করোনায় পারিবারিক সম্পর্কের উন্নয়ন

ড. মেহতাব খানম
| আপডেট : ২৯ মে ২০২০, ১৭:২৭ | প্রকাশিত : ২৯ মে ২০২০, ১৬:৩৬

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ঘরেই থাকতে হচ্ছে, আর তারই নেগেটিভ প্রতিফলন হচ্ছে বিশ্বজুড়ে দাম্পত্য কলহ, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পারস্পরিক বোঝাপড়া, সহনশীলতা- এমন আরো বিষয় নিয়ে এই সমস্যা মোকাবিলার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ড. মেহতাব খানম।

বর্তমানে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ চলছে। এর ফলে আমাদের যে মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে, সেটার প্রভাব কি দাম্পত্য জীবনের উপর প্রভাব ফেলছে? আমরা খবর পাচ্ছি সেটার প্রভাব পড়ছে। আগে থেকেই আমাদের যে সম্পর্কগুলোতে টানা পোড়েন ছিল সেগুলোতে আরও ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। এর দ্বারা পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে গেছে। সেটি যেমন বাংলাদেশেও বেড়ে গেছে। ঠিক তেমনি বাইরের দেশেও বেড়ে গেছে। আমরা সে খবর পাচ্ছি। ভারতে, ব্রিটেনে এই সহিংসতার মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে আমরা খবর পাচ্ছি। তারা এখন সহায়তা চাইলেও সেটা তারা পাচ্ছেন না।

যেমন আইনি সহায়তা বা মানসিক সহায়তা। তারা সেভাবে পাচ্ছেন না। কাজেই আমরা খুব বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে গেছি বলে বুঝতেই পারছি যে ঘরের মধ্যে যে বিবাদ হচ্ছে সেটি মিমাংসা করার সময় এখন কারো নেই। আমরা যদি চায়নার দিকে তাকাই সেখানেও দেখতে পারি। যখন সেখানে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা কমে গেল। জীবনধারাটা স্বাভাবিক হলো। তখন দেখা গেল আগের তুলনায় বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল আগের তুলনায়।

জানাগেছে শতকরা ২৫ভাগ বেড়ে গেছে। এটি অবশ্যই একটি শঙ্কিত হওয়ার বিষয়। আমরা খুব মনযোগী হয়ে খেয়াল করব। কিভাবে যে আমাদের ঘরের ভেতর যে দাম্পত্য সম্পর্ক চলছে সেটি । ঘর বন্দি অবস্থাতে যে কষ্ট পাচ্ছি। সেখানে আসলে দাম্পত্য সম্পর্কে আসলে আমরা কেমন আছি। উন্নয়ন ঘটানো আসলে সম্ভব কি না। যখন দাম্পত্য সম্পর্ক টিকে না তখন আমরা এক প্রকার ধরে নেই আমরা যখন বিয়ে করি। নিজে থেকে একটি পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হই তখন ধরে নেই যে নিজে থেকেই ভালো করে গড়াবে। কিন্তু সম্পর্ক যে অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকা উচিৎ না। সেতা খেয়াল করতে হয়, যত্ন করতে হয়। যেটা আমরা অবশ্যই খেয়াল করছি না।

আমরা বিয়ের পরে বাবা মা হয়ে যায়। তখন আর একটি ভূমিকা আমাদের পালন করতে হয়। তখন সম্পর্ক্টি আরও বেশি অযত্নে পড়ে যায়। তাই আমি বলব। আমাদের খেয়াল করতে হবে বিয়ের পর । তখন যদি খেয়াল নাও করতে পারি তবে এখন খেয়াল করতে হবে। সম্পর্কের মাঝে যে উপাদানগুলোর উপস্থিতি লাগে সেগুলো আমাদের সম্পর্কে রয়েছে কি না। বন্ধুত্ব। ভালোবাসা রয়েছে কিনা তা অবশ্যই খেয়াল করতে হবে। ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস। আমরা দুজন দুজনের প্রতি সহমর্মী হতে পারছি কি না। দুজন দুজকে মন খুলে সব কথা বলতে পারছি কি না। অর্থাৎ একজন আর একজনের মনের ভাব বুঝতে পারছি কি না সেটি কিন্তু খেয়াল করতে হবে।

তো কাজেই এই উপাদানগুলোর উপস্থিতি আছে কি না তা অবশ্যই আমাদের খেয়াল করতে হবে। সেই সঙ্গে আমি কিছু মোটাদাগে সুপারিশ রাখব। মনস্তত্ব বিজ্ঞানীরা বলেছেন- আমাদের মনের সম্পর্কগুলো যত ভালো যাবে আমাদের জীবনের সন্তুষ্টি ততো বেড়ে যাবে। জীবনে সন্তুষ্টি যখন আমাদের থাকে। তখন কিন্তু আমরা অনেক বেশি ভালো থাকি মানসিকভাবে। এইখন এই যে সংক্রমণের ফলে আমাদের যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। সেটিও কিন্তু বাড়িয়ে রাখতে হবে। বলা হয় মানসিক চাপ যত বেড়ে যায়। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ততবেশি কমে যায়। এটি আর বেশি গুরুত্ব বহন করে এই সময়ে।

আমার সুপারিশগুলো হচ্ছে-

একজন আর একজনের সঙ্গে মানে আমার সঙ্গীকে অন্য কারো সঙ্গে তুলয়া করব না। কারণ আমরা সবাই সবার মতো। সবারই কিছু না কিছু ভুল ত্রুটি রয়েছে। আমরা তুলনা করে যেন কেউ কাউকে ছোট না করে ফেলি।

আমরা খেয়াল করব একজন আর একজনকে খুব বেশি পরিবর্তন করতে চাইছি কিনা। আমি অনেক দেখেছি অনেকে বলে, ও আমার মতো চিন্তা করে না কেন? আমার মতো হয় না কেন? আসলে আমরা কেউ কারও মতো হতে পারব না। আসলে সবাই সবার মতো। কেউ কাউকে পরিবর্তন না করে আমরা চেষ্টা করব আমাদের ভেতরটা পরিবর্তন করতে। আমাদের ভেতরে আরও বেশি সৌন্দর্য নিয়ে আসতে। আরও বেশি স্বস্তি নিয়ে আসতে। যাতে করে আমরা ভালো থাকতে পারি।

আমরা চেষ্টা করব সব সময় এক জন আরেক জনকে সমালোচনা না করতে। সব সময় দোষগুলো না ধরতে। সব সময় চখে আঙ্গুল দিয়ে ধরিয়ে না দিতে। তার বদলে যদি আমরা এভাবে বলি তুমি যদি কাজটা এভাবে না করে ওভাবে করতে তাহলে মনে হয় বেশি ভালো হত। আমার খুব ভালো লাগত । আমি খুব বেশি খুশি হতাম। এইভাবে যদি কথা বলতে পারি তাহলে খুব ভালো হয়।

আর একটি কথা। আমরা এক জন আরেক জনের পরিবারকে ছোট করে ফেলি। আমাকে কেউ কেউ বলেছেন ও যখন মার পরিবারকে ছোট করে তখন আমার একদম বাঁচতে ইচ্ছে করে না। তখন জীবন থেকে সমস্ত ইচ্ছে চলে যায়। কাজেই এটি আমরা খেয়াল করব।

আমরা কখনও ভাববোনা। ও যদি আমার জীবনে না থাকতো তাহলে হয়তো জীবনে অনেক ভালো কিছু পেতাম। অনেক ভালো কাউকে পেতাম। এইযে একটা আফসোস আমরা মনের ভেতর রেখে দেই। এটা থাকলে দাম্পত্য জীবন আরো সুন্দর করার ইচ্ছে মরে যায়। এটি করা যাবে না। মন থেকে এটা দূর করতে হবে।

আর একটা বিষয়। যখন আমাদের সংসারে টানা পোড়েন হয় । তখন আমরা খেয়াল করে দেখব এই টানা পোড়েন কেন হচ্ছে? এটি কি শুধু ওর কারণে হচ্ছে। ওই কি আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছে? ওই আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। নাকি এর মাঝে আমারও কিছু অবদান আছে। সুতরাং যখন আমার অবদানের দিক খেয়াল করব। তখন আমি আমার আত্ম উন্নয়নের চেষ্টা করব। তখন আমার চিন্তাগুলোকে একটু পরিবর্তন করব। আমরা ভাবতে পারি কি কারণে আমি রেগে যাচ্ছি। আমি একটু অন্যভাবে নিতে পারি কিনা ব্যাপারটা।

অর্থাৎ ও আমাকে অনেক কটুকথা বলে দেয়। সবগুলোকি আমার ভেতর ঢোকাবো নাকি আমার নিজেকেও কিছুটা মূল্যায়ন করার প্রয়োজন আছে? আমার যদি মনে হয় সবকথাগুলো আমার জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। প্রযোজ্য না। কিছু কথা ফেলে দেই। এক্ষেত্রে নিজের যত্ন করতে থাকি। নিজের যত্ন করাটা খুব জরুরি। যখন আমরা আলাদা আলাদা করে নিজের যত্ন নেব। তাহলে কিন্তু আমরা অনেক ভালো থাকব। যখন আমি ভালো থাকব তখন আমার পাশের মানুষটিও ভালো থাকবে। ভালো রাখতে পারব। কারণ আলাদা আলাদা করে দুজন ভালো না থাকতে পারলে। আসলে একজন শুধু যত্ন করলে সম্পর্কের দানা বাঁধে না।

এখন আমরা অনেক বড় দূর্যোগের মুখোমুখি পড়েছি। ভীষণ চ্যালেঞ্জের মধ্যে গোটা বিশ্ব পড়ে গেছে। বাইরের এই দুর্যোগ থামানোর কোনো হাত আমাদের নেই। আমরা শুধু পারি আমাদের ঘরের ভেতরের দুর্যোগটা কমাতে। আমাদের মোনের দুর্যোগটা কমাতে। যাতে করে আমরা ভেতরে একটি শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি।

এছাড়া আমাদের যে সচেতন মনটি আছে। সেটিকে সক্রিয় করে আমার মধ্যে যে অবুজ মনটি রয়েছে সেটি যখন তখন রেগে যাচ্ছে। সেটিকে আলাদা ভাবে রেখে আলাদা সত্তা ভেবে আমার যে সচেতন সত্তা রয়েছে তার সঙ্গে একটি সংযোগ ঘটাতে পারি। যেন আমি নিজেকে নিজে বলতে পারি জানি এখন তোমার ভয় লাগছে। একা লাগছে। তোমার জন্য অনেক ভালোবাসা আছে আমার কাছে। আমি চাই তুমি ভালো থাক। তোমাকে আমি অত্যন্ত গুরুত্ব দিই। অত্যন্ত ভালোভাবে মূল্যায়ন করি। তুমি আমার কাছে খুব বেশি গুরুত্ব বহন কর। আমি জানি তুমি আর আমি একসাথে হলে এই যে বড় দুর্যোগ আমরা মোকাবিলা করতে পারব। যখন আমরা ঘরের ভেতরের , মনের ভেতরে দুর্যোগ কমাতে পারব তখন বাইরের দুর্যোগ কমাতেও সহায়তা করবে।

শ্রুতি লিখন: শেখ সাইফ

ঢাকাটাইমস/২৯মে/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :