শেখ হাসিনা ‘প্লেটোর দার্শনিক রাজা’

কামরুল হাসান নাসিম
| আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৫:৩১ | প্রকাশিত : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৫:২৭

‘সুখ কৃতিত্বের আনন্দ এবং সৃজনশীল প্রচেষ্টার রোমাঞ্চের মধ্যে নিহিত’। বলেছিলেন, ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। এমন মতবাদের উপলক্ষ হলো ফলত কর্মই। ঠিক তখন উইলিয়ামস জেমস বললেন, ‘কর্ম সবসময় সুখ আনতে পারে না, কিন্তু কর্ম ছাড়া সুখ নেই।’

বাংলাদেশি দার্শনিক ঈশ্বরমিত্র বললেন, ‘সুখের চারটি রাজ্য। একটি হল, আত্মবোধ যখন নিজেকে বিজয়ী হিসাবে উপস্থাপন করে। দুই, দৃষ্টি যখন পারিপার্শ্বিকতাকে হ্যাঁ বলে। তিন, যৌন আকর্ষণ ও সন্তুষ্টি। চার, অর্থ ও ক্ষমতা অন্বেষণে বাস্তবতা যখন তোমাকে নির্ভার রাখে।’

বাংলাদেশের জনশ্রেণি এখন কেমন আছে? ঈশ্বরমিত্রের প্রথম রাজ্যের বাসিন্দারা কর্ম দিয়ে, সৃজনশীল কাজ করে ব্যস্ত। নানা শ্রেণির পেশাজীবী হয়ে হয়তো তাঁরা সুখে আছেন।

এদিকে সমাজের মানুষ হয়ে বিচরণ করে ঈশ্বরমিত্রের দ্বিতীয় রাজ্যের বাসিন্দা হওয়া যায় না। দৃষ্টির প্রথম শর্ত হল মানুষকে প্রকৃতির মানুষ হতে হবে। প্রাণবাদকে সঙ্গী করে এগোতে হবে। হ্যাঁ, পরিবারের মানুষগুলোর মুখ দেখে অবশ্য এই রাজ্যে মায়ার আবহে সুখী জনগোষ্ঠির একটা অংশ বসবাস করবে, করছেও।

তৃতীয় ধাপের রাজ্যে সবাই ব্যস্ত। সিগম্যুন্ড ফ্রয়েড এই জন্যই হয়তো বলেছিলেন, সামাজিক ক্রমবিকাশের মূলচালিকা শক্তি হল, যৌন আকর্ষণ কিংবা যৌনতা। বরং, মুদ্রার নোট প্রত্যাশী হয়ে ও যার যার মতো করে ছোট, মাঝারি ও বড় ক্ষমতাকে সঙ্গী করার লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ এখন বলছে ও বলবে, নির্ভার থাকতে পারছি কোথায়?

নির্ভার রাখার জন্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় সেবায় রয়েছে। অনেকেই এখন বলবেন, রাষ্ট্রীয় সেবা কেন বললেন? কেন ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা’ বললেন না! তাঁরা তো গণতন্ত্রই দেয়নি! ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁদেরকে আরো একটু জাগিয়ে দেয়া যাক তবে!

নোয়াম চমস্কি একদা বললেন, গণমাধ্যম যার নিয়ন্ত্রণে সে জনমতও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। নিশ্চয়ই এতক্ষণে একটি শ্রেণির কাছে মনে হচ্ছে, এই সরকারের কাছেই তো গণমাধ্যম। তাই এখানে বিপ্লব করা যাচ্ছে না। জনমত তাঁদের বিরুদ্ধে থেকেও রাস্তায় লোক নেমে বলা যাচ্ছে না, হটাও এই সরকারকে!

‘দেশের প্রতি সব সময় অনুগত থাকো। কিন্তু সরকারের প্রতি তখনই অনুগত থাকবে, যখন তা সেটার যোগ্য হবে’—বলেছিলেন মার্ক টোয়েইন।

দেশের একটি শ্রেণি অতিঅবশ্যই এখন বলবেন, ঠিক, ঠিক বলেছেন। তাহলে আরেকটু উসকে দেয়া যাক। ‘এটা আমার নীতি যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা সর্বদা বিজয়ী হওয়া উচিত’—উক্তিটি থমাস জেফারসনের।

চমস্কির গণমাধ্যম আজকের বিশ্বের বাস্তবতায় নানা শ্রেণি-উপশ্রেণিতে উপনীত। শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যমই এখন কোনো রাষ্ট্রের শক্তিশালী সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক শক্তি নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই এখন তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি।

অপরদিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেও একটি দেশের রাজনৈতিক সড়কের চিত্র তুলে ধরা সম্ভব। সবাই বলবেন, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর অধিকাংশই বেশ কয়েক বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবহ হয়ে আদেশক্রমে অনুরোধগুলো রাখছে।

তারা বলবে, মুক্তমত রাখতে গেলে ডিজিটাল আইনে বন্দী করার বিধানও চালু করেছে। আর চলচ্চিত্রের কথা বলছেন? সেন্সর পাবে তা? কাজেই বুঝে নিন, এখানে বিরোধী মত কতটা অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে?

চিৎকার করে তাই সেই সকল শ্রেণিভুক্ত মানুষ মার্ক টোয়েইনের উক্তিকেও জেতাতে চাইবে। তাঁরা তখন বলবে, দেশের প্রতি আনুগত্যে আছি। কিন্তু সরকারের প্রতি নয়। আবার, থমাস জেফারসনকে সম্মান জানিয়ে তারা বলবে, এখানে ভোট হচ্ছে নাকি? সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিজিত হয়ে থাকতে হচ্ছে। তারা বলছে, বলুন, এও সম্ভব?

বাংলাদেশের অধিবাসীরা যে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত নয়, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান ব্যর্থতা হলো—একান্ন বছরের বাংলাদেশের মানুষকে শিক্ষিত করা যায়নি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে না।

একটি দেশের ইতিহাস, স্বাধীনতা, সংবিধান, জাতীয়তা, শাসনরীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্যক ধারণা নিয়ে এই দেশের জনশ্রেণি বেড়ে ওঠেনি। ফলশ্রুতিতে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার হেতু কার্যত থিতু হয় না।

মানুষ ইতিহাসের পেছনের পাতাগুলোকে পড়তে চায় না। আওয়ামী লীগের জন্মের ইতিহাস ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে সফলতার ইতিহাসে প্রধান অস্ত্র হিসাবে তাঁদের কাছে কি ছিল? গণতন্ত্রের বিকাশ তাঁরা প্রত্যাশা করেছিল। এটিই ছিল আওয়ামী লীগের লড়াই।

কাজেই যারা আজকের বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই গণতন্ত্র নেই অথবা ভোটতন্ত্রের ক্যাপসুল খাওয়ার জন্য জল চাইছেন, তাঁদেরকে আয়নার সামনে যেয়ে নিজের চেহারা দেখিয়ে বলতে হবে—আচ্ছা আমার নিজ দলে গণতন্ত্র আছে? দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র আছে? কেন এক দলে একজনই কেবল চেয়ারপারসন হিসাবে আজীবন থাকবেন? কেন যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক উত্তরসূরী হয়ে লন্ডন থেকে একজন দল পরিচালনা করবেন?

খুব সহজ করে বললে বার্ট্রান্ড রাসেলের মতবাদকে তবে সামনে আনতে হবে। যখন তিনি বললেন, গণতন্ত্র হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ সেই ব্যক্তিকে বেছে নেয়, যে দোষ পাবে।

‘দোষ’ তাই একজন শেখ হাসিনা পাচ্ছেন। অথচ, তিনি হলেন সেই শাসক, যিনি জানেন যে, একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। সেই ভুল হল, বাংলাদেশের মানুষকে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায়নি। অবশ্য শিক্ষিত না হতে পারার সবিশেষ কারণও ছিল। যখন, দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতির জনকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। প্রথম ২০ বছরের মধ্যে দুই সেনা শাসকের দেশ শাসনের মধ্য দিয়ে মানুষকে শিক্ষিত করার পন্থা তাই আওয়ামী লীগ বের করতে পারেনি।

চোখে জল আসার উপক্রম সৃষ্টি হয়, যখন এই বেগম খালেদা খানমেরা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধশক্তির গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেয়ার অতি সাহস দেখিয়েছিল। বেগম জিয়া তাই কোনো হাসিনা সরকারের মাধ্যমে আজ শাস্তি ভোগ করছেন না। এমন বাস্তবতাকে প্রকৃতির বিচার বলতেই হবে।

শেখ হাসিনা তাই জানেন, যেহেতু আপামর সকল জনগোষ্ঠিকে শিক্ষিত করা যায়নি, এরা নিজেদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে ঘোষণা করবে, কিন্তু তারাই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের বিরোধিতা করেছিল। কুড়ি বছরের অধিককাল ক্ষমতায় থেকে উক্ত শাসকশ্রেণি কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে দুইটি প্রজন্ম তাই দিকভ্রষ্ট হয়েছিল। তাঁরাই বাংলাদেশের বিপক্ষে, আওয়ামী লীগের বিপক্ষে।

শেখ হাসিনা তাই খুব ভাল করেই বোঝেন যে, তারা এমন রাজনৈতিক কৃষ্টিকে সামনে এনেছিল যে, গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের উক্তি জিতে যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রজাতন্ত্রগুলি গণতন্ত্রে পতিত হয় এবং গণতন্ত্রগুলি স্বৈরাচারে পতিত হয়’।

শেখ হাসিনা তাই প্রশ্ন ছুঁড়ে বলতে পারেন যে, দেশের বিদগ্ধশ্রেণি কি জিয়াউর রহমান কিংবা হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে স্বৈরচার হিসাবে স্বীকৃতি দেয় না?

এতক্ষণে এক পক্ষ চিৎকার করে বলতে চাইবেন, তাহলে শেখ হাসিনা কি? শেখ হাসিনা হলো প্লেটোর দার্শনিক রাজা। বাংলাদেশ যখন, প্রথম কুড়িটি বছর স্বস্তিতে বসবাস করতে পারলো না, অতঃপর দেশের মানুষকে বোকা বানিয়ে প্রতিবেশি আধিপত্যবাদী শক্তির কৃপায় পুনরায় কথিত জাতীয়তাবাদী শক্তি স্বাধীনতার বিরুদ্ধশক্তিকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলো, তখন শেখ হাসিনা বুঝতে পেরেছিলেন, এই দেশের মানুষের কল্যাণেই কেবল কাজ করে যেতে হবে। আমার মূল্যায়ন পরে হোক, তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনই নেই।

এখানেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেখ হাসিনা চরিত্রের মিল। বঙ্গবন্ধু বিদেশি গণমাধ্যমকে একবার সুস্পষ্ট করে বলেছিলেন, আমি আমার দেশের মানুষকে আগে ভালবাসি, এরপর পরিবারকে। একই পথে শেখ হাসিনাও রয়েছেন।

শেখ হাসিনা তাই বাংলাদেশের বামধারার ঘুনে ধরা ম্রিয়মাণ রাজনীতির প্রেক্ষাপটকে অনুধাবন করে বললেন, চলো, কার্ল মার্কসের তত্বকে আরেকটু রঙ্গীন করে এগোতে থাকি। গণতন্ত্র হচ্ছে সমাজতন্ত্রের পথ। কার্ল মার্ক্সের এমন উক্তিকে ধারণ করে শেখ হাসিনা তাই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমে নিজেকে সঁপে দিয়ে মানুষের ভাগ্যান্নয়নে কাজ করতে উৎসুক হলেন।

রাষ্ট্রের শাখা প্রশাখাগুলো জীর্ণ হওয়াতে অনেক ক্ষেত্রে সবকিছু সাবলীল হয়ে ধরা দিচ্ছে না, দেয়নি। আমলাতান্ত্রিক সংকট অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর ওপর অতিমারি কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন রণ-সমাচার হালে সুখে থাকার বন্দোবস্ত করতে পারছে না।

দার্শনিক প্লেটো মনে করতেন যে, ‘কমনওয়েলথগুলি তখনই সুখী হবে যখন হয় দার্শনিকরা শাসন করেন বা শাসকেরা দার্শনিকদের সান্নিধ্য নিয়ে চিন্তাভাবনা ভাগ করে নেওয়ার জন্যও গর্ব বোধ করবেন’।

কিন্তু, বাংলাদেশের একটা শ্রেণি এমন মতবাদের সারমর্ম বোঝার জায়গায় আছে কি? না বুঝতে পারলে, তখন কীভাবে দূরবর্তী সুখকে কাছে টেনে নিয়ে সুখের সমুদ্রে ডুব দিতে পারবে? এই উপলব্ধিই তো নেই।

ঘুরেফিরে যেকোনো শাসকের গণতন্ত্র না দেওয়ার প্রমাণ সামনে আসে, যখন উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, গণতন্ত্র শাসকশ্রেণি কর্তৃক নেই তা প্রমাণ করতে চাইলে সর্বোত্তম যুক্তি হলো, গড় ভোটারের সাথে পাঁচ মিনিটের কথোপকথন।

প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপটের আদ্যপান্ত বিচার করে বলা যায় যে, বৈশ্বিক শাসনরীতির সাথে তাল মিলিয়ে পরাক্রমশালীদের সাথে অভিনয় করে তাঁদেরকে কৌশলে সুখী করাও। আর তুমি নিজেদের উপযোগি শাসন ব্যবস্থা কায়েমে মনোযোগি থেকে প্লেটোর দার্শনিক রাজা হয়ে ম্যাকিয়াভেলির মতবাদে সিক্ত হয়ে ব্যক্তি শাসনকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের রাষ্ট্র পরিচালনা করো। সেখানেই জনশ্রেণির জন্য তবে একদিন না একদিন সুখের সূর্য উদিত হবে।

লেখক: সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :