বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি

প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবী। এই পরিবর্তনের ধারায় কখনো সিডর, সুনামি, আইলা, কখনো হারিকেন, কখনো নার্গিস, ফনি, আম্পান; কখনো ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, বিভিন্ন রকমের রোগ-বালাই দুর্যোগ আকারে দেখা দিচ্ছে। মারা যাচ্ছে মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাঠের পর মাঠ ফসল। বাড়ছে খাদ্য সংকট। ঘরবাড়ি মিশে যাচ্ছে মাটির সাথে। ফলে মানুষ হারাচ্ছে তার মাথা গোঁজার ঠাঁই। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে জলবায়ুর কুপ্রভাবে বিশ্বে মরুকরণ একটি অন্যতম সমস্যা।
১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম বিশ্ব মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের পক্ষ থেকে খরা ও মরুকরণের প্রতি সোচ্ছার হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৭ সালে নাইরোবিতে বিশ্ব মরুকরণ বিরোধী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মলনের পরপরই মরুকরণ সংক্রান্ত আর্ন্তজাতিক কনভেনশন গ্রহনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
রিও সম্মেলনের এজেন্ডা ২১ এর প্রস্তাবটি ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের ৪৭তম অধিবেশনে গৃহীত হয় এবং ইন্টারগর্ভমেন্টাল নেগোশিয়েটিং কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি মরুকরণ সংক্রান্ত খসড়া কনভেনশন চূড়ান্ত করে। ১৯৯৪ সালের জুন মাসে কনভেনশনের দলিল চূড়ান্ত হয়। এই কনভেনশনে ৫০টি দেশ কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর ১৯৯৬ সনের ২৬ ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে কার্যকর হয়। বলা আবশ্যক যে, বাংলাদেশও এই কনভেনশন অনুমোদন করে। পরবর্তীতে খরা ও মরুকরণ সম্পর্কে বিশ্ববাসী কে সচেতন করে তুলতে ১৭ জুন পালন করা হয় বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস।
বিশ্বের জলভূমির প্রায় ৭০% ইতিমধ্যেই হয়ে পড়েছে মরুকবলিত। এর পরিমাণ পৃথিবীর মোট ভূমির চার ভাগের এক ভাগ। নিষ্কাশনে অব্যবস্থা ও লবণাক্ততার ফলে সেচের আওতাধীন আবাদি জমির বিশাল অংশ আজ অবক্ষয়ের সম্মুখীন। সুতরাং মরুকরণ ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য এক বিশাল হুমকি। এজন্য প্রয়োজন মরুকরণ বিস্তার রোধ।
আজকের দুনিয়ার পরিবেশের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে মরুকরণ অন্যতম। জাতিসংঘ বলেছে, পৃথিবীর প্রায় দেড় শ কোটি মানুষ বেঁচে থাকার জন্য ক্ষয়িষ্ণু ভূমির উপর নির্ভরশীল। আর পৃথিবীর অতি দরিদ্রদের প্রায় ৪২ ভাগই বাস করে ক্ষয়ে যাওয়া এলাকায়, যারা মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছে। এই ভূমিক্ষয় জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করেছে, যা শুধু আমাদের বেঁচে থাকার জন্যই বিপদের কারণ নয় বরং এটি আমাদের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
মরুকরণ যেমনিভাবে বিশ্বব্যাপী মাথাব্যথার কারণ তেমনি আমাদেরও উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন আমাদের ফসলি জমি কমে পরিবেশের ভারসম্য নষ্ট হচ্ছে। একই সঙ্গে কমছে গাছ-পালা, বন-জঙ্গল। তার চেয়ে বড় বিষয় আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য জলাধারের অবস্থাও সঙ্গিন। দিন দিন যেমন আমাদের ফসলি জমি কমছে, একই সঙ্গে খরায় উর্বরতা হারাচ্ছে জমি। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি দেশের একটি বাংলাদেশ। এ অবস্থায় পরিবেশের প্রতি আমাদের মনোযোগী হওয়া আবশ্যক।
জাতিসংঘের এক গবেষণা বলছে, ২০ বছর পর মানবজাতির যাবতীয় চাহিদা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। সে সময়ে বর্তমানের প্রায় ৫০% বেশি খাদ্যের প্রয়োজন হবে। জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে তখনকার চাহিদামতো প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়ে সেটা সংকট সৃষ্টি করতে পারে। সেই সংকট গতি নিয়ে চলে যেতে পারে সংঘর্ষের দিকে। আর এই সংকটের একমাত্র কারণ হবে মরুকরণ ও খরা।
মরুকরণ এতোদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না হলেও এখন এটি পরিবেশ বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছে। সম্প্রতি আমাদের দেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আম্পান, ফণী, সিডর, আইলা, নার্গিসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই ভাবনাকে আরো প্রবল করে তুলেছে।
মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামল দেশটি হয়তো একদিন হারিয়ে যেতে পারে মরুভূমির ধূসর বালির গহ্বরে। বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থা বিশ্লেষন করে বিশ্লেষকরা এটাই আশঙ্কা করছেন। তারা বলেছেন, মরুকরণের প্রধান দুটি বিষয় হচ্ছে একটি বিস্তৃত এলাকা ছেড়ে যদি সেখানকার মাটি অনুর্বর হতে থাকে এবং যদি নদী-নালা, খাল বিল শুকিয়ে যেতে থাকে ও বৃষ্টির অভাব ঘটে। বিগত কয়েক দশক ধরে এ লক্ষণগুলো বেশিভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশে।
এ পরিস্থিতিতে কৃষিজমি সংরক্ষণ, কৃষিকাজে জৈবসার ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিতকরণে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা, অপরিকল্পিত নগরায়ন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, নদীর পানি প্রবাহে যথাযথ উদ্যোগ, খাল-বিল ও জলাভূমি সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন তারা।
অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে দেশের কৃষিজমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। সাধারণ হিসাবে মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ যদি পাঁচ ভাগ থাকে তাহলে তা উর্বর মাটি। দেশের কৃষিজমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বর্তমানে এক শতাংশ। রাসায়নিক সার ব্যবহার ও শাক সবজির বদলে ধান চাষ বেশি হওয়ায় মাটি গুণাগুণ হারিয়ে অনুর্বর হয়ে পড়ছে।
বর্ষা বা শীত মৌসুমে ধঞ্চে, কলাই প্রভৃতি চাষ করলে কৃষিজমির ঊর্বরতা বাড়াতো। কিন্তু এখন দীর্ঘ দিনের সেই প্রথাগত চাষ বন্ধ। জমির অনুর্বরতা ঠেকাতে জৈব চাষের প্রতি কৃষকদের উৎসাহিত করা উচিত। কিন্তু তা সময় সাপেক্ষ হওয়ায় সবাই ঝুঁকছে রাসায়নিক সারের দিকে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন দেশের কৃষিজমি পুরোপরি অনুর্বর হয়ে পড়বে। যা মরুকরণে ঝুঁকির একটি প্রধান দিক।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরাকবলিত হয়ে ক্রমান্বয়ে ভূমির অবক্ষয় হচ্ছে। বিশেষত রাজশাহী অঞ্চল এই সমস্যা কবলিত অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত। অত্যান্ত জরুরী হলেও বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস এদেশে বিশেষ গুরুত্ব বিস্তার করতে পারেনি। তবে মরুকরণ রোধে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সরকারের পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ রোপণ কার্যক্রম বিশেষভাবে গৃহীত হয়েছে যা প্রশংসার দাবিদার। মরুকরণ বিস্তার রোধে অধিক বৃক্ষ রোপণই হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
যেসব বৃক্ষ পানি ধরে রাখে এবং জমির মান অক্ষণ্ন্ন রাখতে পারে সেসব বৃক্ষ রোপণ করার ব্যাপারে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস পালনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কনভেনশনে গৃহীত মূল প্রস্তাবে বৃক্ষ রোপণ এবং বিকল্প জ্বালানি সৃষ্টির ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
এক হিসেবে বলা হয়েছে, গত একশ বছরের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা ০.৭৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এভাবে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সারের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.৫০ থেকে ১.৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা যদি এভাবে বেড়ে যায়, তাহলে মানুয়ের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে আমাদের। এতে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, সুপেয় পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি তাদের অধিকার, গৃহায়ণ ও অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা হুমকির মুখে পড়বে।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, আগামী ৫০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অনেকটা অংশ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, জীববৈচিত্র, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি ও উপকূলীয় এলাকার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত বেড়ে গিয়ে বন্যা হবে, খাদ্য উৎপাদন শতকরা ৩০ ভাগ কমে গিয়ে ক্ষুধা ও গরিবের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে, তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে হিমালয়ের হিমবাহগুলো গলে বিপর্যয়ের মুখোমুখি করবে আমাদের।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট নদীর সংখ্যা ৩১০টি। এর মধ্যে মৃত ও মৃতপ্রায় নদীর সংখ্যা ১১৭টি। এদিকে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিইউএস) থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সাধারণ হিসাবে গত ৪০ বছরে শুধুমাত্র পদ্মা, মেঘনা, যমুনা- এই তিনটি নদীতেই এ পর্যন্ত বিলীন হয়েছে ১ লক্ষ ৫০ হাজার হেক্টর জমি। আর তার বিপরীতে নতুন ভূমি জেগেছে মাত্র ৩০ হাজার হেক্টর। প্রতি বছর কোন না কোন নদীর শাখা ধীরে ধীরে পলি পড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোন কোন নদী দখল হয়ে যাচ্ছে ভূমিদস্যুদের হাতে। পরিকল্পনার অভাবেই নদীমাতৃক বাংলাদেশ থেকে এভাবে নদী হারিয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘ এ দিবসটি (১৭ জুন) অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালনের আহবান জানালেও বাংলাদেশে দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন হচ্ছে না। অথচ অনেক গুরুত্বহীন দিবসও সাড়ম্বরে পালিত হতে দেখা যায়। বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় বাংলাদেশে দিবসটির তাৎপর্যময় উদযাপন প্রত্যাশা করি।
লেখক: সমন্বয়ক, মিডিয়া সেল টু ভাইস-চ্যান্সেলর এবং কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ, বিএসএমএমইউ।

মন্তব্য করুন