কোথায় পাব কালিকার প্রসাদ

কালে-অকালে রোগে-শোকে-সন্তাপে ঘটনা-দুর্ঘটনায় ঘরে-সড়কে কলকাতার কতজনই তো মারা যান। কেউ নক্ষত্র, কেউবা একেবারেই সাধারণ, অজানা। বাংলার পশ্চিমের এইসব খবর কতটা আর ভাবায় বাংলাদেশকে। অথচ দেখুন না, ভাটি বাংলার গানের অধুনা প্রবাদ-পুরুষ কালিকাপ্রসাদ প্রয়াত হলেন। অকাল প্রয়াণ।
তার ভাষ্যে, তিনি একাত্তরের সন্তান। বাংলাদেশের সমান বয়সী শিলচরের কালিকা। অর্ধশতের আগেই কত কত অর্জন সারেগামাপার বিচারক মহলের সমীহ আদায় করা এই মানুষটির।
দোহারের মহানায়ক, লোকগানের মহান এই গ্রাহক-গবেষকের আচমকা বিদায়ে বেদনার রাগিণী কলকাতা ছাপিয়ে আমাদের শহর ঢাকা অবধি পৌঁছে গেছে। বাংলার পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা সংগীতের সোনালি ফসল যার হাত ধরে নাগরিকগণের দুয়ারে দারুণ কড়া হতে পেরেছে, সেই কালিকাকে হারিয়ে নির্বাক সব বার্তা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে।
ফকির আলমগীর থেকে শাকুর মজিদ, সগীর মোস্তফা থেকে স্বকৃত নোমান― ঢাকার সংগীত-সাহিত্য-নাট্য তথা সংস্কৃতির সব শাখার সবার কণ্ঠে আজ পাওয়া যায় ক্ষণজন্মা কালিকার জন্য নিদারুণ আকুতি।
আসলে মানচিত্রের মানুষ হয়ে থাকেননি তিনি। গানের এই এক শক্তি। আপনাকে জাত-পাত, মহল-ছিটমহল সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিয়ে যাবে। সুরের মানুষ কালিকার এসব অর্জন তো আছেই, কেন্দ্র থেকে নিজেকে তৃণমূলেও নিতে পেরেছিলেন।
কেন্দ্রমুখী কথিত মেধাজীবীদের চোখও মাটিতে নামিয়ে আনতে পেরেছিলেন তিনি। আমাদের নাগরিকদের পদযুগলের সঙ্গে মাটির যোগাযোগ ঘটানোর অসাধ্য কাজটি করতে পেরেছেন কালিকা। কানে ঢেলে দিয়েছেন লোকজ বাংলার সুর-সুধা।
পূর্ব বাংলার গানের যে ভাণ্ডার হেলায় হেলায় ইট চাপা বিবর্ণ ঘাসের মতো করে দিয়েছে আজকের বাংলাদেশ, তা কলকাতার মাটি থেকে আবার সবুজ সতেজ করে দিয়েছেন কালিকা। সেই হতে আবার অকৃত্রিম আকার নিয়ে ঢাকায় এসেছেন পণ্ডিত রামকানাই দাশ, শাহ আবদুল করিম।
পাকা মহাসড়ক ধরে আমাদের গায়ের ধুলোমাখা পথে নিয়ে গিয়েছেন কালিকা। সেই যাত্রার পথেই নিয়ত জড়িয়ে ছিলেন। সেই টানে সড়কের ধারেই প্রাণ বায়ুর শেষ দমটা নিলেন কালিকা।
কী হবে আমাদের লোক গানের? কোথায় যাবে তার প্রিয় দোহার? এর উত্তর অজানা নয়। দিয়ে গেছেন কালিকাই। তার আগে বরং জিজ্ঞাসাটা জানি।
পাঁচ বছর আগেই আনন্দবাজার কালিকাকে যা শুধায়, তার রূপটা হচ্ছে- দোহার আছে কিন্তু কালিকাপ্রসাদ নেই...।
- অসম্ভব কিছু নয়। বিশ্বাস করি ব্যক্তির থেকে দল সব সময়ই বড়।
চাই যে, কালিকার এই আকাক্সক্ষা সততই সত্য হোক। গায়কের চেয়ে আসলেই তো দল বড়। কিন্তু কালিকার অকাল প্রয়াণের দিকটি ঠিকই আমাদের মাথায় শঙ্কার বাজ নিয়ে হাজির হয়।
অভিধান বলছে, প্রসাদ মানে চিত্তের প্রসন্নতা।
কালিকা আর নেই। কোথায় পাব কালিকার প্রসাদ! নতুন ভুবনের মাঝি হয়ে কালিকাপ্রসাদ কী শুনছেন?
১২ মার্চ ২০১৭
এই সময়, ইস্কাটন গার্ডেন, ঢাকা।
তায়েব মিল্লাত হোসেন : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

মন্তব্য করুন