করোনাকালে পিসিআর টেস্টের মান নিয়ন্ত্রণ কেন জরুরি এবং কীভাবে করবেন?

ড. মাহবুবুল হাসান সিদ্দিকী
  প্রকাশিত : ০৯ জুন ২০২০, ১৯:৫৮| আপডেট : ১০ জুন ২০২০, ১১:১৪
অ- অ+

সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে আক্রান্ত কারো ক্লিনিকাল টেস্টের ফলাফল সঠিক হওয়ার সাথে শুধু যে একজন রোগীর ভালো-মন্দ বা জীবন-মৃত্যু নির্ভর করে, তা নয়। বরং টেস্টে সঠিক ফল না আসলে ওই ব্যক্তির মাধ্যমে রোগটি একটি এলাকায়, এমনকি পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ কারনে এর সাথে পেশাদারিত্বের পাশাপাশি নৈতিকতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে জড়িত। তাই ক্লিনিকাল টেস্টের মান নিয়ন্ত্রনের ব্যাপারে কোন ধরনের শৈথিল্য প্রদর্শনের সুজোগ নেই।

অনেক সীমাবদ্ধতার মদ্ধ্যেও বাংলাদেশের ক্লিনিক্যাল ডায়াগনস্টিক সেক্টরে প্রতিনিয়তই যোগ হচ্ছে, অথবা বিস্তার লাভ করছে, বিভিন্ন নতুন টেস্ট। এর সাম্প্রতিক উদাহরন হলো RT-PCR, যা সম্ভাব্য আক্রান্ত রোগীদের দেহে করোনাভাইরাসের RNA'র উপস্থিতি নির্নয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। RT-PCR একেবারে নতুন কোন মেথড না হলেও কিছুদিন আগ পর্যন্ত রোগ সনাক্তকরণে বাংলাদেশে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে এর ব্যবহার হতো খুবই সীমিত পরিসরে। তাই করোনা মহামারির সময়টাতে এ-বিষয়ে দক্ষ জনবলের অভাব দৃশ্যমান হয়েছে, যার ফলে ভুল ডায়াগনসিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশী হয়ে থাকতে পারে।

ভুল ডায়াগনোসিস বলতে বুঝায় ফলস-পজিটিভ বা ফলস-নেগেটিভ রেজাল্ট। কোনো ডায়াগনোষ্টিক টেস্ট-ই শতকরা ১০০ ভাগ সঠিক নয়। কিন্তু একটি আদর্শ টেস্ট অন্তত শতকরা ৯৫ ভাগ সঠিক ফলাফল দেবে বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবের সময় দেশের বিভিন্ন ল্যাব থেকে ফলস-নেগেটিভ বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ রেজাল্টের খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এই লেখার বাকী অংশে আমরা আটটি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করবো যা মেনে চলতে পারলে RT-PCR টেস্টের মান নিয়ন্ত্রন করার পাশাপাশি আমাদের দেশে এ বিষয়ে গবেষনা বা বাণিজ্যিক টেস্টের জন্য দক্ষ জনবল তৈরি হবে।

১। প্রটোকলঃ RT-PCR টেস্টের জন্য সঠিক প্রটোকল বা মেথড নির্বাচন করা খুব জরূরী। উদাহরন হিসেবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া যেকোনো একটি পদ্ধতি বেছে নেওয়া যেতে পারে, কারণ এসব প্রটোকল যথেষ্ট পরীক্ষিত এবং পৃথিবীর অনেক লাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।

২। বায়োসেফটিঃ RT-PCR যদি করোনাভাইরাসের মত কোন মারাত্মক জীবানু সনাক্ত করার কাজে ব্যবহৃত হয়, তাহলে যথাযথ বায়োসেফটি লেভেলে নিশ্চিত করে নিতে হবে। করোনাভাইরাসের মত মারাত্মক রোগের জীবানু দিয়ে যেন ল্যাবরেটরিতে কেউ আক্রান্ত না হয় সেজন্য অন্য প্রস্তুতির পাশাপাশি আগে থেকেই সবার উপযুক্ত ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করে রাখতে হবে।

৩। টেস্ট মেথড ভ্যারিফিকেশনঃ যেকোন ল্যাবে RT-PCR পরীক্ষা শুরু করতে গেলে প্রথমেই টেস্ট ভ্যারিফাই করার জন্য অন্য কোন রেফারেন্স ল্যাব থেকে পজিটিভ এবং নেগেটিভ রোগীর স্যাম্পল নিয়ে এসে নিজেদের ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে প্রটোকল ঠিক ভাবে কাজ করছে কিনা।

৪। কন্টামিনেশনঃ PCR বা RT-PCR স্যাম্পলের মধ্যে এমনকি একটা ভাইরাসের RNA থাকলেই ফলস-পজিটিভ রেজাল্ট আসতে পারে। আবার স্যাম্পলে কোনো ভাবে RNAse এনজাইম মিশে গেলে রেজাল্ট ফলস-নেগেটিভ আসতে পারে। তাই এটি প্রতিরোধে কয়েকটি বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। যেমন-

  • সম্ভব হলে RNA এক্সট্রাকশন, পিসিআর সেট আপ, এবং এমপ্লিফিকেশন আলাদা আলাদা রুমে করা উচিৎ। যে রুমে যে কাজ করা হবে সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সামগ্রী আগে থেকেই আলাদা করে রাখতে হবে। খুব জরূরী না হলে এক রুমের কোন ইকুইপমেন্ট অন্য রুমে নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • প্রতিদিন কাজের আগে ও পরে সদ্য বানানো ১০% ব্লিচ সলিউশন (০.৫% সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট), এরপর ডিসটিল ওয়াটার, এবং তারপর ৭০% ইথানল দিয়ে বায়োসেফটি হুড, কাজের বেঞ্চটপ ও অন্যান্য সারফেস ডিকন্টামিনেট করে নিতে হবে।
  • পাইপেটিং করার সময় স্যাম্পল যেন কোন অবস্থাতেই না ছিটে অথবা ফেনা বা ড্রপলেট (ছোট ছোট তরল কনা) তৈরি না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। ফিল্টার লাগানো পাইপেট টিপস ব্যবহার করে এসব সমস্যা অনেকাংশেই কমানো যায়।

৫। চার ধরনের কন্ট্রোলঃ টেস্টের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি ব্যাচ PCR রান করার সময় সঠিক কন্ট্রোল স্যাম্পলের (পজিটিভ কন্ট্রোল, নেগেটিভ কন্ট্রোল, RNA এক্সট্রাকশন কন্ট্রোল (সম্ভব হলে), এবং পিসিআর ইনহিবিশন কন্ট্রোল) ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে, PCR শেষ হবার পর নিশ্চিত করতে হবে যে সবগুলো কন্ট্রোল প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করেছে। মনে রাখতে হবে, এর কোন একটি ঠিকঠাক কাজ না করার অর্থ হলো টেস্ট রেজাল্ট ভুল হবার সম্ভাবনা প্রবল। এরকম হলে সাথে সাথে ল্যাব-সুপারভাইজরকে দেখিয়ে প্রয়োজনে পুনরায় নতুন করে টেস্ট করতে হবে। স্যাম্পল কন্টামিনেশনের কারনে অনেক সময় কোন কোন ব্যাচে হঠাৎ করে অনেক বেশি স্যাম্পল পজিটিভ রেজাল্ট দিতে পারে। এমন হলে পুরো প্রক্রিয়ার প্রথম থেকে খতিয়ে দেখতে হবে সমস্যাটা কিসের কারনে (বা কোন ধাপে) হচ্ছে, যা পরবর্তী ব্যাচ পরীক্ষা করার আগে তড়িৎ ঠিক করে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

৬। ডেটা ফাইল পরীক্ষা করাঃ মেশিনে অটোমেটিক তৈরি হওয়া ডেটা ফাইলের একটা কপি রান শেষ হওয়া মাত্রই ই-মেইলের মাধ্যমে ল্যাব-সুপারভাইজরের কাছে যেন চলে আসে, সেই সেটিংসটা ঠিক করে দেয়া যায় খুব সহজেই। কোন রেজাল্ট পজিটিভ বলার আগে Run Information পরীক্ষা করে টিপিক্যাল S-আকৃতির এমপ্লিফিকেশন কার্ভ এবং CT ভ্যালু ৩৫ এর নীচে আছে এটা নিশ্চিত করে নিতে হবে। CT ভ্যালু ৩৫ এর বেশি হলে, আরেকবার পরীক্ষা করে ফলাফল নিশ্চিত করতে হবে।

৭। মেশিনের রক্ষনাবেক্ষনঃ ঘন ঘন ব্যবহার করলে PCR মেশিনের ক্যালিব্রেশন নষ্ট হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতি সপ্তাহে মেশিনের ব্যাকগ্রাউন্ড ক্যালিব্রেশন আর প্রতি ৬ মাসে একবার মেশিনের প্রিভেন্টিভ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। প্রতি মাসে এক ল্যাবের টেস্ট করা কিছু স্যাম্পল মানসম্মত অন্য ল্যাবে পাঠিয়ে যাচাই করে দেখা যেতে পারে যে টেস্ট ঠিক ভাবে কাজ করছে কিনা।

নিয়মিত ট্রেনিংঃ যেহেতু RT-PCR একটি আধুনিক এবং দ্রুত বিকাশমান পরীক্ষার প্রক্রিয়া, প্রতিনিয়তই এ বিষয়ে নতুন নতুন জ্ঞান যোগ হচ্ছে। তাই ল্যাবরেটরিতে যারা এই টেস্টে সম্পন্য করা বা মান নিয়ন্ত্রনের সাথে জড়িত, তাদের জন্য নিয়মিত (অন্তত প্রতি ছয় মাসে একবার) ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ট্রেনিং-এর জন্য RT-PCR মেশিন বা টেস্ট রিএজেন্টের যেসব লোকাল ডিস্ট্রিবিউটর রয়েছে, তাদের সাথে প্রয়োজনে আগে থেকেই চুক্তি করে রাখা যেতে পারে।

উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, RT-PCR পরীক্ষার প্রতিটি ধাপেই কঠোর মান নিয়ন্ত্রনের বিষয় জড়িত। মনে রাখতে হবে, এর যেকোন একটি ধাপে সমস্যা হওয়া মানেই ফলাফল হয় ফলস-পজিটিভ বা ফলস-নেগেটিভ আসা। এ-ধরনের ভুল ফলাফলের পরিণতি বিবেচনায়, RT-PCR-এর পুরো প্রক্রিয়ায় কোন ধরনের শৈথিল্য প্রদর্শন অপেশাদারি এবং অনৈতিক হবে। যেকোন বিষয়েই মান নিয়ন্ত্রন একটি জটিল, কষ্টসাধ্য, ব্যয়সাধ্য, এবং চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু এরকম ব্যয়বহুল এবং জরূরী একটি টেস্টের গুরুত্ব বিবেচনায় নিলে, এই মান নিয়ন্ত্রনের কোন বিকল্প নেই। আর এটি নিশ্চিত করতে পারলে, অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা শুধু RT-PCR না, বরং সব ধরনের মলিকুলার ডায়াগনোস্টিক টেস্টের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা যাবে। ধন্যবাদ।

. মাহবুবুল হাসান সিদ্দিকী, পিএইচডি

অণুজীববিজ্ঞানী এবং জনস্বাস্থ্য গবেষক

কো-অর্ডিনেটর, মাইক্রোবায়োলজি প্রোগ্রাম

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

Email: [email protected]

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় শীর্ষে ঢাকা, বায়ুমান কেমন রাজধানীর?
দেশের সাত অঞ্চলে সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ের আভাস
জোটভুক্ত হয়ে যে কুমির ডেকে আনছেন তা আপনাদেরই খাবে: আসিফ মাহমুদ
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৮৫, ‘অনাহারজনিত মৃত্যু’ দাঁড়াল ২৯ জনে
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা