যেসব কারণে এত বেড়েছে ডলারের দাম

খোলাবাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবার ডলারের দাম বাড়ল ব্যাংকেও। ব্যাংকেও ডলার বিক্রি হচ্ছে ১০৮ থেকে ১১০ টাকায়। অনেকেরই অভিযোগ, ব্যাংকগুলো ইচ্ছামতো দামে নগদ ডলার বিক্রি করছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।
মঙ্গলবার খোলাবাজারে প্রতি ডলার কিনতে ক্রেতাদের গুনতে হয়েছে রেকর্ড ১১২ টাকা। এটি দেশে এ যাবৎ সর্বোচ্চ দাম। এ অবস্থার সযোগ নিচ্ছে ব্যাংকগুলো, এমন অভিযোগ গ্রাহকদের।
ডলার সংকটে গত দুই মাসে টাকার বিপরীতে ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ দাম বাড়ে ডলারের। সর্বশেষ গত সোমবার ২৫ পয়সা বেড়ে ডলারের দাম দাঁড়ায় ৯৪.৭০ টাকা।
বুধবার ডলারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া আন্তব্যাংক দর ছিল ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা। এই দামে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ব্যাংকগুলো এই দরের চেয়ে ১০ থেকে ১৩ টাকা বেশি দামে বিক্রি করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রাটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুধবার ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড মাত্র এক দিনের ব্যবধানে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১০৮ টাকায় নগদ বিক্রি করেছে প্রতি ডলার। এর আগের দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার দাম ছিল ১০১ টাকা। আইএফআইসি ও সিটি ব্যাংক থেকে এক ডলার কিনতে বুধবার গুনতে হয় ১০৭ টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক ১০৩ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। অন্য তিন সরকারি ব্যাংক সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০২ টাকায়। ব্যাংক ও খোলাবাজারে গতকালের চিত্র বিবেচনা করলে দেখা যায়, এদিন ব্যাংকে ডলারপ্রতি গুনতে হয় ১০৮ টাকা, যা খোলাবাজারের দরের সমান।
গ্রাহকদের অভিযোগ, খোলাবাজারে যেখানে চার টাকা কমেছে, সেখানে ব্যাংকগুলো কীভাবে পাঁচ থেকে ছয় টাকা বাড়িয়ে ডলার বিক্রি করে! এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ব্যাংকগুলোর এমন মনোভাবে অনেক গ্রাহক ক্ষতির মুখে পড়ছে এবং টাকা মান হারাচ্ছে বলে মনে করেন তারা।
ডলার বাজারে ঘুরে নানা জনের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, ভ্রমণ, শিক্ষা, চিকিৎসা কিংবা জরুরি প্রয়োজনে কেউ বিদেশে যেতে চাইলে এখন ব্যাংক বা খোলাবাজার যেখান থেকেই ডলার কিনুন না কেন একই দাম গুনতে হচ্ছে।
ব্যাংকগুলোতেও দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ডলার সংকটের কথা জানান একটি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোতেও ডলারের চরম সংকট চলছে। বিশেষ প্রয়োজনে ডলারের জন্য পাঁচটি ব্যাংক ঘুরে মাত্র পাঁচ হাজার ডলার পাওয়া গেছে।’
তবে বাজারে ডলার সংকটের পাশাপাশি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর কারসাজিও দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে ডলারের ফটকা কারবারির আগমন ঘটছেও বলে জানান তারা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমদানি খরচ বৃদ্ধির ফলে ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। ফলে বাড়ছে ডলারের দর। আর এ চাপ এত সহজেই কাটছে না। কারণ হিসাবে তিনি বলছেন, নানা উদ্যোগের পরও আমদানি খরচ সেভাবে কমানো যাচ্ছে না। আবার প্রবাসী আয়েও সুখবর নেই।
ডলারের এক দিনে এত দাম বাড়ার পেছনে কোনো সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী কাজ করছে কি না এমন প্রশ্নে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দেশে একদল সুবিধাবাদী লোক সব সময়ই সরব থাকে। যেকোনো দুর্যোগে তারা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। ডলারের বেলায়ও তা-ই হয়েছে। খোলাবাজার থেকে শুরু করে ব্যাংকÍসবাই-ই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।’
বৈশ্বিক সংকটের কথা উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশই অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে রপ্তানি। আবার অন্যদিকে বাড়ছে উৎপাদন খরচ। এর মধ্যে দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হয়েছে।’
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘ডলারের দাম আরও বাড়বে- এমন গুজবে সাধারণ মানুষ এখন শেয়ারবাজারে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে ডলার কিনছে। অনেকে আবার তিন-চার মাস পর দেশের বাইরে যাবেন, তাই প্রয়োজনীয় ডলার এখনই কিনে রাখছেন। সব মিলিয়ে মুদ্রাবাজারে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে।’ এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপদ দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বর্তমান অবস্থায় টাকাকে শক্তিশালী করতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়া দরকার বলে মনে করেন আহসান মনসুর। বলেন, ‘আমি মনে করি এ ক্ষেত্রে একটাই পথ আছে, অল্প সময়ের জন্য হলেও ব্যাংক ঋণ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। যে কাজটি রাশিয়া করেছিল এবং সফল হয়েছে।’
খোলাবাজারের প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বলে জানান কয়েকজন গ্রাহক। একই সঙ্গে তাদের প্রশ্ন, ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকির মধ্যে থেকেও কীভাবে খোলাবাজারের কাছাকাছি দরে ডলার বিক্রি করে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বর্তমানে একটা বৈশ্বিক অস্থিরতা চলছে। এ অস্থিরতার প্রভাব বাংলাদেশে পড়েছে। ফলে ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ডলার তার নিজস্ব গতিতে ওঠানামা করবে। আর এটা ঠিক, খোলাবাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেই।’
প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে এলসি খোলার জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত ডলার নেই বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র। বলেন, ‘বেশি দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেও চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। সে কারণে বেশি দামে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে। বাধ্য হয়ে তাকে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
বাজার স্থিতিশীল করতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মঙ্গলবারও ৫ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। ১ জুলাই থেকে গত ২৬ দিনে প্রায় ১০০ কোটি (এক বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তারপরও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। দিন যত যাচ্ছে, মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা ততই বাড়ছে। এর ফলে রিজার্ভ দুই বছর পর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসার পর আর ওপরে উঠছে না। মঙ্গলবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
বেশ কিছুদিন ধরে চলা ডলারের অস্থির বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে বিলাসবহুল এবং অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটার পর একটা পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার কারণেই মূলত দেশে ডলারের এই সংকট দেখা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি মহল থেকে বলা হচ্ছে। তবে এ সময়ে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হলেও আমদানি ব্যয় বেশি হওয়ায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ফলে ডলারের সংকট কাটছে না। প্রতিনিয়ত বাড়েছে ডলারের দাম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরের বেশি সময় ধরে একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলার। গত দু-তিন মাসে টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত দর ছিল ৯৪.৭০ টাকা।
(ঢাকাটাইমস/২৭জুলাই/আরকেএইচ)

মন্তব্য করুন