাখিদুটি পালাক্রমে ঠোঁটে করে খড় আনা শুরু করেছে। খড়গুলো কোথায় রাখে? দোতলার সামনের বারান্দায় যে কোণাটায় একটা ঝোলঝাড়ু খাড়া করে রাখা হয়েছে তারই ফুলঝুরি রঙিন মাথায়। বুলবুলি পাখি। রুচি নেহায়তই কম নয় তাদের। চোখের সামনে পাখির বাসা বুননের এই ধৃষ্টতা সত্যি অসাধারণ। শুরু হলো অধ্যাপকদম্পতির পাখি-কার্যক্রমের ছবি তোলা। পাখির বাসা তৈরির কাজও পর্যায়ক্রমে ছবি করে রাখা হলো।

এত চমৎকার বাসার বুনন যে, অবাক করার মতো। তবে আশ্চর্য হতে হয় এই ভেবে যে, এই ছোট্ট বাসায় কীভাবে বাস করা সম্ভব তাদের! এটা তো একেবারেই চোখের সামনে। অনবরত মানুষের যাতায়াত এর সামনে দিয়ে। একদিন পর অধ্যাপক তার স্ত্রীরত্ন-অধ্যাপককে ডেকে বললেন- দ্যাখো.. দ্যাখো, দেখে যাও পাখির কী কাণ্ড। হাতের কাজ ফেলে অধ্যাপক-গিন্নি এসে সেও অবাক হয়। দুনিয়াজুড়ে এত বেশুমার জায়গা থাকতে এই ঝোলঝাড়ুর মাথায়? তাও আবার এভাবে! হ্যাঁ। যে-কেউ দেখলে তাই বলবে। তবে সবচেয়ে বড়োকথা- ততদিনে ঐ পাখিদম্পতির সাথে এই পরিবারের এমন একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে যে- ওরা সহজে আর অধ্যাপকদম্পতিকে ভয়ের তালিকায় রাখছে না। প্রতিদিনই নিয়ম করে অধ্যাপকগিন্নি তাদের খাবার থেকে ভাত ও চালকুড়া নিয়ে বাসার নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়। পাখিরা আনন্দে সারাদিন ওগুলো খুটে-খুটে খায়।

অধ্যাপকদম্পতির ছোটো পরিবার। মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সেই কবেই দূর-দেশে চলে গেছে। ছেলেটি তাদের সাথেই। তবে করোনা শেষ হলে ছেলেটিও তার পড়ালেখার স্থলে চলে যাবে। সুতরাং ফুল-পাখি-শিশু ও বৃক্ষের সাথেই এদের দিনকাল ও আনন্দযাপন।

কিন্তু হঠাৎ দুদিন যাবৎ পাখি-পরিবারটি বাসায় আসছে না। কেন? শুরু হলো অধ্যাপকদম্পতির স্বামী-স্ত্রী দুজনের গবেষণা। মহা-ভাবনার বিষয়। হঠাৎ আবার কয়েকদিন পর অধ্যাপক এক সময় আবিষ্কার করলেন পাখি দুটি ঐ স্ট্রিট লাইটের ছাদে বসা। বউকে তিনি বললেন- জানো, পাখিরা ডিম দেওয়ার আগে আরো দুএক জায়গায় বাসা বুনে। ওরা যেখানটায় নিরাপদ মনে করে সেখানটায়ই ডিম দেয়। ওই পাখিরা স্বামী-স্ত্রী। পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কোথায় তারা ডিম দেবে।

দুদিন পর দেখা গেল পাখি আবার আসা-যাওয়া শুরু করেছে। তখন অধ্যাপকের বউ বললেন- দেখেছো, সদর দরজার সামনে পাখি বাসা বাঁধলো; নিশ্চয়ই পাখি আমাদের বিশ্বাস এবং নিরাপদ মনে করেছে। পাখি এখানেই ডিম দেবে। বাচ্চা ফুটাবে। বাচ্চা বড়ো করবে। সে পর্যন্ত কিন্তু আমাদের খুব সতর্ক পাহারায় থাকতে হবে। জানো তো ঘরের শত্রু বিভীষণ। এই যে বিড়ালটা পোষো। এই বিড়ালই কিন্তু পাখির বড়ো শত্রু। কাজেই বি কেয়ারফুল।

পরদিন দেখা গেল পাখি সত্যি-সত্যিই ডিম পেড়েছে। ছবি তোলা হলো। একে-একে তিনটি ডিম। অধ্যাপক তার ছেলেকে, বউকে ডেকে নিয়ে ডিমগুলো দেখালো এবং বললো আজ থেকে সবাইকে নজর রাখতে হবে। বিড়াল যেন এদিকটায় না আসতে পারে। বউ বলে এত সতর্ক থাকা কীভাবে সম্ভব? এটা মানুষেরও যেমন সদর দরজা বিড়ালেরও তো। তা হোক। তারপরও খেয়াল রাখতে হবে। শুরু হলো পাখির ডিমে তা দেওয়া। মেয়ে পাখিটি ডিমে তা দেয়। পুরুষ পাখিটি পাশেই গ্রিলে বসে থাকে। মাঝে-মাঝে পুরুষ পাখিটি খাবার এনে মেয়ে পাখিকে খাওয়ায়, আবার কখনো মেয়ে পাখিটি খাবার খেতে গেলে পুরুষ পাখিটি ডিম পাহারা দেয়। এই বিষয়গুলো অনেক কষ্ট করে ভিডিও করা হলো। এখন শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা।

প্রায় দেড় সপ্তাহ পর অধ্যাপকের ঘর আলো করে (আসলে প্রথমত পাখির নিজের ঘর আলো করে) পাখির বাসায় তিনটে বাচ্চা ফুটে উঠলো। সেকি আনন্দ..., আনন্দ! দূর-প্রবাসে নাতিকে ভিডিয়ো কল দিয়ে অধ্যাপক জানায়- নানুভাই দ্যাখো, আমাদের পাখি আছে, পাখির বাচ্চা আছে। দশমাস বয়সের নাতি মুচকি হেসে হাত-পা নাড়িয়ে নানুর সাথে তাল মিলিয়ে তার অবুঝ মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে আর হাসে। চব্বিশ ঘণ্টার পাহারায় অধ্যাপক। দরজার সামনেই যেহেতু পাখির বাসা সেহেতু চব্বিশ ঘণ্টা দরজা খোলা। রাতেও দরজা খোলা থাকে তার। অধ্যাপকের চোখে ঘুম নেই। সারাক্ষণ চোখের সামনে বিড়ালের আতঙ্ক ভেসে ওঠে। কখন কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে। ভয়-আতঙ্কে দিন যায়, রাত যায়। অধ্যাপরের বউও এটা নিয়ে বিরক্তিবোধ করে না। কারণ সেও ততদিনে ঐ পাখির প্রেমে মশগুল। বাচ্চাগুলো ওদের চোখের সামনে বড়ো হচ্ছে। ধীরে-ধীরে বাচ্চাগুলোর পাখা কালো হতে শুরু করছে, একটু-একটু করে উড়াল পারা শিখছে। অধ্যাপক সিঁড়ি দিয়ে যতবার নামা-ওঠা করে ততবার বাচ্চাগুলোকে উঁকি দিয়ে দেখে। মাঝে মাঝে ভিডিয়োতে ছবি করে। তবে খুব কৌশলে করতে হয়। বাচ্চাগুলো অধ্যাপকের দিকে মিনমিন করে তাকিয়ে থাকে। আর মা পাখিটি তেড়ে আসে। তবে এর মধ্যেই অধ্যাপকের সাথে একটা বিশ্বাসীভাবও হয়ে গেছে তাদের। নইলে ছানাগুলো ওভাবে তাকিয়ে থাকে কেন? তিনটে বাচ্চার ভেতর একটি বাচ্চা আকারে ছোটো ও বেশ দুর্বল। তিনটে ডিমের মধ্যে যে ডিমটি পাখি পরে দিয়েছে ঐ ডিমের বাচ্চাটিই এমন দুর্বল। মানুষের বেলায়ও এমন হয়। মা যখন টুইন শিশুর জন্ম দেয়। পরে যে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয় সেই শিশুটি তুলনামূলক একটু দুর্বলই হয়।

এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন ‘আম্ফান’ ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস। সন্ধ্যের মধ্যেই বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে আঘাত হানতে পারে। আকাশ মেঘে আবৃত। গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি সারা দেশের উপর ঝরছে। হালকা দমকা বাতাস বইছে। পাখির ছানাগুলো যেকোনো মূহুর্তে উড়াল দিয়ে বাইরে বের হলেই বিরুদ্ধ পরিবেশে পড়ে মারা যেতে পারে। অধ্যাপকের নতুন এই দুশ্চিন্তা। তাই তাদের নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা হলো। খাবারও দেওয়া হলো। কিন্তু হঠাৎই মেঝো ছানাটি নেই। বড়োটি অবশ্য আগেই উড়াল শিখেছিল বলে সে আগেভাগেই চলে গিয়েছে। যদিও যাওয়ার সময় অধ্যাপক উপস্থিত ছিল না। এজন্য তার মিহি কষ্ট আছে। কিন্তু এটা? এটা তো এইমাত্র খাঁচায় ঢোকানো হলো নিজের হাতে। অধ্যাপক হাত ধোয়ার জন্য এক মিনিটের মতো আড়ালে ছিল। তবে অধ্যাপকগিন্নি তো তখনো দাঁড়ানোই ছিল। কী মিরাক্যাল ঘটনা। গেল কোথায়?

খোঁজা শুরু হলো পাখিছানাটিকে। এ গাছের ওগাছের ডালে। সদর গেট খুলে পাশের বাড়ির গাছের ডালে। না, কোথাও দেখা গেল না। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর আবিষ্কার করা হলো পাখি-ছানাটি পেয়ারা গাছের পাতার আড়ালে বসে পুচ্ছ নাড়াচ্ছে আর মা পাখিটি অদুরে বসে অধ্যাপকের দিকে পিট-পিট করে তাকিয়ে আছে। ছোটো বাচ্চাটিকে খাঁচা থেকে বের করে আবারো যথাস্থানে রাখা হলো। দুদিন পর সেই বাচ্চাটিকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কী ব্যাপার এটাও কি উড়ে গেল?

মা পাখিটি অধ্যাপকের দিকে সেই আগের মতোই তাকিয়ে আছে। ভাবনার অন্ত নেই অধ্যাপকের। এতদিন ধরে পাখিগুলো লালন করা হলো। ওরা সুস্থভাবে উড়ে যাক। নিরাপদ থাক, সে কারণেই তো ওদের জন্য এত আয়োজন। তাহলে কী হলো? কোথায় গেল? মাথায় আসছে না!

বিড়ালটি ঘর থেকে ধীর পায়ে নির্বিকার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। বাইরে দমকা হাওয়া ক্রমশ বাড়ছে। অধ্যাপকের মনের অজান্তেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের কয়েকটি লাইন অন্তরে অস্ফুটস্বরে বেজে ওঠলো- ‘যাবার আগে কিছু বলে গেলে না...’।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :