সেই সময় এই সময়

আরিফুর রহমান দোলন
| আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০২১, ২০:৪৩ | প্রকাশিত : ০৯ আগস্ট ২০২১, ১৯:০৪

২০০০ সালের ডিসেম্বর মাস। আমি ‘প্রথম আলো’র একজন সংবাদকর্মী, স্টাফ রিপোর্টার। কলকাতা বিমানবন্দরে ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের সঙ্গে দেখা। আমাকে উনি চেনেন না। পরিচয় দিলাম। বললেন, তিনি বাংলা পড়তে পারেন না। তবে কিছুদিন ধরে ‘প্রথম আলো’র লক্ষ্মীপুর নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কিছু প্রতিবেদনের কথা ঘনিষ্ঠজনদের মুখে খুব শুনেছেন। এমনকি সম্পাদক মতিউর রহমানও নাকি তাঁকে বলেছেন, ওই ঘটনায় ‘প্রথম আলো’র সার্কুলেশন বেড়েছে। পত্রিকার সুনামও হয়েছে খুব। ধীর-স্থির লতিফুর রহমান বললেন, ‘ওয়েলডান ইয়াংম্যান। এভাবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’ বললেন, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার ভিসা নিতে নতুন দিল্লি যাবেন। কলকাতায় কিছু কাজও আছে। আমরা বিদায় নিলাম।

২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ‘প্রথম আলো’র প্রথম পাতায় ‘ভয়াবহ আতঙ্কের শহর লক্ষ্মীপুর’ শিরোনামে লিড নিউজটি আমার সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারেরই মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল বলা যায়। তৎকালীন পৌর মেয়র আবু তাহের ও তার বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতন চরমে পৌঁছেছিল। সাবেক পিপি নুরুল ইসলাম অপহৃত হওয়ার পর জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চেহারাটি প্রকাশ্যে উন্মোচিত হয় গণমাধ্যমে। এবং এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা ছিল ‘প্রথম আলো’র। ঢাকা থেকে আমি ও চট্টগ্রাম থেকে একরামুল হক বুলবুল গিয়েছিলাম লক্ষ্মীপুরে। গণমাধ্যমের জন্য লক্ষ্মীপুরের তখনকার পরিবেশ মোটেও সহায়ক ছিল না। সর্বত্রই আবু তাহেরের লোকজন। শহরে নতুন লোক এলে তাকে অনুসরণ করে তারা। মিডিয়াকর্মী হলে তো কথাই নেই। পুরোদস্তুর নজরদারিতে। তাহের ও তার বাহিনীর নেতিবাচক কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কোনো খবর হওয়া চলবে না- রীতিমতো এই ফরমানও স্থানীয় সংবাদকর্মীদের দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে, বিশেষত ঢাকা থেকে আগতদের সাথে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কেউই কথা বলতে চান না। খবর সংগ্রহ করা রীতিমতো দুরূহ এক ব্যাপার ওই সময়। কী করা যায়! মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে নানা রকম বুদ্ধি। সহকর্মী একরামুল হক বুলবুলকে বলি, আমি যা করব কোনো প্রশ্ন করবেন না। আমাকে অনুসরণ করবেন শুধু। বিনা বাক্য ব্যয়ে একরামুল হক বুলবুলও সেটি মেনে নিলেন।

ঠিক করলাম, তাহেরের আস্থা অর্জন করতে হবে। যদি শহরে ও শহরতলীতে অবাধে ঘোরাফেরা করতে হয় তাহলে আপাতত তাহেরের রোষানলে পড়া চলবে না। পৌর ভবনে দেখা করলাম তাহেরের সঙ্গে। তার সাংগঠনিক দক্ষতার প্রশংসা করলাম আমরা। জনপ্রিয়তা যে আকাশচুম্বী এটা নিজেই বললেন। আমরা সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। বিস্মিত হলাম যে কেন তাকে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। বললেন, ‘আপনারা পত্রিকার পাতায় তুলে ধরেন এসব। কেন্দ্রীয় নেতারা জানুক সব।’ বললাম লিখব, ছবি দেন। অফিস সহকারীকে হুকুম দিলেন ছবি দেওয়ার। মুহূর্তেই হাজির। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করতে বললেন। রাজিও হলাম। শুধু শহর ঘুরে দেখার অনুমতি চাইলাম। কাজ হলো। তখনো তাহের বোঝেননি যে পরবর্তী সময়ে কী অপেক্ষা করছে।

প্রকৃত তথ্য জানা যাবে এমন কিছু ব্যক্তির নাম-ঠিকানা আগেই ছিল আমাদের কাছে। প্রবীণ একজন আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করলাম, যিনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির একেবারে প্রথম কাতারের নেতা। নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন এবং জানালেন কীভাবে লক্ষ্মীপুরের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। কীভাবে প্রশাসনযন্ত্রও প্রকারান্তরে সহায়তা করছে তাহের বাহিনীকে। আরও কয়েকজন আইনজীবীর নাম-ঠিকানা দিয়ে বললেন, ‘সবার সাথে কথা বলেন। অনেক কিছু জানতে পারবেন।’ মধ্যবয়স্ক একজন আইনজীবী আমাদের নানা তথ্য দিলেন। সরকারি দলের একজন মাঝারি সারির নেতা, যিনি এখন জনপ্রতিনিধিও বটে- চরম হতাশা প্রকাশ করলেন। দিলেন সুনির্দিষ্ট কিছু অনিয়ম, নির্যাতন, চাঁদাবাজির উদাহরণ।

এভাবে তাহের বাহিনীর একের পর এক অপকর্মের তথ্য আমরা পেয়ে যাচ্ছি। ভেতরে ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনাও কাজ করছে। যেসব তথ্য পাচ্ছি তাতে সংবাদ লেখার উপাদান অনেক। কিন্তু প্রশাসনের বক্তব্য তো নিতে হবে। পুলিশ সুপার ইরফান আলী সব বিষয়েই নির্লিপ্ত এমন অভিযোগ বিভিন্ন পক্ষের। তাঁর কাছে গেলাম। ঠান্ডা মানুষ বলেই মনে হলো। কম কথা বলেন। জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর মুখ দিয়ে প্রয়োজনীয় কথা বের করা অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। চায়ের অর্ডার দিলেন। সাথে বিস্কুটও দিতে বললেন। নুরুল ইসলাম অপহরণ নিয়ে পুলিশ কী করছে? পুলিশ সুপারের উত্তর: পুলিশ তার কাজ করছে। সে তো নিশ্চয়ই। কিন্তু অপহৃতকে কি উদ্ধার করা গেল? আবারও এক কথার উত্তর: খুব শিগগিরই।

তবে আমাদের কাছে খবর, অপহরণের পরেই নুরুল ইসলামকে হত্যা করা হয়েছে। লাশও মেঘনায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ সুপারকে কোনো কিছু আর প্রশ্ন করিনি। শুধু বললাম, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট?’ নিরুত্তর ইরফান আলী মৃদু হাসলেন। যা বোঝার আমরা বুঝে গেলাম। ইতোমধ্যে যেসব তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে এসেছে, তাতে অনায়াসেই ভালো খবর, বড় খবর দাঁড়িয়ে যায়।

কোথায় থাকব জানি না। কোথায় বসে লিখব তা-ও জানি না। আর যা-ই লিখি শহরে একটিমাত্র যে ফ্যাক্সের দোকান, সেখান থেকে ফ্যাক্স করে ঢাকা অফিসে খবর পাঠানো দুঃসাধ্য। সারাক্ষণ সেখানে পাহারায় থাকে তাহের বাহিনী। মোবাইল ফোনের সীমিত ব্যবহার তখন। আমাদের কারো কাছেই তা নেই। লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম ভয়ে আমাদের সাথে দেখা করেননি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। কী করব? কতক্ষণই বা আটকে রাখব পুলিশ সুপারকে। মাথায় বুদ্ধি এল। পুলিশ সুপার ইরফান আলী বিসিএস ’৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তা। একই ব্যাচের প্রভাবশালী পুলিশ সুপার মালিক খসরু পিপিএম-এর পরিচয় দিলাম। একই উপজেলায় ও কাছাকাছি বাড়ি হওয়ার সূত্রে আমরা যাকে চাচা বলে ডাকি। চৌকোস মালিক খসরু দক্ষ ও মেধাবী হিসেবে বাহিনীতে তখন অনেকেরই আস্থার প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে অনেকেরই সমীহের পাত্র মালিক খসরু তখন নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার। এই পরিচয় জানার পর লক্ষ্মীপুর পুলিশ সুপারের আন্তরিকতা বাড়ল। অনুমতি চাইলাম যে মালিক খসরুর সুবাদে আমি তাঁকে আঙ্কেল ডাকতে পারি কি না। আপত্তি করলেন না। বললাম, ‘আঙ্কেল, একটা ফেভার চাই। আপনার ফ্যাক্স ব্যবহার করা যাবে?’ কলিং বেল চাপলেন। দায়িত্বরত কনস্টেবল ও স্টেনোগ্রাফারকে বলে দিলেন, ‘ওনারা ফ্যাক্স করবেন। যত কপি খুশি। সব রকম সাহায্য যেন করে।’ পুলিশ সুপার সব ব্যবস্থা করে বাসায় গেলেন।

একরামুল হক বুলবুলকে প্রথমে পাশে বসিয়ে লিখতে বসে গেলাম। পরে তাকে বললাম গল্প-গুজব করে যেন কনস্টেবল আর স্টেনোগ্রাফারকে একটু মাতিয়ে রাখে। আমি লেখা শেষ হলেই ডাকব। হাত খুলে লিখলাম। সম্ভবত ছয় পাতা। ফ্যাক্স লাইন পাওয়া নিয়ে মহা বিড়ম্বনা। কখনো লাইন ব্যস্ত, আবার কখনো লাইন পেতে পেতে কেটে যাচ্ছে। পুলিশ সুপার অফিসের লোকজন কিঞ্চিত বিরক্ত হচ্ছে, মুখচ্ছবি অন্তত তাই বলে। জানিয়ে দিলাম বখশিসের ব্যবস্থা আছে। উৎসাহ পেল তারা। অবশেষে ঘণ্টাখানেক চেষ্টার পর কাক্সিক্ষত লাইন পাওয়া গেল। বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, নগর সম্পাদক সানাউল্লাহ লাবলু ভাই নিশ্চিত করলেন যে কপি পাওয়া গেছে।

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। সঙ্গী একরামুল হক বুলবুল নোয়াখালী অঞ্চলেরই ছেলে। তাঁকে বললাম, এই রিপোর্ট ছাপা হওয়ার পরে তো আমাদের খোঁজাখুজি শুরু হয়ে যাবে। আমরা থাকব কোথায়? ইতিউতি তাকিয়ে কোনো যুতসই জবাব দিতে পারলেন না। বললাম, এক কাজ করি ফেনী থাকার ব্যবস্থা করার জন্য প্রতিনিধি আবু তাহেরকে ফোন করি। প্রস্তাব পছন্দ হলো সহকর্মী বুলবুলের। পুলিশ সুপারের অফিসের ফোনে মেলালাম ফেনীর তাহের ভাইকে। তিনি বললেন, তাড়াতাড়ি রওনা দেন। পরে আর বাসও পাবেন না। হঠাৎ বুলবুল বললেন, তিনি থেকে যেতে চান। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে পরের দিন ফিরবেন। আমার পছন্দ হলো প্রস্তাবটি।

ওই সময় লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন মাহবুব আলম। প্রশাসনের ’৭৩ ব্যাচের কর্মকর্তা। মুক্তিযোদ্ধা। ভালো মানুষ হিসেবে পরবর্তী সময়ে মাহবুব ভাইকে নানাভাবে পেয়েছি। লক্ষ্মীপুরের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসানের জন্য একরকম মুখিয়েই ছিলেন মাহবুব ভাই। চাচ্ছিলেন, স্বাভাবিক অবস্থা ফিরুক। তাহের বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ন বন্ধ হোক। কিন্তু শক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নিতে পারছিলেন না। খানিকটা সিদ্ধান্তহীনতা, খানিকটা চাকরির ভীতি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে খুব চাইছেন, একটা বিহিত হোক। তাঁর কাছেই আমরা জানতে পারি কীভাবে অপহৃত হওয়ার পরে টুকরো টুকরো করে মেঘনা নদীতে নুরুল ইসলামের লাশ ফেলে দেওয়া হয়। আবু তাহের তখন ঢাকায়। এসব দুর্বৃত্তপনার নেতৃত্ব দেন তাহেরপুত্র বিপ্লব। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারকে বিপ্লব কথা দিয়েছিল আইনজীবী নুরুল ইসলামকে ফেরত দেবে তারা। কিন্তু কথা রাখেনি। জেলা প্রশাসক সব জানান আমাদের। কথা বলতে বলতে তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। জেলা প্রশাসকের মুখে সব শুনে আমরা বিস্মিত হই। প্রশাসন সব জানে! সব খবর আছে তবু কিছু হচ্ছে না! তবে প্রশাসনের কাছ থেকে নিশ্চিত এসব খবর পেয়ে আমাদের অনেক সুবিধা হয়। বাকিটা কেবল ঘুরে ঘুরে দেখা আর ভুক্তভোগীদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শোনা।

ফেনীর তাহের ভাই আমার থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন স্বাস্থ্য বিভাগের আধা পরিত্যক্ত একটি ভবনে। ফেনীতেও তখন সংবাদকর্মীদের চোখে চোখে রাখা হয়- সর্বত্রই জয়নাল হাজারীর ক্যাডারদের দাপট। কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক নেতা তাহের ভাই অসাধারণ ভালো মানুষ। প্রবীণ তাহের ভাইয়ের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নাতীত। তাহের ভাইয়ের সাথে লক্ষ্মীপুরের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললাম। সব জেনে বললেন, ‘আপনি একা একা ফেনী থেকে আবার লক্ষ্মীপুর যাবেন, ঠিক হবে না। সঙ্গে আমরাও যাব।’ পরদিন তাহের ভাই, বখতিয়ার ইসলাম মুন্না, ইউএনবির প্রতিনিধি টিপু সুলতানসহ আরো কয়েকজন সাংবাদিক নিয়ে আমরা লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলাম। আগের দিন ফ্যাক্সযোগে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলাম ঢাকায়, পরের দিন সেটি ছাপা হয়নি। ফোনে যেটি জানলাম- দুই কারণ। এক. রিপোর্ট একটু দেরিতে গেছে। দুই. এটা খুব ভালোভাবে প্রকাশের জন্য একটা দিন দেরি করতে বলেছেন সম্পাদক। ছাপা হওয়ার আগেই নাকি রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে অফিসে।

যা হোক, এক দিন বিরতি দিয়ে ২০০০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ‘প্রথম আলো’র প্রথম পাতায় প্রকাশ হয় ‘ভয়াবহ আতঙ্কের শহর লক্ষ্মীপুর’। এটি ছিল লিড নিউজ। চারদিকে ব্যাপক সাড়া পড়ে। এত দিন কেউই মুখ খুলছিল না। পারছিল না-ও বলা যায়। ‘প্রথম আলো’র একটি খবর সব বাধা ভেঙে দিল মনে হয়। খোদ সদর আসনের সাংসদ অ্যাডভোকেট খায়রুল এনাম স্বেচ্ছায় এলাকাছাড়া হয়ে ছিলেন। অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী তখন বিরোধীদলীয় উপনেতা। ‘প্রথম আলো’তে খবর প্রকাশের কয়েক দিনের মাথায় তাঁর নেতৃত্বে ৪০ জনের বেশি সাংসদ এলেন লক্ষ্মীপুরে। তখন হাতেগোনা টেলিভিশন, বিটিভি, একুশে টিভি, এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই। যেসব নেতা লক্ষ্মীপুর আসার কথা চিন্তাও করতেন না, টেলিভিশন ক্যামেরা দেখার পর ছবি তোলার প্রতিযোগিতা শুরু হলো রীতিমতো তাদের মধ্যে। এখন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মর্যাদার এক নেতা তো বাংলাদেশ টেলিভিশনে তার ছবি ঠিকমতো উঠছে না আমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় এই কারণে ধাক্কা দিয়ে আমায় ফেলেই দিলেন। আমি তো হতভম্ব। ‘প্রথমে আলো’তে আমার পাঠানো রিপোর্ট প্রকাশ না হলে, সারা দেশে আলোচনার ঝড় না তুললে যেসব নেতা আসতেই পারতেন না, সেই পরিস্থিতিই তৈরি হতো না, সেই আমাকেই কিনা মাটিতে পড়তে হলো ধাক্কা খেয়ে! দুবার সাংসদ হয়েছেন এমন এক তরুণ নেতা লক্ষ্মীপুর সার্কিট হাউজের সামনের প্রধান সড়কে আমাকে মাটি থেকে তুলে ওঠালেন। ওই নেতাকে মৃদু ভর্ৎসনা করলেন। বললেনও, ‘লক্ষ্মীপুর তো আসতেই পারতেন না। যার কারণে আজ আসার পরিস্থিতি তাকে হেনস্তা করলেন! কাজটা ভালো হলো না।’ ওই নেতা পরে দুঃখ প্রকাশও করলেন।

লক্ষ্মীপুর চলে এল পাদপ্রদীপের আলোয়। মিডিয়া নজর দিল। তবে ততক্ষণে আমরা অনেক এগিয়ে। শহর, শহরতলী এমনকি রামগঞ্জও ঘুরলাম তন্ন তন্ন করে। সিরিজ প্রতিবেদন ছাপা হলো। চারদিকে ব্যাপক আলোচনা শুরু হলো। তাহের ও তার ছেলেরা রীতিমতো চাপে পড়ে গেল। রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক চাপ শুরু হলো। একটু একটু করে বাঁধন আলগা হতে শুরু করল যেন।

ফেনীতে এসে আমাদের প্রতিনিধি তাহের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করলেন তাহেরপুত্র টিপু। আরিফুর রহমানকে কীভাবে পাওয়া যায়? ম্যানেজ করতে হবে। তাহের ভাই অভিজ্ঞ মানুষ। ভালো ব্যবহার করেছেন তাঁর সঙ্গে। বলেছেন, তিনি কথা বলবেন। তবে এসব নিয়ে টিপু নিজে কথা বলতে চাইলে হিতে বিপরীত হবে। চা খাইয়ে টিপুকে বিদায় করে তাহের ভাই ফেনীতে বসে আমাকে বললেন, ‘এবার আপনার ঢাকায় ফেরা ভালো। তাহেরপুত্ররা আপনাকে খুঁজছে। ফেনীতে অবস্থান করলে আপনাকে খুঁজে পেতে খুব বেশি সময় লাগবে না ওদের। আর তখন কী হবে বুঝতে পারেন?’ তাহের ভাইয়ের পরামর্শমতো আমি ফিরি ঢাকায়, একরামুল হক বুলবুল চট্টগ্রামে। কিন্তু আমার হাতে তখন একাধিক খবর লেখার রসদ।

ঢাকায় ‘প্রথম আলো’ কার্যালয়ে ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে যখন লক্ষ্মীপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুরবস্থা নিয়ে নানা খবর আসছিল তখন রিপোর্টার্স মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় সরেজমিন বিষয়টি খতিয়ে দেখতে রিপোর্টার যাবে লক্ষ্মীপুর। কিন্তু কাকে পাঠানো যায়? তৎকালীন প্রধান প্রতিবেদক আমীরুল ইসলাম টোকন ভাই প্রস্তাব করলেন তরুণ সরকার হলে ভালো হয়। তরুণ সরকার অনুসন্ধানী রিপোর্টার হিসেবে তখন বেশ নাম করেছেন। খুব ভালো বোঝেন। বিষয়ের গভীরে যেতে পারেন। সব মিলিয়ে একটা নামডাক হয়েছে। কিন্তু সানাউল্লাহ লাবলু ভাই রাজি হলেন না। নগর সম্পাদক হলেও তিনিই তখন বার্তা বিভাগের সবচেয়ে প্রভাবশালী। তাঁর সিদ্ধান্ত লক্ষ্মীপুর যাবে আরিফুর রহমান দোলন। কারণও ব্যাখ্যা দিলেন তিনি। বললেন, কদিন আগে যশোর ঘুরে এসেছে সে। জনকণ্ঠের সাংবাদিক শামসুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পরের ঘটনাবলি খুব ভালোভাবে কাভার করেছে আরিফুর রহমান। লক্ষ্মীপুর সে-ই যাবে। টোকন ভাই তরুণ সরকারের পক্ষে বেশ কিছু যুক্তি দিলেও লাভলু ভাই অনড়। বললেন, ‘আমি যেটি বুঝেছি, বলেছি। এটাই সিদ্ধান্ত।’ শেষমেশ আমার ব্যাপারেই সবাই একমত হলেন।

আইনজীবী নুরুল ইসলামকে অপহরণের পর টুকরো টুকরো করে হত্যা, লাশ নদীতে ফেলে দেওয়াই শুধু নয়, লক্ষ্মীপুর ও ওই জনপদের বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের নানা বিষয় আমরা তুলে ধরেছিলাম প্রথম আলোর পাতায়। মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল, সরকার নড়েচড়ে বসেছিল। কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে এসেছিল সব মহলে।

লক্ষ্মীপুর না ফেনী কোন অঞ্চলের সংবাদ সংগ্রহের সময়টা বেশি ভীতিকর ছিল আমার কাছে? দুটোই। তবে ফেনীতে গিয়েছি বারবার। কোনটি আগে লিখব আর কোনটি পরে সেই প্রায়োরিটি ঠিক করা একটু কঠিনই। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জয়নাল হাজারীকে গ্রেফতারের জন্য তার বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। যে রাতে তল্লাশি হয় ওই দিন আমাকে ফেনীতে পাঠানো হয়। বলা হয়, ফেনীতে বড় ঘটনা ঘটবে। খুব কাছে থেকে কাভার করতে হবে। আমার সঙ্গে ফটোগ্রাফার জিয়া ইসলাম। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পুরনো গেস্ট হাউজে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়।

ফেনীতে নেমে সন্ধ্যায় আমাদের প্রতিনিধি তাহের ভাইয়ের ল্যান্ড ফোন থেকে কথা হয় জয়নাল হাজারীর সাথে। এর আগে শহর ঘুরে মনে হয়েছে গুমোট পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমি ফোন করতেই ওপাশ থেকে জয়নাল হাজারী বলেন, ‘এত দিন ভয় ছিল না। এই যে তুমি এসেছো, মানে প্রথম আলোর সাংবাদিক এখন ফেনীতে, আমার কিন্তু কেমন জানি মনে হচ্ছে।’ মানে? জয়নাল হাজারী বললেন, ‘আমি জয়নাল হাজারী সব বুঝি।’ এভাবে কিছুক্ষণ কথা হলো। তাহের ভাইও অবাক। জয়নাল হাজারী কী বোঝাতে চাইলেন? তবে কি সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে এটি ফেনীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বুঝে গেছেন?

ওই দিনই গভীর রাতে কার্ফ্যু জারি করে তল্লাশি হলো জয়নাল হাজারীর বাড়িতে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হলো। মোবাইল টেলিফোনের নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করা হলো। কিন্তু অভিযানের আগেই পালালেন জয়নাল হাজারী। আমরা টের পেলাম অভিযান শুরু হয়েছে। রাস্তায়ও নামলাম। তৎকালীন বিডিআর পাহারায়। ফটোগ্রাফার জিয়াকে বললাম, অন্ধকারে কী করি? জিয়া অসম্ভব পরিশ্রমী, প্রফেশনাল ফটোসাংবাদিক। বলে, ‘চলেন হাঁটতে থাকি।’ কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারি না। সাংবাদিক পরিচয় জানার পরে বিডিআর জওয়ানরা বলেন, ‘ফিরে যান, এখন কার্ফ্যু। কাউকেই মুভ করতে দেওয়া হবে না।’

কোনোমতে গেস্ট হাউজে ফিরলাম। ঘুম আর আসে না। জেগেই কাটালাম সারা রাত। অপেক্ষা, কখন বের হবো বাইরে। ফজরের আজানের পরপরই বেরিয়ে পড়লাম জিয়াকে নিয়ে। সোজা মাস্টারপাড়া। জয়নাল হাজারীর বাড়ি। মাস্টারপাড়া ঢোকার মুখে একটা থমথমে পরিবেশ। পুলিশ-বিডিআরের ছড়াছড়ি সবখানে। পরিচয় দিয়ে এগোতে থাকলাম আমরা। পরিচয় জেনে জয়নাল হাজারীর বাড়িতে খুব সহজেই ঢুকতে দেয়া হলো আমাদের। বাড়ির নিচতলা-উপরতলা বিভিন্ন কক্ষ লণ্ডভণ্ড প্রায়। ঘুরে ঘুরে দেখছি আমরা। ফেনী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল গাফফার পূর্বপরিচিত। সব রুমেই আমাদের যাওয়ার সুযোগ হলো। এমন কিছু জিনিসপত্রের দেখা মিলল যেটি চিরকুমার জয়নাল হাজারীর বাহ্যিক জীবনযাত্রার সাথে বেমানান। ওই জিনিসপত্রগুলো আগেই সেখানে মজুত ছিল নাকি অভিযানের সময় সুযোগসন্ধানী কেউ সেগুলো এখানে নিয়ে আসেন, সেই রহস্য রয়েই যাবে।

জয়নাল হাজারীর বাড়ির পাকা উঠানে বিডিআরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদার কর্মকর্তা ও পুলিশ সুপারের সাথে অভিযানের আগে ও পরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ চলতে থাকে। একপর্যায়ে আমিই প্রশ্ন ছুড়ে দিই, এত বড় অভিযান, এত বড় ঘটনা, অথচ জেলা প্রশাসককে দেখছি না। কালো শ্মশ্রুমুণ্ডিত এ এফ এম সোলাইমান চৌধুরী হাসতে হাসতে হাত বাড়ান- ‘আমিই অধম জেলা প্রশাসক।’ কিছুটা লজ্জা পাই। সবার উদ্দেশেই আমার প্রশ্ন, কেন ধরা গেল না জয়নাল হাজারীকে? রাতেও তো ল্যান্ড টেলিফোনে তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, ওই সময়ে তিনি বাড়িতেই ছিলেন। উত্তর পাই না। আজও আমার মনে প্রশ্ন, জয়নাল হাজারীকে কি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল? প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোপরি তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি আসলেই জয়নাল হাজারীকে গ্রেপ্তার করতে চেয়েছিল? নাকি তাকে সরে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে জয়নাল হাজারী সম্পর্কে আরও বেশি নেতিবাচক প্রচারণা চালানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য? আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক মুখরোচক গল্প তৈরির জন্যই কি এতসব আয়োজন ছিল? এসব বিলক্ষণ এখন বুঝি।

ওই অভিযানের আদ্যোপান্ত দ্রুত লিখে ঢাকা পাঠাই। মনে প্রশ্ন জাগে, জয়নাল হাজারী যেমন গডফাদার, ভিপি জয়নালই বা কম কিসে! কিন্তু তার বাড়িতে অভিযান কোথায়? এই প্রশ্ন প্রশাসন, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে করতে থাকি। একপর্যায়ে তারাও বুঝে যান বিরাট ভুল হয়ে গেছে। যদিও তারা আদৌ ভিপি জয়নালের বাড়িতে অভিযান হোক চেয়েছেন কি না এখনো আমি সন্দিহান। লোক দেখানো এক অভিযান চালানো হয় ভিপি জয়নালের বাড়িতে। এভাবে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এক ধরনের ভারসাম্য আনার চেষ্টা করলেও ফেনীতে সবাই বুঝে যান জয়নাল হাজারীকে কোণঠাসা করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পর্যুদস্ত করার সব রকম তৎপরতা পুরোদস্তুর চলছে।

ফেনীর এই পরিস্থিতি দারুণ বিব্রতকর ছিল আওয়ামী লীগের কাছে, যদিও জয়নাল হাজারীর দায় কম ছিল না। স্টিয়ারিং বাহিনীর মাধ্যমে দমন-পীড়ন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির যে মহোৎসব চালিয়েছে তার বাহিনী, তা ছিল নজিরবিহীন। যদিও বিএনপির ভিপি জয়নাল এবং জাতীয় পার্টির আমলে তৎকালীন মন্ত্রী জাফর ইমামের টাইগার বাহিনীও কম যাননি। জয়নাল হাজারীর পতনের অন্যতম কারণ অবশ্য ছিল মিডিয়াকর্মীর ওপর তার দমন-পীড়ননীতি। ইউএনবির তৎকালীন ফেনী প্রতিনিধি টিপু সুলতানের ওপর বর্বরোচিত হামলা গডফাদার হাজারীর পতনের পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি।

২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে ইউএনবির ফেনী প্রতিনিধি টিপু সুলতানের ওপর নৃশংস হামলা হয়। মৃতপ্রায় এই সাংবাদিককে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যায় সন্ত্রাসীরা। এতটাই আতঙ্কের পরিবেশ তখন ফেনীতে যে, এত বড় ঘটনা গণমাধ্যমে পাঠানোর ওপর সন্ত্রাসী বাহিনী এক ধরনের সেন্সরশিপ জারি করে। খবর পেয়ে ঢাকা থেকে একমাত্র আমি ছুটে যাই ফেনীতে। তৎকালীন কুমিল্লা প্রতিনিধি নাসিরউদ্দিনকে টেলিফোনে যোগাযোগ করে প্রস্তুত থাকতে বলি। সাংবাদিক নির্যাতনের এত বড় ঘটনা তবু সাংবাদিকদের কথা বলতে দেয়া হচ্ছে না। ফেনীতে গিয়ে কোথায় থাকব, কার কার সাথে যোগাযোগ করব, ঘটনার ইতিবৃত্তই বা জানাবেন কারা- এসব নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় ছিলাম। মূলত সে জন্যেই সহকর্মী নাসিরউদ্দিনের বিষয়টি মাথায় আসে। কুমিল্লা থেকে তাকে সঙ্গে নেয়ার সময় কিছু দায়িত্ব দিই- কোথায় কোথায় যাবেন, কার কার সঙ্গে কথা বলবেন, এসব আরকি। ফেনীতে আমার এক ঘনিষ্ঠজন আছেন (নিরাপত্তাজনিত কারণে নাম প্রকাশ করছি না)। তার সাথে যোগাযোগ হলো। তিনি বললেন, ‘হোটেল-গেস্টহাউস কোথাও নিরাপদ না। সর্বত্রই স্টিয়ারিং বাহিনী নজরদারিতে রেখেছে। আপনি সোজা আমার বাসায় আসবেন। এখানে ফ্যাক্স-টেলিফোন সব আছে। আপনার কাজের সব রকম সুবিধাই পাবেন।’ টিপু সুলতান মার খাওয়ার পর যারপরনাই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন আমাদের তাহের ভাই (প্রথম আলোর প্রতিনিধি)। খুব মনও খারাপ করেছিলেন। ওই যাত্রায় আমার সঙ্গে দেখা করেননি। তবে অন্য মাধ্যমে টিপুর মার খাওয়া সম্ভাব্য কারা কারা জড়িত সব ব্যাপারেই আমাকে তথ্য জোগান দিয়েছিলেন।

টিপু সুলতানের ওপর নির্যাতনের কাহিনি ‘প্রথম আলো’র প্রথম পাতায় পর পর দুই দিন ফলাও করে প্রচার হয়। অনেকেই নড়েচড়ে বসেন। ফেনীর স্থানীয় সরকারি হাসপাতাল থেকে তাকে স্থানান্তরিত করা ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। দেখতে যাই। তার বিবর্ণ চেহারা দেখে মনটা বিষণ্ন হয়ে ওঠে। অফিসে ফিরে সম্পাদক মতিউর রহমানকে টিপুর জন্য কিছু করা যায় কি না ভাবতে অনুরোধ করি। পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসা যে তার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট নয়, এটা আমার মনে হয়েছিল। সম্পাদক আমাকে বললেন, তৎকালীন বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু ভাইকে নিয়ে আমি যেন টিপু সুলতানকে আবার দেখতে যাই এবং তার শারীরিক অবস্থার ওপর বিস্তারিত প্রতিবেদন করি। নানা কারণে ব্যস্ত মঞ্জু ভাই সময় করে উঠতে পারছেন না। ভেতরে ভেতরে আমি অস্থির হয়ে উঠি। মালিবাগের কারিতাসে একটি বেসরকারি সংগঠনের অনুষ্ঠান কাভার করতে আমাকে পাঠানো হয়। সম্পাদক মতিউর রহমান অন্যতম অতিথি সেখানে। অ্যাসাইনমেন্ট শেষে আমাকে বলেন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি হয়ে তিনি অফিস যাবেন। আমি সঙ্গী হতে পারি। সম্পাদকের গাড়িতে উঠে বললাম, ‘টিপুর ব্যাপারে তো আমরা কিছু করতে পারতাম। ছেলেটি পঙ্গু হতে চলেছে। এখনো সময় আছে কিছু করা যায়।’ তিনি একমত হলেন।

পরদিন শুক্রবার। লালমাটিয়ায় তার ভাড়াবাড়িতে আমাকে সকাল দশটায় যেতে বললেন। ফটোসাংবাদিক বাবু আহমেদকে নিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই গেলাম। সম্পাদক মতিউর রহমানকে নিয়ে সোজা পঙ্গু হাসপাতালে। টিপু সুলতানের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আমাদের কথা হলো। বাবু আহমেদ অনেক ছবি তুললেন। কয়েক দিন পর মতি ভাই নিজেই টিপুকে নিয়ে লিখলেন। তাকে সাহায্য করার আবেদন জানালেন সবাইকে। একটি তহবিলও গঠন করা হলো। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি টিপুর চিকিৎসার জন্য ওই তহবিলে অর্থ দিলেন। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো ব্যাংককের বামরুম গ্রাদ হাসপাতালে। লম্বা সময় ধরে চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন ফেনীর এই সাংবাদিক।

সুস্থ হয়ে দেশে এসে নিরাপত্তাজনিত কারণেই আর ফেনীতে ফেরা হলো না তার। টিপুর খুব ইচ্ছে ঢাকায় কাজ করবেন। প্রথম আলো প্রথম দিকে সিদ্ধান্তহীনতায়। এভাবে চলল বেশ কিছুদিন। টিপু সুলতান আমাদের অফিসে মাঝেমধ্যে আসেন। সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করেন। আমাদের সঙ্গেও দেখা হয়। নিজের ইচ্ছের কথা সম্পাদককে জানান। আমরাও অনুরোধ করি। একপর্যায়ে যুক্ত হয়ে যান ‘প্রথম আলো’র সঙ্গে। সবাই খুশি আমরা। যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন টিপু। চৌকস রিপোর্টার হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেছেন পরবর্তী সময়ে। এখন আরও বড় দায়িত্বে।

কিন্তু রাজনীতিতে আর ফিরতে পারেননি জয়নাল হাজারী। ২০০১ সালে সেই যে ফেনী ছাড়লেন, তারপর বহু বছর প্রকাশ্যে দেখাই মেলেনি তার। নির্বাসনে কাটিয়ে সম্ভবত ২০০৯ সালে দেশে ফেরেন। কিন্তু রাজনীতির মাঠ হারিয়েছেন। এককালের দুর্দণ্ড প্রতাপশালী এখন নিজ শহরেই ‘অবাঞ্ছিত’। এও সম্ভব! অনেক পরে অবশ্য তার দলীয় রাজনীতিতে মূল্যায়ন হয়েছে। এখন দলের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তিনি।

রিপোর্টিং করতে গিয়ে কতবার যে হুমকি-ধামকির মুখে পড়তে হয়েছে! বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ে একাধিকবার নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন তৎকালীন চিফ হুইপ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও তার দুই পুত্র ডাবলু-পবন। মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার মহাদেবপুর বাজার ও সংলগ্ন এলাকায় চিফ হুইপ পুত্র পবনের চাঁদাবাজি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এনিয়ে একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলাম, চারিদিকে হৈ-চৈ পড়ে গিয়েছিল। কিভাবে গরুর ট্রাকে, হাটে-বাজারে চাঁদাবাজি চলছে সবিস্তারে সেইসব বর্ণনার কারণে নড়েচড়ে বসেছিল প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা। ক্ষিপ্ত চিফ হুইপপুত্র ডাবলু মুঠোফোনে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, শেষ খাওয়া খেয়ে নে। তেজগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলাম।

২০০৬ সালে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল আমার লেখা। প্রথম পাতায় লাল হরফে প্রথম শিরোনামের ওই প্রতিবেদনের হেডিং ছিল, ‘তারেক রহমানের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে’। প্রতিবেদনের ভেতরে কিভাবে প্রবীণ, নবীণ দ্বন্দ্ব বিএনপিতে প্রকট হয়ে উঠছে তা বিশদভাবে তুলে ধরেছিলাম। ‘হাওয়া ভবন’ তৈরি করে রাষ্ট্র ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্রবিন্দু হয়ে তারেক রহমানকে যে বিএনপির পুরনো নেতারা কোনভাবেই পছন্দ করছেন না তা প্রকাশ্যে এনেছিলাম ওই প্রতিবেদনে। স্বভাবতই তা পছন্দ হয়নি তারেক রহমান ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের। উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছিল আমাকে। আইনী পথেই এর মোকাবিলা করেছিলাম।

জামায়াত-বিএনপি সরকারের দোর্দন্ডপ্রতাপশালী যোগাযোগ মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা মন্ত্রী থাকাকালীন একবার দায়িত্বরত সাংবাদিকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন। আজও সেটি মনে দাগ কেটে আছে। সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল সাংবাদিকদের। সভা শুরুর পর হঠাৎ মন্ত্রী জনকণ্ঠের তৎকালীন রিপোর্টার রাশেদ মেহেদীকে সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। কারণ জানতে চাইলে নাজমুল হুদা বলেন, জনকণ্ঠ তার বিরুদ্ধে উল্টাপাল্টা লেখে। তাই জনকণ্ঠের কেউ এই সভায় থাকতে পারবে না। মন্ত্রীর এই আচরণের প্রতিবাদ জানিয়ে উপস্থিত সকল সাংবাদিককে নিয়ে সভা থেকে বেরিয়ে যাই। প্রয়াত সচিব সৈয়দ রেজাউল হায়াতসহ অনেকেই হকচকিয়ে যান। আমাদের সভায় ফিরিয়ে নেওয়ার নানা চেষ্টা করেন। কিন্তু নাজমুল হুদা দুঃখ প্রকাশ না করা পর্যন্ত তাঁর সকল কর্মসূচি বয়কটের ঘোষণা দেই আমরা। সপ্তাহ দুই পরে সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন নাজমুল হুদা। সাংবাদিককে সভা কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলা ঠিক হয়নি, নির্দ্বিধায় মেনে নেন তিনি।

বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে সারাদেশে জঙ্গি তৎপরতা ও জঙ্গি আস্তানার সলুক সন্ধানে গিয়েও কম ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। বিশেষত, রাজশাহী-নওগাঁ অঞ্চলে ২০০৪ সালে জেএমবি ও এর প্রধান সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়ের নৃশংস কর্মকান্ড খবরের কাগজের পাতায় তুলে আনার অনেক ঝক্কি ছিল। বাংলা ভাইয়ের ও তার বাহিনীর কর্মকান্ড একের পর এক তুলে ধরায় হুমকি দিয়ে উড়ো চিঠি, টেলিফোন, ভয়ভীতি দিনের পর দিন সহ্য করতে হয়েছে। তবুও পিছপা হইনি।

লেখক: সম্পাদক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস২৪.কম ও সাপ্তাহিক এই সময়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :