সংলাপই সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ

বাছির জামাল
  প্রকাশিত : ১৮ জুলাই ২০১৮, ০৮:৩৫| আপডেট : ১৮ জুলাই ২০১৮, ০৮:৫৬
অ- অ+
প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আবদুল জলিলের মধ্যে সংলাপ

‘বাংলাদেশে বর্তমানে যে সংকট বিদ্যমান তা মোটেও সাংবিধানিক সংকট নয়। এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সংকট। সংবিধানের দিকে তাকিয়ে সমাধান খুঁজলে তো হবে না। এ সংকট সমাধানে অবশ্যই সরকারের দায়িত্বটা বেশি।’ সম্প্রতি বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপচারিতায় এ কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইস্টার্ন ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক আলী রিয়াজ। তিনি এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তাই বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ অন্য দেশের রাজনীতিবিজ্ঞানের কোনো গবেষকের তুলনায় বাস্তবমুখী যে হবেÑ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

তিনি গত ৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল ইসলাম লেকচার হলে ‘বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি’ শীর্ষক এক বিশ্লেষণ উপস্থাপনা করেন। এতে সভাপতিত্ব করেন আরেক বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. রওনক জাহান। রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট ও জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ বক্তৃতার আয়োজন করে।

এতে তিনি বলেন, বর্তমান সময়ের যে সংকট তা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন এবং আরও গভীর। এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে তা আসলে হাইব্রিড রেজিম বা দোআঁশলা ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় দৃশ্যত গণতন্ত্রের কিছু উপাদান থাকলেও সেগুলো প্রধানত শক্তি প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে। ফলে রাষ্ট্রের নিপীড়ক যন্ত্রগুলো আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং তাদেরকে একধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়।

তিনি মনে করেন, গত এক দশকে যে সব দেশে এই ধরনের হাইব্রিড রেজিম তৈরি হয়েছে সেখানে এক ধরনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই উন্নয়নের ফলে নতুন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে যাদের মধ্যে অতীতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মতো গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা এবং অংশগ্রহণমূলক সমাজের স্বপ্ন অনুপস্থিত। এই শ্রেণি যে বিরাজমান হাইব্রিড রেজিমের রাজনৈতিক এজেন্ডার পক্ষে থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক, কারণ তাদের অস্তিত্ব কার্যত নির্ভর করছে এই ব্যবস্থা অব্যাহত থাকার সঙ্গে। এ নতুন শ্রেণি দেশের অর্থনীতিতে বিরাজমান দুর্নীতি এবং লুণ্ঠনের প্রক্রিয়াকে ভবিষ্যতে বৈধতা প্রদানের হাতিয়ার হবে।

আলী রীয়াজ বলেন, যে ক্ষমতাসীনদের কাজের বৈধতা তৈরি হয় একমাত্র নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়েই, সেই নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ হলো কি না সেটা আর বিবেচ্য থাকে না। যেহেতু নির্বাচনি ব্যবস্থার ওপর ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেহেতু আর সব ধরনের জবাবদিহির ব্যবস্থা চূর্ণ করে ফেলাই হচ্ছে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার উপায়। বাংলাদেশের সমাজে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি, সহিংসতার ব্যাপক বিস্তারের যে সব ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তা আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কার বাস্তবভিত্তি এখানেই।

রাজনীতিতে ইসলামপন্থিদের প্রভাবের বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইসলামপন্থি রাজনীতি দুইভাগে বিভক্ত। তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল এবং সংস্কারপন্থি। গত কয়েক বছরে তুলনামূলকভাবে সংস্কারপন্থি ধারা দুর্বল হয়েছে। তাদের অনুপস্থিতির সুযোগে রক্ষণশীল ইসলামপন্থিরা রাজনীতির প্রান্তিক অবস্থান থেকে রাজনীতির কেন্দ্রে আসতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে রক্ষণশীল ইসলামপন্থিরা রাজনীতির এজেন্ডা নির্ধারণের মতো ক্ষমতা রাখেন। ক্ষমতাসীন দল গত দুই-তিন বছরে এই শক্তিকেই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।

তিনি মনে করেন, আগামীতে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির ক্ষেত্র যতই সীমিত হবে, এই শক্তির প্রভাব ও ক্ষমতা বাড়বে। সকলের অংশগ্রহণমূলক অবাধ নির্বাচনের বিকল্প কিছু চেষ্টা করা হলে এই শক্তিই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত প্রায় নির্ধারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, যা কার্যত সব প্রধান দলই স্বীকার করে নিয়েছে; কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা বলে যে, এতে করে দীর্ঘমেয়াদে ভারতের লাভবান না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

ড. রীয়াজ সেদিনের বক্তৃতায় আরও অনেক বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তবে মোটা দাগে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তার বিশ্লেষণ উপরে তুলে ধরা হলো। তিনি যে বিষয়টার উপর গুরত্ব দিয়েছেন, তা হলো দেশে চলমান সংকটকে তিনি ‘রাজনৈতিক সংকট’ বলে অভিহিত করেছেন। এই সংকট থেকে মুক্তির জন্য সংবিধানের দিকে তাকালে চলবে না। এ সংকট সমাধানে ক্ষমতাসীনদের দায় বেশি। বহুবার আমরা বলতে চেষ্টা করেছি যে, চলমান এই রাজনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি লাভের একটি উপায় আছে, আর তাহলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ। আর এ সংলাপ আয়োজনের দায়টা ক্ষমতাসীন দলেরই বেশি।

আমরা মনে করি, একটি সংলাপই পারে বর্তমান অচলাবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে। এই সংলাপের পরিবেশ তৈরিতে প্রথমই প্রয়োজন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া। কারণ, তাকে মুক্তি না দেওয়াটা সংলাপের পথে প্রধান অন্তরায় হবে। সরকারের জন্য এটাও কোনো বড় বাধা হবে বলে মনে করি না। কেননা খালেদা জিয়া তার মূল মামলায় জামিনে রয়েছেন। এখন অন্য মামলায় জামিন পেলেও তাতে স্থগিতাদেশ থাকায় কারাগার থেকে বের হতে পারছেন না। খালেদা জিয়ার এক আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন তো বলেছেনই যে, ‘সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া আইনি লড়াই করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব হবে না।’ এ থেকে বুঝা যায়, সরকারের সদিচ্ছাটা এখন বড়ই জরুরি।

সংলাপের মাধ্যমে বর্তমান সংকট নিয়ে কোনো মতৈক্যে পৌঁছতে না পারলে রাজনীতিবিদসহ সিভিল সোসাইটি মনে করেন যে, দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হবে। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য ভালো তো হবেই না, বরং এক ধরনের নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এ রকম অবস্থায় ‘অসাংবিধানিক শক্তি’ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সম্ভাবনাই বেশি। এতে কোনো পক্ষেরই লাভ হবে না। এ বিষয়টা আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারব ততই মঙ্গল।

বাছির জামাল: প্রধান প্রতিবেদক, দৈনিক মানবকণ্ঠ

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
জুলাইয়ের প্রথম শহীদ সাংবাদিক ঢাকাটাইমসের হাসান মেহেদীর মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের এপিএস হলেন আয়মন রাহাত
মতিঝিলে সেনা কল্যাণ ভবনে আগুন
জুলাই সনদ তৈরির প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ: প্রধান উপদেষ্টা
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা