মাস্কের ভুল ব্যবহারে বাড়বে স্বাস্থ্যঝুঁকি

ড. মাহবুবুল হাসান সিদ্দিকী
| আপডেট : ১৩ জুন ২০২০, ২১:০২ | প্রকাশিত : ১৩ জুন ২০২০, ২০:৩০

মাস্ক পরে থাকলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাস্তবে কতখানি কমে, এ বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক অনেক পুরনো। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং আমেরিকার জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময় কর্তৃপক্ষ (CDC) কিছুদিন আগ পর্যন্ত এ নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে ছিল। শুধু তাই না, এই সংস্থাগুলোর কর্তাব্যক্তিরা অনেক সময় নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধে জড়িয়ে খবরের শিরোনাম হয়েছেন।

এ কারণে বিশ্বের অনেক দেশেই মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা নিয়ে বেশ কিছুদিন ভীষণ টানাপোড়ন চলছে। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

অবশেষে চলতি মাসের প্রথম কার্যদিবসে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জারি করা এক নির্দেশে জনসাধারণের জন্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অন্যথায়, ছয় মাসের জেল বা এক মাসের কারাদণ্ডের বিধান আছে। তাই মাস্ক পরার বিকল্প খোলা নেই। কিন্তু এ বিষয়ে কৌতূহল জাগা স্বাভাবিক যে, মাস্ক পরা যদি এতই কার্যকরী হবে তাহলে বিশ্বের বড় বড় সংস্থাগুলোকে এই সিদ্ধান্তে আসতে এত কাঠখড় পোড়াতে হলো কেন? এ প্রশ্নের উত্তর যদিও একটু লম্বা। তবুও এ সংক্রান্ত আলোচনা জনস্বাস্থ্যের জন্য এই মুহূর্তে খুবই জরুরি।

প্রথমেই বিবেচনায় আসবে, মাস্ক পরলে যে করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা পাওয়া যাবে এর সপক্ষে যতগুলো গবেষণালব্ধ প্রমাণ আছে সেগুলো। তবে এসব গবেষণার বেশিরভাগই হসপিটালে স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর করা হয়েছে। আর স্বাস্থ্যকর্মী মানেই হলো তারা ওই পরিবেশে কাজ করার ব্যাপারে, বিশেষত মাস্ক বা এই জাতীয় ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ (PPE) কীভাবে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে, সে ব্যাপারে ট্রেনিংপ্রাপ্ত।

আর অসুস্থ রোগী থাকার কারণে হাসপাতালে যে পরিমাণ জীবাণু থাকে সে বিবেচনায় মাস্কের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ PPE ব্যবহার করলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমবে। এটা সাধারণ জ্ঞান থেকেই বোঝা যায়। কিন্ত ঘরের বাইরে যেমন- হাসপাতাল না, সাধারণ মানুষেরও তেমনি একজন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর মতো মাস্ক ব্যবহারের সব নিয়ম কানুন জানা থাকবে না। তাই, হাসপাতালের পরিবেশে করা গবেষণার ফলাফল দিয়ে সর্বসাধারণের জন্য কোনো আইন প্রণয়ন করা কিছু ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ফল নাও দিতে পারে। এমনকি হিতে বিপরীতও হতে পারে। কেমন?

এরপর বিবেচনায় আসবে আমাদের আপামর জনসাধারণ, বিশেষ করে প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠী মাস্ক পরার সঠিক নিয়ম কানুন জানেন কি না। অন্যথায় মাস্ক পরার পরে বারে বারে মাস্ক ঠিক করার জন্য বা অস্বস্তির কারণে মুখ চুলকানির জন্য একটু পরে পরে মুখে হাত দেয়ার কারণে নিজেকে সংক্রমিত করার ঝুঁকি বেড়ে যাবে উল্টো।

তারপর আসা যাক সঠিক নিয়মে মাস্ক পরা এবং খোলার নিয়মকানুন পালন করা নিয়ে। যা কি না স্বাস্থ্যকর্মীদের পক্ষেই সবসময় সঠিকভাবে পালন করা কঠিন। তা নিয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে না পারলে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করার কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া কঠিন হবে।

পৃথিবীজুড়ে একথা বহুল চর্চিত যে, মাস্ক পরে থাকা মানুষের মনে নিজেদের সুরক্ষার ব্যাপারে এক ধরনের মিথ্যা আত্মবিশ্বাস তৈরি করে। এ কারণে উল্টো সবসময় হাত পরিষ্কার (জীবাণুমুক্ত) রাখার ব্যাপারে মানুষ বরং উদাসীন হয়ে যায়। পরে সে হাত দিয়ে আবার নিজের নাক মুখ থেকে শুরু করে অন্য সব জিনিস স্পর্শ করার কারণে উল্টো আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।

তার সঙ্গে মাস্কের পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সাধারণ জনগণের স্পষ্ট ধারণা না থাকা খুবই স্বাভাবিক। একটা মাস্ক কতসময় পড়ে থাকা যাবে, কখন কীভাবে এটি পরিষ্কার করা যাবে। বা আদৌ পরিষ্কার করা যাবে কি না এসব বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি না হলে ব্যবহার করা মাস্কগুলোতে উল্টো করোনাভাইরাসসহ অন্যান্য রোগজীবাণু বাসা বাঁধতে পারে। ব্যবহারকারীর জন্য এটি বরং একটি বাড়তি স্বাস্থ্য-ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

উপরন্তু মাস্ক ব্যবহার করার কারণে অনেক সময়, বিশেষ করে যখন পরিশ্রমের কাজ করা হয় তখন শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যাহত হতে পারে। এর ফলে কারো কারো ক্ষেত্রে (যেমন রিকশা চালক বা শ্রমিক) হাইপক্সিয়া (রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি) বা হাইপারকার্বিয়া (রক্তে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আধিক্য) দেখা দিতে পারে। এটি মাস্ক ব্যবহারকারীর জন্য স্বল্পমেয়াদে এবং দীর্ঘমেয়াদে এক ধরণের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

তার উপর আবার কারো কারো ক্ষেত্রে আগে থেকেই বিদ্যমান অসুখ (কো-মরবিডিটি) থাকতে পারে। এদের মধ্যে বিশেষ করে যাদের এ্যাজমা (শ্বাস-কষ্ট), কয়েক ধরনের অটো ইমিউন এলার্জিক ডিজিজ, ক্যান্সার আছে তাদের জন্য মাস্ক পরে থাকা বিপদের কারণে হতে পারে। এখানেই শেষ নয়।

ছোট শিশু, বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী, শারীরিক প্রতিবন্ধী এমন যারা নিজে নিজে মাস্ক পরতে বা খুলতে অক্ষম তাদের জন্য মাস্ক পরে থাকতে যাওয়া মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। এ ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।

সর্বোপরি মাস্কের ভুল ব্যবহার করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর বদলে তা বা বাড়িয়ে দিতে, এমনকি মৃত্যুসহ অন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাহলে কী মাস্ক পরা বন্ধ করে দিতে হবে? না। মোটেই তা নয়।

বরং, এ সংক্রান্ত আলোচনা বেশি করে হওয়া দরকার যাতে করে সবাই মাস্কের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হয়। উপরে উল্লেখ করা যেসব ভুলের কারণে বিপদ হতে পারে, সেগুলো যদি এড়িয়ে চলা যায় স্বাস্থ্য-ঝুঁকি কমে আসবে অনেকখানি। চলুন সবাই সচেতনতার মাধ্যমে করোনাভাইরাসকে পরাজিত করে দিই। ভালো থাকো বাংলাদেশ।

লেখক: অণুজীববিজ্ঞানী এবং জনস্বাস্থ্য গবেষক , কো-অর্ডিনেটর, মাইক্রোবায়োলজি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :