হাসপাতাল-ডাক্তার-প্রেসক্রিপশন ও আমাদের প্রাইভেসি

শাহাবুদ্দিন শুভ
  প্রকাশিত : ১২ মার্চ ২০২০, ১৬:২০
অ- অ+

আপনি ডাক্তার দেখাতে গেছেন আর কেউ এসে আপনার প্রেসক্রিপশন দেখতে চায়নি বা ছবি তুলে নিয়ে যায়নি তা হতে পারে না। অথবা আপনি একজন মুমূর্ষু রোগী নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন ডাক্তার দেখাবেন বলে, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন ২৫-৩০ জন ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধি সিরিয়ালেই দাঁড়িয়ে আছেন ডাক্তার ভিজিট করার জন্য। সেক্ষেত্রে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। অথচ ডাক্তার আসার কথা ছিল ৬টায়, কিন্তু আসলেন ঘণ্টা দেড়েক দেরিতে। এসেই ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ।

কারণ, আপনি হয়তো পাঁচশ টাকা থেকে এক হাজার টাকা দিবেন ভিজিট হিসেবে কিন্তু ওরা স্যাম্পল হিসেবে হয়তো কয়েক হাজার টাকার ওষুধ দিয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে আপনার চেয়ে প্রাধান্য পাবে ঔষধ কোম্পানি। এসব বিষয় আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। তবে সব ডাক্তার এভাবে করছেন তা কিন্তু না, এদের মধ্যে ভালোভাবে রোগী দেখেন টেস্টের কমিশন নেন না এমন সংখ্যাও কিন্তু কম নয়।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ২৬৯টি এলোপ্যাথিক, ২০৬টি আয়ুর্বেদিক, ২৬৬টি ইউনানি, ৩২টি হার্বাল এবং ৭৯টি হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানি রয়েছে, যাদের সবকটির কাজই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণ/মনিটর করে।

এখন একটু হিসাব মিলাই। ২৬৯টি এলোপ্যাথিক কোম্পানির মধ্যে যদি একটি হাসপাতালের বহির্বিভাগে ১২০ জন বিক্রয় প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন বা ঘোরাঘুরি করেন সে ক্ষেত্রে সাধারণ রোগীর জন্য কি রকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। অনেক হাসপাতালের বহির্বিভাগে দাঁড়ানো বা বসার পর্যাপ্ত জায়গাই থাকে না অথচ অতিরিক্ত আরও কত মানুষ।

আমরা কি খেয়াল করে দেখেছি আমাদের তথ্যগুলো নিজের অজান্তেই অন্য কারো কাছে চলে যাচ্ছে? কি কি সমস্যা বা আপনি কেন ডাক্তার দেখিয়েছেন? কি কি ওষুধ খাবেন বা খাচ্ছেন? আপনাকে কি কি পরীক্ষা করতে হবে তাও তারা জেনে যাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রেসক্রিপশনের তথ্যগুলো অন্য কারো হাতে চলে যাচ্ছে। এই তথ্যগুলো বেহাত হওয়ার ফলে আপনার প্রাইভেসি বলে কি কিছু থাকল?

সরকারি অনেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের নোটিশ দেখতে পাওয়া যায় নির্দিষ্ট দিন বা সময় ছাড়া বিক্রয় প্রতিনিধিরা যেন না আসেন। কিন্তু তা তারা মানছেন কোথায়? প্রতিষ্ঠান কি নোটিশের আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করছে? যদি তা স্বচক্ষে দেখতে চান তাহলে চলে যেতে পারেন ঢাকা শহরের যে কোনো একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আমারও এরকম একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বহির্বিভাগে। এলাকার এক রোগীকে কিডনি বিভাগের বহির্বিভাগ থেকে ডাক্তার দেখানোর পর যখন বেরিয়েছি তখন ঔষধ কোম্পানির কয়েকজন প্রতিনিধি অনেকটা ঘিরে ধরলেন। অবস্থা এমন যে, ছবি তোলার জন্য পারলে আমার হাত থেকে জোর করেই নিয়ে নেবেন প্রেসক্রিপশন। তা কি কাম্য? কতটুকু অস্বস্তিকর পরিস্থিতি যিনি একবার পড়েছেন তিনিই বুঝবেন। এলোপ্যাথিক ছাড়া অন্যগুলোর কথা নাই বা বললাম।

ধরুন কেউ গোপন কোনো রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। যে বিষয়টি উনি পরিবারের কাউকে জানাতে ইতস্তত করছেন। বা কেউ জানলে হয়তো সমাজের কাছে তিনি ছোট হয়ে যাবেন বলে মনে করছেন। কিন্তু সেই রোগীটি যখন ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হচ্ছেন সাথে সাথে তাকে ঘিরে ধরেন কয়েকজন বিক্রয় প্রতিনিধি। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছবি তোলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে যিনি কাউকে কোনো কিছু না জানানোর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন তারও তথ্য চলে যাচ্ছে কিছু কোম্পানির কাছে। যেখানে উল্লেখ্ থাকছে তার নাম, বয়স, লিঙ্গ, রোগের নাম অথবা লক্ষণ, কি কি পরীক্ষা করতে হবে এসব কিছু। সাথে পথ্য নিষেধ তো আছেই। অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখে থাকি কোম্পানিগুলো তাদের ডাটাগুলো বিক্রি করে থাকেন। এক্ষেত্রে এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানি এমনকি দেশের বাইরেও তথ্যগুলো চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

আমরা কি খেয়াল করে দেখেছি আমাদের তথ্যগুলো নিজের অজান্তেই অন্য কারো কাছে চলে যাচ্ছে? কি কি সমস্যা বা আপনি কেন ডাক্তার দেখিয়েছেন? কি কি ওষুধ খাবেন বা খাচ্ছেন? আপনাকে কি কি পরীক্ষা করতে হবে তাও তারা জেনে যাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রেসক্রিপশনের তথ্যগুলো অন্য কারো হাতে চলে যাচ্ছে। এই তথ্যগুলো বেহাত হওয়ার ফলে আপনার প্রাইভেসি বলে কি কিছু থাকল?

আপনি বা আমি নিজের টাকায় একটি ক্লিনিক, বেসরকারি হাসপাতাল বা কোনো চেম্বারে ডাক্তার দেখাতে গেলাম, নিজে টাকা দিলাম, সাথে সাথে গোপন তথ্যগুলোও দিয়ে আসলাম। এটা কি কেবল আমাদের দেশে সম্ভব নাকি পৃথিবীর অন্য দেশেও হয় তা আমার জানা নেই। যদিও বেশ কিছু দেশ ভ্রমণ করেছি তবে এভাবে কোথাও কোনো ডাক্তার দেখাইনি বলে তাদের সাথে পার্থক্য ধরতে পারছি না। তবে কয়েকজনের সাথে কথা বলে যা জানতে পেরেছি ছবি তোলার সংস্কৃতিটা শুধু আমাদের দেশেই।

আমরা চাই রোগীর প্রাইভেসির স্বার্থে কোনো প্রেসক্রিপশনের ছবি যেন না তোলা হয়। কোম্পানির প্রতিনিধিরা ডাক্তার ভিজিট করুক, কিন্তু তা অবশ্য রোগীদের কষ্ট দিয়ে নয়। আর ডাক্তাররা যেন ৬টা বলে ৯টায় না আসেন। তাদেরও সঠিক সময় মেনে চলা উচিত। এমনিতেই কারো জন্য অপেক্ষা করা কষ্টের বিষয় আর তা যদি হয় রোগী নিয়ে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।

শাহাবুদ্দিন শুভ: প্রধান সম্পাদক, সিলেটপিডিয়া

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
রাকসু নির্বাচন ঘিরে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের ৩ দাবি
এবার বিতর্কের মুখে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা ছাড়লেন বাংলাদেশি বংশ্দোভূত রুশনারা আলী
আজ বিশ্ব বিড়াল দিবস
এবার ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিচ্ছে অস্ট্রেলিয়া
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা