থ্যালাসেমিয়ার প্রতিরোধ জরুরি

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
  প্রকাশিত : ০৮ মে ২০২১, ১১:৩৪| আপডেট : ০৮ মে ২০২১, ২১:৪৭
অ- অ+

থ্যালাসেমিয়ার মতো মরণব্যাধি সম্পর্কে সচেতণতা গড়ে তুলতেই প্রতিবছর ৮ মে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। থ্যালাসেমিয়া এক ধরনের বংশগত রক্ত স্বল্পতার রোগ। এ রোগে আমাদের রক্তের ভেতরে যে লোহিত কনিকা তা ভেঙে যায়। রক্তে লোহিত কনিকার ভেতরে থাকে হিমোগ্লোবিন। এই হিমোগ্লোবিন আয়রন এবং গ্লোবিন প্রোটিন দ্বারা গঠিত।

আমাদের যেটা প্রধান গ্লোবিন সেটা গ্লোবিনের দুই জোড়া চেইন দ্বারা গঠিত-আলফা এবং বিটা (α২ β২)। থ্যালাসেমিয়ায় যে সমস্যাটা হয় তা হলো এই দুই জোড়া গ্লোবিনের যে কোনো এক জোড়ার তৈরি হওয়া কমে যায়। যাকে আমরা আলফা থ্যালাসেমিয়া এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া বলি। উভয়েরই কারণ জেনেটিক মিউটেশন। মিউটেশনের মানে হলো জিনের ভেতরে স্বাভাবিকের বাইরে কোনো প্রোটিন তৈরি হওয়া। এটা বিভিন্ন কারণে হয়। আমাদের পৃথিবীতে প্রাণের সৃস্টির পরে কোটি কোটি বছর ধরে এই মিউটেশন হয়ে আসছে। অনেক বড় বড় প্রাণী প্রজাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। এমনও শোনা যায় ভূমিকম্পের কারণেও মিউটেশন ঘটে। কারণ যাই হোক মিউটেশনের ফলে গ্লোবিন চেইনের তৈরি হওয়া কমে যায়। ব্যাপার হলো একজোরা চেইনের তৈরী হওয়া যখন কমে যায় তখন সাথের অন্য জোরার তৈরী হওয়া বেড়ে যায়। বেড়ে যাওয়া গ্লোবিন Precipitation হয় যার ফলে লোহিত কনিকাটি ভেঙে যায়। আবার তার মধ্যে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণও কমে যায়। যার ফলে হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা কমে যায়। আমাদের দেশে প্রধানত দুই ধরনের থ্যালাসেমিয়া দেখা যায় যাদের ক্ষেত্রে সাধারণত: রক্ত পরিসঞ্চালন দরকার হয় ((Transfusion dependent thalassaemia))। এর বাইরেও হরেক রকম থ্যালাসেমিয়া আছে। যাদের অধিকাংশেরই নিয়মিত রক্ত লাগে না। আমাদের দেশে β -thalassaemia major এবং HB-E, β thalassaemia এর অধিকাংশ রোগী। যাদের নিজের রক্ত শরীরের খুব একটা কাজে লাগে না বরং ক্ষতি করে। অন্যের দেয়া রক্তে তাদের বেঁচে থাকতে হয়।

বংশানুক্রমের ব্যাপার হলো বাবা, মা দুই জনেই যদি বাহক হয় তা হলে কিছু সন্তান সুস্থ হবে আবার কিছু সন্তান রোগী অথবা বাহক হবে। বাবা, মা দুই জনেই যদি রোগী হয় তা হলে সুস্থ বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার যদি মা বাবার একজন রোগী হয় অন্য জন সুস্থ হয় তা হলে কিছু সন্তান বাহক হবে, কিন্তু সুস্থ্য হবে। তার মানে হলো রোগটি মা বাবার থেকেই বাচ্চার মধ্যে সঞ্চালিত (Inherited) হয়। তাই যদি বিবাহ করার পূর্বে রক্তের পরীক্ষা করে নেওয়া যায় যে পাত্র বা পাত্রী কেউই বাহক বা রোগী নয় তা হলে রোগটি সঞ্চালিত হতে পারবে না। এটা বাচ্চা মায়ের পেটে আসার পরেও নির্নয় করা যায় যা ব্যয় সাপেক্ষ। যদি দেখা যায় মায়ের পেটের বাচ্চা আক্রান্ত হয়েছে তা হলে Pregnancy terminate ও করা যায়। তবে যদি সমাজের সমস্ত লোকের এক/একাধিক Screening test করা যায় তা হলেও বাহক বা রোগী সনাক্ত করা যায়। এক্ষেত্রে সামাজিক বা সরকারী উদ্যোগ দরকার। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে একই বংশের ভাই বোনের মধ্যে বিভিন্ন কারনে বিবাহের প্রচলন আছে। এটা থ্যালাসেমিয়া বিস্তারের কারন। সেক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সামজিক সচেতনতা তৈরী করতে পারলে বিস্তারের ব্যপকতা কমানো সম্ভব। প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজে রোগী অথবা বাহকের সংখ্যা বাড়ছে। যার চিত্র খুব ভয়াবহ। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা আছে। সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা হলো রোগীদের চিকিৎসা, পরামর্শ ইত্যাদি। আর বেসরকারী স্বেচ্ছা সংগঠনগুলির ভূমিকা হওয়া উচিত মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরী করা যাতে রোগটির বিস্তার রোধ করা যায়। রক্ত সংগ্রহের ব্যাপারেও তাদের ভূমিকা থাকতে পারে-যেমন মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করা। রক্ত সংগ্রহের কাজটি তাদের না করাই ভালো কারন রক্ত দানের কতকগুলো নিয়ম কানুন আছে, পরীক্ষা নীরিক্ষা আছে যা স্পেশালিষ্টদের কাজ। চিকিৎসার ক্ষেত্রে রক্ত দেওয়া ছাড়াও জমে যাওয়া আয়রন শরীরের ভিতর থেকে বের করতে হয়। না হলে থ্যালাসেমিয়ায় রোগীরা ৩০/৪০ বছরের বেশী বাচেঁ না। এ ব্যাপারে স্বেচ্ছা সংগঠনগুলি উদ্যোগ নিতে পারে। সরকারকে পরামর্শ দিতে পারে।

থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের শরীরের রক্তের মূল্যবান উপাদান হিমোগেøাবিন ঠিকমতো তৈরী হয় না। ফলে শিশুর স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে শরীরের দরকারী অঙ্গ যেমন- প্লীহা, যকৃত বড় হয়ে যায় এবং কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। মুখমন্ডলের হাড়ের অস্থিমজ্জা বিকৃত হওয়ার কারনে শিশুর চেহার বিশেষ রুপ ধারণ করে।

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের অন্যের রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। বার বার রক্ত নেবার একটি বিপজ্জনক পাশর্^প্রতিক্রিয়া হলো বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে অতিরিক্ত লৌহ জমে যাওয়া। এর ফলে যকৃত বিকল হয়ে রোগী মারাও যেতে পারে। এ ধরনের জটিলতা প্রতিরোধে আয়রন চিলেশন থেরাপী দেওয়া হয় অতিরিক্ত লৌহ বের করে দেবার জন্য। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়ার একটি কার্যকরী চিকিৎসা যা অত্যান্ত ব্যয়বহুল। তবে এর চিকিৎসা সবসময় সফল নাও হতে পারে। এছাড়া জিন থেরাপী এবং স্টেম সেল থেরাপিও থ্যালাসেমিয়ার একটি কার্যকরী চিকিৎসা।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার হলো প্রতিরোধ। এ ব্যাপারে আমাদের সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। না হলে হয়তো ভবিষ্যতে কোন একদিন দেখা যাবে বাংলাদেশের সমস্ত লোক থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক বা রোগী। তখন চিত্রটি কেমন হবে? সেই পরিস্থিতি যাতে আমাদের সম্মুখীন হতে না হয় তাই আমাদের করণীয়।

থ্যালাসেমিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। এ রোগের দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে নিরুৎসাহিত এবং প্রতিহত করার মাধ্যমে সমাজে নতুন থ্যালাসেমিয়া শিশুর জন্ম হ্রাস করা যায়। সুতরাং আর দেরী না করে আজই থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় এর জন্য হিমোগেøাবিন ইলেকট্রোফোরেসিস নামক পরীক্ষাটি করান এবং আপনার শিশুকে এর অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখুন।

এছাড়া ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অর্থাৎ যেসব পরিবারে স্বামী বা স্ত্রী দুজনই এ রোগের বাহক তারা গর্ভস্থ ভ্রæণ পরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্য থ্যালসেমিয়া শিশু নির্ণয় এবং তা পরিহার করতে পারেন। গর্ভাবস্থার ১৬ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষাটি করালে ভালো হয়।

প্রতিরোধের ক্ষেত্রে National ID তৈরীর সময় লোকের রক্তে হিমোগেøাবিন ইলেকট্রোফোরেসিস পরীক্ষা করা যায়। স্কুলে ভর্তির সময় বাচ্চাদের এবং বাবা মায়ের পরীক্ষা করা যায় এবং রেকর্ড নথীভূক্ত করা যায়। অনেক রকম Screening test আছে। প্রাথমিক কর্তব্য হলো একটি Screening test ঠিক করা এবং সে পথে আগানো। বসে থেকে কাল ক্ষেপন হবে ভয়াবহ আত্মহনন। প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান- যেমন মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা যেখানে মানুষ স্বাভাবিক ভাবে সমবেত হয় সে গুলোকেও কাজে লাগানো যায়। যেমন আত্মীয় স্বজনের মধ্যে বিবাহ বন্ধ করা। এই সব ব্যবস্থা যদি আমরা নিতে পারি তাহলে হয়তো থ্যালাসেমিয়ার বিস্তার থেকে আমরা রেহাই পাব।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
গোপালগঞ্জে সমাবেশ শেষে এনসিপির পদযাত্রায় হামলা, পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নিলেন নেতারা
বাংলামোটরে এনসিপি কার্যালয়ের সামনে ককটেল নিক্ষেপ
গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশস্থলে ছাত্রলীগের হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ
মিটফোর্ডে সোহাগ হত্যা: মামলার এজাহার থেকে পাঁচজনের নাম বাদ দেয় কে? জানালেন ডিএমপি কমিশনার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা