এবারও কাটল না শিরোপার খরা

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ ও সদর উদ্দীন লিমন
 | প্রকাশিত : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৩:৫৩

খুব কাছে গিয়েও ছোঁয়া হলো না! খেদ রয়ে গেল মনে। আহা! আরেকটু হলেই হতো। আর দুটো রান যদি থাকত স্কোরবোর্ডে! তাহলে এই রাত হতে পারত বাংলাদেশের।

‘অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে

হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে’। (জয় গোস্বামী)

শিরোপার আক্ষেপ নিয়েই শেষ করত হলো এশিয়া-সেরার লড়াইটা। এই আক্ষেপ ২০১২ সালে ঢাকায় পাকিস্তানের কাছে ২ রানে পরাজয়ের চেয়ে কম নয়! শেষ বল পর্যন্ত আশা জাগিয়ে রেখেছিল টাইগাররা। প্রতিপক্ষ ভারতকে চাপে রেখেছিল তারা। হারতে হারতে জিতেছে রোহিতরা। কারণ এক বল হাতে থাকতে দুই দলের রান ছিল সমান। শেষ বল থেকে আসা রানটিও ব্যাট থেকে নয়, এসেছে প্যাড থেকে। কেদার জাদবের কৃতিত্ব শুধু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাইশ গজ পার হওয়ায়।

১৯৮৪ সালে এশিয়া কাপ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনবারের রানার্সআপ সম্মানটাই সান্ত¡না হয়ে থাকল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য।

লিটন আর মিরাজের শুরুটা ছিল মেঘমুক্ত আকাশে ঝকঝকে রোদের মতো। মরুভূমির বুকে জাগিয়েছিল এক টুকরো সবুজ স্বপ্ন। এবার একটা কিছু হবেÑভাবতে বাধা ছিল না মোটেও। এতটা দারুণ শুরু অবশ্য এবারের আসরে বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয়টি নেই। ফর্মে না থাকা লিটন দাসের দাপুটে শতকে ভর করে দুবাইয়ে রাতটি বাংলাদেশের জন্যই হতে চলছিল। শেষতক একটা নিশ্চুপ অপ্রাপ্তি গেঁথে গেল হৃদয়ে। নিশীথের আনন্দ আয়োজন হলো প্রতিবেশীর তাঁবুতে। আমাদের বেদনাশ্রু ম্লান করল বিষাদের প্রদীপ।

মাশরাফিদের ঘিরে ১৬ কোটি মানুষের স্বপ্ন খুব বড় ছিল না হয়তো। লিটন-মিরাজের শুরুটাও তাই বলছিল। কিন্তু খেলার মাঝটায় ব্যাটম্যানদের ঘনঘন আসা-যাওয়া আশাহত করেছে সমর্থকদের।

এশিয়া কাপের ফাইনালে আগেও একবার ভারতের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের ওই আসরে আট উইকেটে হার মানতে হয়েছিল টাইগারদের। তাও ঢাকার মাটিতে। তার বছর চার আগে এই মাটিতেই গড়িয়েছিল সাকিব-মুশফিকদের চোখের জল। প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান। ভেজা চোখ দুটো আজ ভেসে ওঠে মনে।

২০১৬ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে যাওয়া বাংলাদেশ আর এবারের বাংলাদেশের মধ্যে তফাত কী ছিলÑবিশ্লেষণের দায় ক্রিকেটবোদ্ধাদের। তবে এবার বাংলাদেশের ফাইনালে পৌঁছার পেছনের কাহন সাদা কাগজে সরল রৈখিক ছকে ফেলার সুযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কাকে ১৩৭ রানে টপকে দিয়ে টাইগাররা নিজের সম্ভাবনার জানান দিয়েছিল। কিন্তু পরের ম্যাচে আফগানিস্তানের কাছে ১৩৬ রানের পরাজয়টা মেনে নেয়ার মতো ছিল না।

সুপার ফোরের শুরুর ম্যাচেও রোহিতদের কাছে মাশরাফিদের হারের ব্যবধান ছিল সাত উইকেট। পরের ম্যাচে ঘাম ঝরাতে হয়েছে মুশফিক-মোস্তাফিজকে। তা না হলে একটু হলেই হাত ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল রশিদ খানদের বিপক্ষের তিন রানের জয়। ফাইনালে ওঠার আগের ম্যাচটায় শর্ট মিড উইকেটে শোয়েবের ক্যাচটা মাশরাফির হাতে জমে না গেলে, ফাইনালের দর্শক হয়ে থাকতে হতো বাংলাদেশকে। সেদিন অবশ্য গাঙচিলের মতো উড়ে ম্যাশ শুধু বলটা লুফে নেননি, লুফে নিয়েছিলেন জয়।

ভাঙনের মুখ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর অনেক গল্প আছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের। হারতে হারতে জিতে যাওয়া। আবার প্রাণপণ লড়াইয়ে পরাজয়ের খাদ থেকে জয় তুলে আনা। এই বাংলাদেশের জন্য একটা শিরোপা দরকার ছিল খুব। শুধু অর্জনের স্মারক হিসেবে নয়, সম্মানের জন্যও বটে। তবে এও ঠিক, শিরোপার বিচারে টাইগার বাহিনীকে ছোট করার সুযোগ নেই। অতীত বিচারে বাইশ গজের সৈনিকরা অনেক সক্ষম। এই সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য পরাজয়ের মিছিল সুদূর পরাহত।

এই বাংলাদেশ দলকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি আমরা। স্বপ্ন দেখাও অবান্তর নয়। স্বপ্নটাও আকাশছোঁয়া নয়। আয়ত্তের মধ্যেই। ধরতে গিয়েও হাত ছাড়া হয়েছে অনেকবার। এবারের এশিয়া কাপের আসরের শিরোপা নির্ধারণের খেলাটিও তার একটি।

১২০ রানে লিটনের সঙ্গে জুটির বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরে আসেন মিরাজ। ওটাই প্রথম উইকেটের পতন। ম্যাচে তখনও বাংলাদেশের দাপট। আট রানের ব্যবধানে মাঠ ছাড়লেন ইমরুল কায়েস। সতর্ক হওয়ার সময় ছিল তখন। মুশফিক, মাহমুদউল্লাহরা সেটি বুঝতে পারেননি? পেরেছিলেন হয়তো। কিন্তু বোলারদের টোপে পা দেওয়া যে ঠিক হয়নি, উইকেট বিলিয়ে ফেরার পথে তাই ভাবছিলেন।

ফাইনালের বাড়তি চাপ নিতে মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। এ প্রস্তুতি যে সবার নেই, বলা যাবে না। এও ভুলে গেলে চলবে না, দলের সম্মিলিত অর্জন কিংবা বিসর্জনÑফলা নির্ধারণের নিয়ামক।

এশিয়া কাপের এবারের আসরে বাংলাদেশের অর্জনও কম নয়। এবার আফগানিস্তান বেশ ভালো খেলেছে। তাদের তিন রানে সেদিন হারিয়ে দিতে না পারলে তো ফাইনালের আশাই ধুলোয় মলিন হতো। পাকিস্তানের সঙ্গেও অনবদ্য খেলেছে টাইগাররা। চেতনা আর সক্ষমতা দুটোরই জয় হয়েছে। দেশপ্রেমের বড় উদাহরণ হয়েছেন তামিম ইকবাল। এক হাতে মারাত্মক ক্ষত। তার ওপর ব্যান্ডেজ জড়ানো। সেই অবস্থায় মাঠে নেমে এক হাতে মোকাবিলা করেছেন প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কাকে। এর পেছনে ছোট্ট একটা গল্প আছে। দলনেতা মাশরাফি বিন মুর্তজা সেদিন তামিমকে মাঠে নামতে অনুরোধ করেছিলেন। মুশফিকুর রহিমকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। কারণ তামিম সেদিন না নামলে মুশফিক একা হয়ে পড়েছিলেন। মাশরাফির সেই অনুরোধ রেখেছিলেন তামিম। ম্যাচের ফল অনুকূলে এসেছিল। জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ।

তারপর আফগানিস্তানের সঙ্গে ম্যাচে মোস্তাফিজ বলেছিলেন, ‘ভাই, আমি আর পারব না।’ ওর কাফ মাসলে টান লাগছিল। এফোর্ট দিতে পারছিল না। মাশরাফি হাল ছাড়েননি। মানসিকভাবে সাহস জুগিয়েছেন। মোস্তাফিজকে বলেছিলেন, ‘ম্যাচটা জিতিয়ে দে।’ অভিভাবকের কথা রাখতে মোস্তাফিজ চেষ্টা করেছেন। সফল হয়েছেন। আফগানিস্তানের সঙ্গে শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল মাত্র আট রান। সেই অবস্থায় ম্যাচটা নিজেদের করে নিয়েছিলেন কাটার মাস্টার।

নিজেও পুরোপুরি ফিট ছিলেন না মাশরাফি। হাতে, পায়ে, কোমরে ব্যথা। তার ওপর পাকিস্তানের সঙ্গে ম্যাচে ডান হাতের কনিষ্ঠায় আঘাত পেয়েছেন নতুন করে। এর মধ্যেও মনের জোরকে কাজে লাগিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন দলের। কখনো তিনি বড় ভাই। কখনো সংসারে বাবার মতো অভিভাবক। কখনো দলপতি। যখন যেমনটা প্রয়োজন, মাশরাফি সবটুকুই দিয়েছেন উজাড় করে। শিরোপা জয়ের দাবিদার তিনিই ছিলেন। যদিও ভাগ্যটা নুয়ে পড়েও সরে গেল আকস্মাৎ।

তারপরও সবটা বিচারে নিলে, বাংলাদেশের অর্জন কম নয়। ২২৩ রানের ছোট টার্গেটে এশিয়া কাপের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে চ্যালেঞ্জ জানানো, দুর্দান্ত সাহসের পরিচয়ই বটে। শুধু সাহস দেখানোই নয়, শেষ পর্যন্ত লড়েই রানার্সআপ হয়েছেন মাশরাফি-মুশফিকরা। এই প্রাপ্তিও কম নয়। অভিবাদন লাল-সবুজের সারথীদের।

সংবাদটি শেয়ার করুন

খেলাধুলা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :