মেঘনা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন: হুমকির মুখে বেড়ী বাঁধ

ভোলা প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২২:২৫

ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার ভাঙ্গনকবলিত মেঘনা নদীর তীর সংরক্ষণে সিসি ব্লক ও বেড়ী বাঁধের কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তারই পাশের মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। যার ফলে নদীর ভাঙন ঠেকাতে সরকারের সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার সিসি ব্লক ও বেড়ী বাঁধের কাজ হুমকির মুখে পড়ছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের পর থেকে ভাঙনের গতি আরো বেড়েছে। গত তিন বছর ধরে এ এলাকার একটি প্রভাবশালী মহল বালু উত্তোলন করছে। এলাকার লোকজন তাদেরকে নিষেধ করলেও তারা তা মানছে না। এমনকি পুলিশ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কোস্টগার্ড কর্মকর্তারা একাধিকবার এ বালু উত্তোলনে বাধা দিলেও তারা কয়েকদিন বন্ধ রেখে আবার চালু করেছে।

বালু উত্তোলনের সঙ্গে তজুমদ্দিন উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. ছালেম মাতাব্বর ওরফে বালু ছালাম ও মো. সবুজ ওরফে বালু সবুজ সরাসরি সড়িত।

পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর (পাউবো) তথ্যমতে, তজুমদ্দিন উপজেলার চৌমুহনী থেকে কেয়ামুল্যাহ পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার মেঘনার তীর ও স্লপ (বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ঢাল) সংরক্ষণকাজ করা হচ্ছে। এখানে প্রায় ৪০ লাখ সিসি ব্লক ফেলা হবে। এতে ব্যয় হবে প্রায় ৪৪৯ কোটি টাকা। কাজটি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শুরু হয়েছে। এখনও চলমান আছে।

গত শনিবার তজুমদ্দিন উপজেলার স্লুইসগেট মাছঘাট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সেখানে ভাঙনকবলিত এলাকায় বেড়ী বাঁধ ও ব্লক তৈরির কাজ চলছে। এরই পাশে বন বিভাগের শশীগঞ্জ বিট অফিস থেকে শুরু করে স্লুইজগেট পর্যন্ত একাধিক ড্রেজার বসিয়ে পাইপ দিয়ে মেঘনা নদী থেকে বালু তুলে পুকুর, বিল, কৃষিজমি, ঘর ভিটি-বাড়ির ভরাট করা হচ্ছে। আবার কোনো কোনো যায়গায় বালু জমা করে রাখা হচ্ছে বিক্রির জন্য।

২০-২৫ জন এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার গুড়িন্দা থেকে লঞ্চঘাট হয়ে দক্ষিণ দিকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকা ভাঙনের মুখে রয়েছে। গত দুই-তিন বছর ধরে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। স্লুইসগেট ও চৌমুহনী লঞ্চঘাট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নতুন স্থানে লঞ্চঘাট (পন্টুন) বসানো হলেও ভাঙনের কারণে পন্টুনটি কাত হয়ে আছে। স্লুইসগেট ও চৌমুহনী মাছঘাট ভাঙনের কারণে কয়েকবার সরানো হয়েছে। যাত্রীরা ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা ও মনপুরার লঞ্চে ওঠানামা করছেন।

এলাকাবাসী আরো জানায়, উপজেলা প্রশাসন, কোস্টগার্ড ও পুলিশ কয়েকবার বালু উত্তোলন বন্ধ করেও কাজ হয়নি। কিছুদিন পর আবার শুরু হয়। এই লবনাক্ত বালু দিয়ে পুকুর, বিল, জলাশয় ভরাট হচ্ছে। ভবন নির্মাণ হচ্ছে। লবনাক্তের কারণে স্থাপনা টেকসই হচ্ছে না। রাতের আঁধারে বালু তুলে তীরে এনে দিনের বেলায় পাইপ দিয়ে তা উপরে তুলছে।

তজুমদ্দিনবাসী জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তীর সংরক্ষণ কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে এক দিকে ভাঙনের মুখ থেকে বালু তোলা হয়েছে। অন্য দিকে ব্লক ফেলে তীর সংরক্ষণের কাজ চলছে। এতে করে ভাঙন বন্ধ না হয়ে উল্টো ভাঙন বাড়ছে।

নদী ভাঙনের শিকার একাধিক এলাকাবাসী বলেন, ভাঙন এলাকার পাশের মেঘনা থেকে মো. ছালেম মাতাব্বর ওরফে বালু সালাম নামের এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ২০১৬ সাল থেকে বালু তুলছেন। এতে করে মেঘনার ভাঙন তীব্র হচ্ছে। প্রতিদিন মেঘনা থেকে অপরিকল্পিত ২০-২৫টি কার্গো জাহাজ দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। বিগত সময়ে মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জের ড্রেজার ভাড়া আনলেও বর্তমানে ভোলার মালিকদের নিজস্ব ড্রেজার আছে। এগুলোর লাইসেন্স নেই।

স্লুইজগেট মাছঘাটের মাছ ব্যবসায়ী মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারণে এ উপজেলায় নদীর ভাঙন তীব্র হচ্ছে। বর্ষায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তজুমদ্দিনবাসী বর্ষার জোয়ারে প্লাবিত হয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়ে; এখন শীতেও নদী ভাঙছে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফখরুল আলম জাহাঙ্গীর বলেন, ছালেম উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। তাকে নদীর তীর থেকে বালু তুলতে নিষেধ করেছি। নদীর মাঝে যে ডুবোচর আছে, সেখান থেকে কাটতে বলেছি। কারণ ডুবোচরের কারণে তীর ভাঙছে।

তজুমদ্দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশ্রাফুল ইসলাম বলেন, তিনি তজুমদ্দিনে আসার পরে বালু তোলা বন্ধ করেছেন। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তীর সংরক্ষণ কাজের জন্য কিছু বালু উত্তোলণ করছিল। সেটি তোলার জন্যই পাইপ টানা ছিল। সেটি তোলা শেষ হওয়ার পরে আবার যদি বালু তোলা হয়, তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ভোলা বন্দরের উপ-পরিচালক মো. কামরুজ্জামান বলেন, চরফ্যাশন-লালমোহন-মনপুরা-তজুমদ্দিন-বোরহানউদ্দিন-দৌলতখান-ভোলা-ঢাকা নৌপথে মেঘনা নদীতে ১৫টির মতো লঞ্চঘাট রয়েছে। মেঘনায় অপরিকল্পিত বালু উত্তোলণের কারণে ভাঙন বাড়ছে। যার ফলে মেঘনার তীরে সব কটি লঞ্চঘাট বারবার বিকল হচ্ছে।

ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো-২) নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলেন, তাদের তীর সংরক্ষণ কাজে কোনো ভিটি বালুর(চিকন) দরকার নেই। মেঘনা নদী এমনিতেই ভাঙনপ্রবণ। ভাঙনের আশপাশ দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করলে ভাঙন আরো বাড়বে।

বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজার বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজা খন্দকার বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলনকারীরা সাধারণত যেখানে-সেখানে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করছে। এ কারণে ভাঙন বৃদ্ধি পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। বিআইডব্লিউটিএর খনন বিভাগ নদীর ডুবোচর কাটে সমান (লেবেল) করে । এতে নদীর নাব্যতা ফিরে আসে। আর বালু উত্তোলণকারীরা গভীর গর্ত করে বালু উত্তোলণ করে। গর্ত করার কারণে চারদিক থেকে ভেঙে আবার গর্ত ভরাট হয়। এতে বিপর্যয় দেখা দেয়।

অভিযুক্ত মো. ছালেম মাতাব্বরের ছেলে নুরে আলম বলেন, তারা মেঘনা নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু তুলছেন না, কার্গো থেকে মোটা দানার বালু তুলছেন।

মো. সবুজও তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মেঘনা থেকে চিকন দানার ভিটি বালু তোলা হয়। তিনি মুন্সিগঞ্জের টোক (বড় দানা) বালুর ব্যবসা করেন।

ভোলা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক বলেন, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনে ভাঙন বৃদ্ধি ছাড়াও অনেক ক্ষতি করছে। তা ছাড়া ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীতে বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ অবৈধ। গত রবিবার ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের তুলাতুলি এলাকার মেঘনায় অভিযান চালিয়ে কয়েক জাহাজ বালু জব্দসহ দুজনকে দুই বছরের জেল ও ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের জেল দেয়া হয়েছে। এভাবে তাদের অভিযান চলবে।

(ঢাকাটাইমস/১১ফেব্রুয়ারি/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :