স্বাধীনতার অবমাননা অগ্রহণযোগ্য

মো. সাখাওয়াত হোসেন
 | প্রকাশিত : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১৭:১০

স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে ১৪ বছরই জেল জুলুম খেটেছেন।তিনি তাঁর সংগ্রামময় জীবনের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের পর্যায়ক্রমে মুক্তি আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ মূলত সুদীর্ঘ ২৩ বছরের মুক্তি সংগ্রাম ও আন্দোলনের ফসল। স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের অপরিসীম আবেগ ও সীমাহীন ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ জয়।

আর যে সকল পরিবারের বীরসংগ্রামীরা শহীদ হয়েছেন, বিভিন্ন সংগ্রামে আত্নাহুতি দিয়েছেন, সেই পরিবারের সদস্যরাই একমাত্র অনুধাবন করতে পারবেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং আপনজন হারানোর মর্মবেদনা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জয় অর্জনে বাঙালি জাতিকে একটি সুদীর্ঘকাল সংগ্রাম করতে হয়েছে, কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। জাতির পিতা বাঙালিকে বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে যুদ্ধের জন্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন বিধায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের নিমিত্তে উজ্জীবিত হয়। কাজেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি একটি পরিকল্পিত ছকের প্রক্রিয়াকে বাস্তবে রূপদানের ফলাফল।

বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য স্বাধীনতাকে নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বাঙালির দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের অর্জন মহান স্বাধীনতার অবিস্মরণীয় বিজয়কে নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছেন! বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তিনি ‘বাই চান্স স্বাধীনতা’ বলে বিগত ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেছেন!

তিনি কি স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এ ধরনের বক্তব্য প্রদান করতে পারেন? দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালি জাতির ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হন, ২ লক্ষ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারায়। এছাড়াও স্বাধীকার আন্দোলনের যাত্রায় অসংখ্য মানুষ আত্নাহুতি দিয়েছেন। তাদের আত্নত্যাগকে আপনারা কিভাবে অস্বীকার করেন?

আর আপনাদের যদি মনে হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তি বাই চান্স, তাহলে আপনারা এ দেশে থাকার অধিকার হারিয়েছেন। কিছুদিন পূর্বে দলটির অন্য একজন শীর্ষ নেতা সংবাদমাধ্যমে বলেন, পাকিস্তান আমলেই তারা ভাল ছিলেন। তাদের এ ধরনের বক্তব্য মূলত তাদের পাকিস্তানপ্রীতির বহিঃপ্রকাশ এবং তারা মনে প্রাণে এখনো স্বাধীন বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি।

একদিকে নির্বাচনের পূর্বে তাদের এ ধরনের বক্তব্য তাদের প্রকৃত অবস্থান সম্বন্ধে জনগনের সামনে তুলে ধরে। অন্যদিকে মহান স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের পাকিস্তান প্রীতিকেও তুলে ধরে। এখনো যে বাংলাদেশে পাকিস্তানের প্রেতাত্নারা বসবাস করে তার প্রমাণ হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের এ ধরনের অশালীন ও আশ্রাব্য বক্তব্য।

বাংলাদেশে সিনিয়র রাজনীতিবিদদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, বিএনপি স্বাধীনতা বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামকে প্রমোট করে এবং রাজনীতিতে জীবন্ত কিংবদন্তী এক প্রবীণ রাজনীতিবিদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, বিএনপি রাজাকারদের গাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছে অর্থাৎ চার দলীয় জোট যখন ক্ষমতায় ছিল তখন জামায়াতের কয়েকজন সদস্য মন্ত্রী হয়েছিল।

পাশাপাশি বিএনপির মধ্যে পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিবিদ আছে এবং তারা এখনো পাকিস্তানের সমর্থনে বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি, এমন অভিযোগও ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দলটির শীর্ষ দুইজন নেতা তাদের পাকিস্তান প্রীতির বিষয়ে যেভাবে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছে তাতে তাদের পাকিস্তান প্রীতি প্রমাণিত হয়েছে।

আপনি এবং আপনারা বাংলাদেশে একটি দলের রাজনীতি করেন, সরকারের সমালোচনা করেন সেসব দোষের নয়। এটা আপনারা আপনাদের মত করে করতেই পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রয়োজন ছিল না, পাকিস্তান আমলে আপনারা ভাল ছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল ‘বাই চান্স’—এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার অধিকার বাংলাদেশের মানুষ আপনাদের কখনোই দেয় নাই। এসব বক্তব্যের মাধ্যমে কার্যত বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের যে পাকিস্তান প্রীতি রয়েছে সে বিষয়ে কারোর কোনরূপ সন্দেহ নেই।

অন্যদিকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে শীর্ষ নেতৃত্ব প্রদানকারী অনেকেই বর্তমান বাংলাদেশের অগ্রগতি ও ধারাবাহিক অগ্রযাত্রা দেখে ‍ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তৎকালিন সময়ের মিডিয়াতে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন পরিস্থিতি নিয়ে সাধারন জনগণ ওয়াকিবহাল ছিলেন না সে বিষয়েও তারা মতামত দিয়েছেন এবং অনেকেই বাংলাদেশের ‍উপর যে ধরনের অত্যাচার নির্যাতন হয়েছিল সেটি ভুলকার্য হিসেবে মতামত দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর মুক্তি আন্দোলনের দীক্ষায় পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দীক্ষিত হয়ে আন্দোলনে নামার ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছেন। অথচ বাংলাদেশের কতিপয় নামধারী রাজনীতিবিদের বক্তব্যে এখনো যে ধরনের পাকিস্তান প্রীতি দেখা যায় সেটি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত।

তবে বিএনপি নেতাদের এ ধরনের দৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য কার্যত বিএনপির জন্য শাপেবর হবে। বিএনপির অনেক নেতাকর্মী শীর্ষ নেতৃবৃন্দের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং এ ঘটনার পর আরও নিবে। শীর্ষ নেতৃত্ব ও তৃণমূলের মধ্যে বিএনপিতে এমনিতেই দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব সংঘাত চলমান, এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি আরো দীর্ঘ ও ত্বরান্বিত হবে। দলের মধ্যে বিভাজন ও বিদ্বেষের সৃষ্টি হবে।

বিএনপিতে অনেক ‍মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারাও আছেন। তারা বিষয়টি অবশ্যই আমলে নিবেন এবং এর ফলশ্রুতিতে দলের মধ্যে একটি বিভাজনের সৃষ্টি হবে, শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে এবং অনেকে পদত্যাগও করতে পারেন। মূলত এ ধরনের অবিবেচকের মত, শ্রীহীন ও উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য প্রদানের জন্য ভোটের রাজনীতিতে বিএনপিকে চরম মূল্য দিতে হবে।

অন্যদিকে যারা তরুণ প্রজন্ম, যারা সদ্য ভোটার কিংবা যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তাদের মধ্যে কতিপয় সংখ্যক বাদে অধিকাংশ জনসাধারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের ওপর প্রবলভাবে বিশ্বাসী ও ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি থেকে আত্নপ্রত্যয়ী। কাজেই এ শ্রেণির ভোটাররা স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীদের কিংবা যারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে খাটো করে দেখাতে চায় তাদেরকে সমর্থনের প্রশ্নই আসে না।

বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশের ইতিহাসকে তথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে, না হলে আপনি যত বড় দলের সংস্পর্শে থাকেন না কেন আপনি তথা আপনাদের ধ্বংস অনিবার্য। কারণ এ দেশের জনগণ পদ্ধতিগত ভাবেই ইতিহাস বিকৃতিকারী তথা দেশবিরোধীদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, এ ধরনের অতীত ইতিহাস বাংলাদেশে অসংখ্য রয়েছে।

সরকারের উচিত হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে যারা কটাক্ষ করবে, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে বক্তব্য প্রদান করবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রয়োজন ছিল না, এমন বক্তব্য প্রদান করবে তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে এ ধরনের বক্তব্য প্রদানকারীদের বিচারের মুখোমুখি করার নিমিত্তে আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। তথাপি এদেরকে কোনভাবে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে একটি পক্ষ সবসময়ই বাংলাদেশের বিরোধিতা করে আসছিল প্রকাশ্য ও গোপনে। এদের মুখোশ ধীরে ধীরে নিজেরাই উন্মোচন করছে। বর্তমান সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়ে ক্রমশ উন্নতি দেখে দেশবিরোধী চক্রটির ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসকে নিয়ে কটাক্ষ করছে। তারা মনে করছে এসবের ফলে তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হবে এবং এ সুযোগটি তারা কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির আবির্ভাব ঘটাতে পারবে। আদতে কি তা সম্ভব? সম্ভব নয় কারণ বাংলাদেশের ইতিহাসের পটভূমি, স্বাধীনতা সংগ্রামের কারণ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশে ও বিদেশে প্রচুর দালিলিক প্রমাণ রয়েছে, সে সবের সহায়তায় তরুণ প্রজন্ম দেশের ইতিহাসকে জেনেছে। সুতরাং তাদেরকে বিভ্রান্ত করার কোনরূপ সুযোগ নেই এবং যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তরুণ প্রজন্মের নিকট তাদের স্থান ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ হবে।

গয়েশ্বরচন্দ্র রায়ের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন ফোরামে বক্তব্যের বিপরীতে প্রতিবাদ জানিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে। অনেকেই বলেছেন, তিনি রাজনীতিবিদ হতে পারেন কিন্তু কোনভাবেই দেশপ্রেমিক নন। আর একজন ব্যক্তি দেশপ্রেমিক না হয়ে কিভাবে রাজনীতিতে আসেন, একটি রাজনৈতিক দলই কিভাবে এদেরকে প্রমোট করে, বিষয়গুলো নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিবিধ বিষয়ের উত্থাপন করে।

প্রকৃত অর্থে এ ধরনের ব্যক্তিদের যে দল প্রমোট করে সেই দলটিই মারত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে, জনগণের নিকট তাদের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে তলানির দিকে চলে যায়। মোদ্দা কথা হচ্ছে, ব্যক্তি আপনি যে বা যিনিই হোন না কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কটাক্ষকারী ও মুক্তিযুদ্ধে বাই চান্স বাংলাদেশ জয়লাভ করেছে-এ ধরনের আপত্তিকর ও মানহানিকর বক্তব্য প্রদানকারীদের স্থান স্বাধীন বাংলাদেশে হতে পারে না।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :