সরেজমিন কামরাঙ্গীর চর (পর্ব-১)

গোটা এলাকা যেন অবৈধ পরিবহনের গ্যারেজ

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২১, ১৬:৩০ | প্রকাশিত : ১৪ অক্টোবর ২০২১, ০৮:৩৩

বুড়িগঙ্গার বুকে একসময়কার বিস্ময়ের দ্বীপ বলে পরিচিত কামরাঙ্গীর চর এখন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। জনাকীর্ণ বসতি, আড়ত-বাজার, কারখানা, বাড়িঘর মিলে গমগমে থাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওতাভুক্ত এই এলাকায় অন্যতম প্রধান সমস্যা যোগাযোগব্যবস্থা। চলাচলের মাধ্যম ছোট আকারের যানবাহন।

তবে পৌনে তিন বর্গকিলোমিটারের এই এলাকায় গিজগিজ করে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজি বাইক, টেম্পো। এগুলো চলছে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে। কারণ দেশে এই ধরনের যানের অনুমতি নেই।

স্থানীয় প্রভাবশালী, নানা অজুহাতে চলাচল করছে হাজার হাজার অবৈধ পরিবহন। দায় নিতে চান না স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। নানান কারণে অবৈধ পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না পুলিশ।

পুরান ঢাকা লাগোয়া কামরাঙ্গীর চরের রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড। সরু রাস্তা প্রশস্তকরণ আর অবৈধ যানবাহন বন্ধে এখানকার ওয়ার্ড কাউন্সিলররাও তেমন ভূমিকা রাখতে পারছেন না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বেড়িবাঁধ থেকে কামরাঙ্গীর চরে প্রবেশের পথ কোম্পানি ঘাট, সিকসন, লোহার ব্রিজ। এর মধ্যে লোহার ব্রিজটি কিছুটা চওড়া হলেও বাকি পথগুলো খুবই সরু। প্রবেশ পথের মতো ভেতরের সড়কগুলোও বেশ সরু। ফলে এখানে কোনো বাস বা মিনিবাসের চলাচল নেই। পণ্য পরিবহন বা স্থানীয়দের যাতায়াতের মাধ্যম- ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক ও টেম্পু। যদিও এর কোনোটিরই অনুমোদন নেই।

রনি মার্কেট, জাউলাহাটি, মাদবর বাজার, খোলামুড়া, মুন্সিহাটি, বেড়িবাঁধসহ পুরো চরে রয়েছে অজস্র অবৈধ পরিবহন। অবৈধ পরিবহনের সংখ্যা কত সেই হিসাবও নেই কারও কাছে।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, অন্তত ১০ হাজার অবৈধ পরিবহন চলছে পুরো কামরাঙ্গীর চর জুড়ে। এসব পরিবহন প্রায়ই দুর্ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। ছোট-বড় দুর্ঘটনায় আহত হচ্ছে শিশু, নারীসহ নানা বয়সী মানুষ।

স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছায়াতলে চরের কিছু মানুষই এসব অবৈধ পরিবহন চালাচ্ছে। তাদের নিজেদের মধ্যে রয়েছে একটি অবৈধ বন্ধন। কোনো ব্যাটারির রিকশা বা ইজিবাইক আটক হলে সেখানে তাৎক্ষণিক ছুটে যান অন্যান্য চালক-মালিকরা।

করোনাভাইরাস মহামারির বিস্তার ঠেকাতে গেল বছর লকডাউন চলাকালে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক বন্ধে মাঠে নেমেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের অভিযানে বেশ কিছু দিন বন্ধ ছিল এসব অবৈধ পরিবহন। তবে কিছুদিন পর তারা আবারো নামে রাস্তায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চরের কিছু প্রভাবশালীদের মাধ্যমে মাসে এক হাজার টাকার বিনিময়ে এসব অবৈধ পরিবহন চালানোর অনুমতি পান চালকরা। প্রভাবশালীদের থেকে ওই কার্ড আসে গ্যারেজ মালিক বা পরিবহন মালিকদের কাছে। সেখান থেকে টাকার বিনিময়ে কার্ড নেন চালকরা। রিকশা বা ইজিবাইক চালানোর সময় ওই কার্ড সঙ্গে রাখা বাধ্যতামূলক। তবে চরের মধ্যে চলাচলের কার্ড নিয়ে বেড়িবাঁধ সড়কে আসতে পারে না ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত রিকশা।

এসব বিষয়ে অবগত আছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। ৫৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূরে আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘চলে, চালায় আরকি। চলে আর চালায়। এই পর্যন্তই জানি।’

কীভাবে চলে আর কারা চালায় জানতে চাইলে নূরে আলম বলেন, ‘এটা একটা সময় ছিল। এখন হয়ত নাই। করোনার আগে দিয়া টিকিট-মিকেট দিয়া এইডা করত, কিছু কিছু লোকে। করোনার পর দিয়া এইডা বন্ধ হইছে। আমার জানা মতে নাই। আবার থাকতেও পারে।’

২০২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এবিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে অভিযানেও নেমেছিল দক্ষিণ সিটি। এসময় বেশ কিছু অবৈধ পরিবহন বন্ধ আটক করা হয়েছিল। করপোরেশনের নির্দেশনা ছিল, যে সকল অযান্ত্রিক পরিবহনকে যান্ত্রিক করা হয়েছে, সে সকল পরিবহনকে পুনরায় অযান্ত্রিক পরিবহনে পরিণত করতে হবে।

মেয়রের এমন ঘোষণা ও অভিযানে বন্ধ হয়ে যায় অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। এসকল অবৈধ পরিবহন চলাচলের অবৈধ অনুমোদন হিসেবে পরিচিত ‘কার্ড’ বিক্রিও বন্ধ ছিল। তবে মাসখানেক পর আবার একই চিত্র ফিরে আসে।

কামরাঙ্গীর চরে অবৈধ পরিবহনের দৌরাত্মের বিষয়ে ঢাকা টাইমসকে ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘এদের বন্ধের ব্যবস্থা আসলে কে নেবে? এ বিষয়ে আমাদের কোনো দায়িত্ব নাই। এটা সম্পূর্ণ প্রশাসনিক বিষয়। যদি বিধিবহির্ভূত হয়, তাহলে প্রশাসন বন্ধ করে দেবে।’

এসব অবৈধ পরিবহন বন্ধে ডিএসসিসির নির্দেশনার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘নির্দেশনা তো আছে। সরকার চেষ্টা করে, প্রশাসন চেষ্টা করে, আমরা চেষ্টা করি। এখানে অতিমাত্রায় গরিব মানুষ থাকে। আমাদের তো অন্যান্য কাজ থাকে। একটা রিকশার পিছে তো আমরা ছুটতে পারি না।’

‘আমাদেরকে একটা গাইড লাইন দিলে, আমরা সেটা হয়ত বাস্তবায়ন করে দিতে পারব। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা একটা জিনিস পাহারা দিয়ে বন্ধ করা তো আমাদের কাজ না।’

কামরাঙ্গীর চরে ব্যাটারিচালিত রিকশা আর ইজিবাইক আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে ঢাকা টাইমসকে ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইদুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কামরাঙ্গীর চরে বৈধ পরিবহন একটাই আছে। পয়সা ফেঁকো, তামাশা দেখো। পয়সা দেন, সবই চলবে। ব্যাটারির রিকশার পয়সা কে খায়, বের করেন। কে খাইতেছে পারলে বের করেন।’

কামরাঙ্গীর চর থানা ঢাকা মহানগর পুলিশ-ডিএমপির আওতাভুক্ত। অবৈধ পরিবহন বন্ধের বিষয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা তো চেষ্টা করছি। ধরি, আবার চলে। কয়টা ধরব? ধরে তো রাখারও জায়গা নাই। তাছাড়া এটা দেখার দায়িত্ব ট্রাফিক বিভাগের।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে লালবাগ ট্রাফিক বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. সাইদুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অবৈধ এসব পরিবহন আটক করা হলে চালকরা দলবন্ধ হয়ে আসে। মারধরের অভিযোগ তোলে ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে। এমনকি মারধরের মিথ্যা অভিযোগ তুলে ভুয়া মেডিক্যাল সার্টিফিকেট এনে মামলারও প্রস্তুতি নেয় তারা।’

পুলিশ কর্মকর্তা সাইদুল বলেন, ‘এটার সঙ্গে অনেক সেক্টর, অনেক কিছু জড়িত। আমরা যদি ধরতে যাই, তখন কেউ পঙ্গু, কেউ বলে সে চালাই না, তার ভাই চালায়। এদের কোনো রেজিস্ট্রেশন নাই। গাড়ির আসলে মালিক কে সেটাও নিশ্চিত হওয়া যায় না।’

(ঢাকাটাইমস/১৪অক্টোবর/কারই/ডিএম/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :