জেনে নিই ভাটিয়ালি কেমন গান

কামরুজ্জামান রাব্বী
| আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৪৩ | প্রকাশিত : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২৩:৩১

ভাটিয়ালি বাংলা লোকসঙ্গীতের এমন একটি অঙ্গ যাকে বাদ দিয়ে বাংলা লোকসঙ্গীত কে কল্পনা করা অসম্ভব। ভাটিয়ালি শব্দ টা শুনলেই আমরা বুঝতে পারি এটি নদীর সাথে সম্পর্কিত। আমরা জানি নদীর দুটি দিক থেকে যথা: উজান ও ভাটি। ভাটিয়ালি গানের সৃষ্টিও হয়েছে এই নদী কে কেন্দ্র করেই।

আমরা জানি যে আমাদের এই বাংলাদেশ নদী মাত্রিক দেশ। এই দেশে হাজারো নদ নদী, খাল বিল, হাওড় বাওড় বিদ্যমান। আর এই সকল নদীতে মাঝি নৌকা বায়,জেলেরা মাছ ধরে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করে। বাংলার মানুষের তাই নদীর সাথে এক বিশেষ সম্পর্ক যুক্ত হয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। মূলত ভাটিয়ালি গান মানেই নদী,নৌকা,মাঝি, বিরহীনী নারী,নাইওর এই সকল কিছু বিদ্যমান।

ভাটিয়ালি শব্দটির প্রথমাংশ ‘ভাটি’ বলতে অভিধানকারগণ ‘নিম্নদিক’, ‘নিম্নাভিমুখী’, ‘নিম্নপ্রবাহী’ প্রভৃতিকে বুঝিয়েছেন। সাধারণত নদীর স্রোত যেদিকে প্রবাহিত হয় সেই দিককে ‘ভাটি’ বলে। সেই ‘ভাটি’র সঙ্গে বিশেষণ বাচক তদ্ধিত প্রত্যয় ‘আল’ বা আলি’ যুক্ত হয়ে ‘ভাটিয়াল’ বা ‘ভাটিয়ালি’ শব্দটি গঠিত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ‘ভাটিয়ালি’ শব্দটির এ ধরনের গঠন ও উৎস বিচারপূর্বক অধিকাংশ গবেষক ‘ভাটিয়ালি গান’-এর পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন, ভাটির টানে নৌকা ছেড়ে দিলে বিনা আয়াসেই নৌকা চলতে থাকে। এই ‘অনায়াস’ এবং তজ্জাত ‘অবসর’ই ভাটিয়াল-ভাটিয়ালির রচনাগত উৎস।

তবে, এ-কথা মানতেই হবে, ভাটিয়াল-ভাটিয়ালি মূলত নদী-প্রান্তরের গান। ভাটিয়ালি গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য সুরের দীর্ঘ টান ও লয়। প্রচলিত মতে মাঝিমাল্লাদের গান থেকে ভাটিয়ালি সুরের উৎপত্তি। নিকট অতীতে নদীবিধৌত বাংলাদেশে সাধারণত নদীর ভাটির স্রোতে নৌকা বাইতে মাঝিদের তেমন বেগ পেতে হতো না। তাই সেই অবসর ও আনন্দে তারা লম্বা টানে গলা ছেড়ে গান গাইত। কালক্রমে এই গানই ভাটিয়ালি গান নামে পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও সিলেট জেলায় এই গান বিশেষভাবে প্রচলিত। লেখক তপন রায় এর মতে,পূর্বাঞ্চল বা পূর্ববঙ্গের গানের ধারাগুলোর মধ্যে মূল ধারা হচ্ছে ভাটিয়ালি।

পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় নিম্নভূমি এবং সেই কারণেই নদী-হাওরে পরিপূর্ণ। পূর্ববঙ্গেও ভাটিয়ালির নানা উপ-আঞ্চলিক বিশেষত্ব আছে। ভাটিয়ালি গানের প্রধান ভৌগোলিক অঞ্চল হলো প্রাচীনকালের ‘পূর্ববঙ্গ’ তথা ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ভাটিয়ালি এলাকার নানা উপ-অঞ্চলে নানা ধরনের সুর ও বাণীর বৈশিষ্টমন্ডিত ভাটিয়ালি গানের অস্তিত্ব রয়েছে। যেমন- বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ভাটিয়ালি গানের সাথে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভাটিয়ালি গানের যেমন পার্থক্য রয়েছে তেমনি খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের ভাটিয়ালি গানের সাথে বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলের ভাটিয়ালি গানের পার্থক্য রয়েছে। একই ভাবে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ভাটিয়ালি গান এবং বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাটিয়ালি গান স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে অদ্যাবধি প্রবহমান রয়েছে।

ভাটিয়ালি একক সঙ্গীত। প্রেম ও ঈশ্বর এর প্রধান বিষয়। এতে একদিকে লৌকিক প্রেমচেতনা, অন্যদিকে আধ্যাত্মিক চেতনা প্রতিফলিত হয়। বিষয় ও অবস্থাভেদে এর অনেক শ্রেণীভেদ আছে। এক সময় বাংলাদেশে ভাটিয়ালি গানের পাঁচটি ধাঁচ প্রচলিত ছিল। তবে এই ধাঁচগুলির কয়েকটি বর্তমানে চর্চা হয় না। সচরাচর মুর্শিদি ও বিচ্ছেদী নামে পরিচিত দুধরণের গানই ভাটিয়ালির অন্তর্গত।

ভাটিয়ালি কিছু গান আছে যেগুলো শুনলে প্রথমেই মনে হয় একজন মাঝি তার বৈঠা বাইতে বাইতে অথবা বৈঠা রেখে মনের সুখে বা দুঃখে উদাস সুরে গান ধরেছে। সেই গুলো মূল ভাটিয়ালি গানের একটি অংশ। যেমন বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত ওই অংশের কিছু ভাটিয়ালি গান হচ্ছে, "সর্বনাশা পদ্মা নদী" "আর কতো কাল ভাসবো আমি" প্রভৃতি। আবার কিছু ভাটিয়ালি গান আছে যা শুনলে একজন বিরহীনী নারীর নাইওর যাওয়ার আকাঙ্খা প্রকাশ পায়। যেমন, "পূবালী বাতাসে বাদাম দেইখা চায়া থাকি", " কে যাস রে ভাটির গাং বাইয়া" প্রভৃতি। আবার কিছু ভাটিয়ালি গান আছে যা মূলত অধ্যাত্ববাদ কে ঘিরে। জীবনের শেষ সময় অর্থাৎ ভাটি বেলায় নিজেকে নিঃস্ব বা নিরুপায় ভেবে কিছু গান গাওয়া হয়। যেমন, "থাকতে পার ঘাটাতে তুমি পারের নাইয়া", "মন মাঝি তোর সাধের তরী বাইতে জানো না" প্রভৃতি গান।

এছাড়াও বাংলা লোকনাট্যে, বিশেষত গাজীর গানে বহুস্থলে ভাটিয়ালির দুএকটি ধাঁচের সাক্ষাৎ মেলে। অনেক ক্ষেত্রে গানের বিশেষ চরণের সুর নির্দেশক হিসেবে ‘ভাটিয়ালি’ শব্দটির প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। সাধারণত পালা বা পাঁচালির বন্দনা অংশে প্রথম চরণ উজান ও দ্বিতীয় চরণ ভাইটাল বা ভাটিয়ালি নামে আখ্যাত হয়, যেমন: "পুবেতে বন্দনা করলাম পুবের ভানুশ্বর,একদিকে উদয়রে ভানু চৌদিকে পশর" বাংলা লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক আঞ্চলিক গানে ভাটিয়ালি সুরের প্রয়োগ আছে। প্রাচীন বাংলায় ভাটিয়ালি রাগের প্রচলন ছিল। সেখশুভোদয়া গ্রন্থে বিধৃত ভাদু গান ভাটিয়াল রাগে গায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও ভাটিয়ালি গানের উল্লেখ পাওয়া যায়।

লেখক: লোকসঙ্গীত শিল্পী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :