ডায়াবেটিস থেকে আজীবন মুক্ত থাকার প্রাকৃতিক ভেষজ

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৬ মার্চ ২০২৩, ০৮:৩৭

বর্তমানে ডায়াবেটিস মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। ডায়াবেটিসের শিকারের সমস্যা ক্রমশই বাড়ছে। দেখা যাবে যে আমাদের আশেপাশেরই কারো না কারো ডায়াবেটিস আছে।

ডায়াবেটিস হলো একটি বিপাকীয় প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট রোগ। যার কারণে দেহ যথেষ্ট পরিমাণে ইনসুলিন উৎপাদনে অক্ষম হয়ে পড়ে বা ইনসুলিন প্রত্যাখ্যান করে। ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে।রক্তে সুগারের মাত্রা খুব বেশি বেড়ে গেলে ক্লান্তি, ঘন ঘন প্রস্রাব, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দেয়।

ডায়াবেটিসের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টি হলো এই রোগ কখনো পুরোপুরি ভালো হয় না। তবে এর লক্ষণগুলো দূর করা যায় এবং নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

নিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রায় এই রোগ আটকানো প্রয়োজনীয় পরিবর্তন , স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রম, নিয়মিত চেকআপ, ওজন নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। সমস্যায় পড়লে অবিলম্বে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

তবে এমন কিছু প্রমাণিত উপায় রয়েছে যেগুলো নিয়মিতভাবে মেনে চললে আপনি জীবনে কখনো ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবেন না। যদি না আপনার পরিবারের ডায়াবেটিসের কোনো ইতিহাস না থাকে।

ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে রক্তের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং অন্যান্য জটিলতার সম্ভাবনা কমানো। ইনসুলিন অনির্ভর ডায়াবেটিস রোগে খাদ্যনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চিকিৎসাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। অন্যদিকে ইনসুলিন নির্ভর ডায়াবেটিস রোগেও পথ্য একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই কারণে ডায়বেটিস রোগীদের খাবার হতে হবে পুষ্টিকর ও সুষম।

ডায়াবেটিস সাধারণত দুই ধরনের। টাইপ ১ ডায়াবেটিস ও টাইপ ২ ডায়াবেটিস। টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ইনসুলিন উৎপন্ন হয় না। অন্যদিকে, টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপন্ন হয় না অথবা উৎপন্ন হলেও সঠিকভাবে কাজ করে না। কিন্তু ডায়াবেটিসের লক্ষণ বুঝতে পারলে ঘরোয়া উপায়ে এর প্রতিকার সম্ভব।

ডায়াবেটিসের সাধারণ কিছু লক্ষণ হল, ক্লান্তি, ওজন কমে যাওয়া, অনেক বেশি তেষ্টা, ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রবণতা, কাটা স্থান বা ক্ষত শুকোতে সময় লাগা এবং ঝাপসা দৃষ্টি।

নিউইয়র্কের ওয়েল কর্নেল মেডিক্যাল কলেজের একটি গবেষণা বলছে, সঠিক খাবার খাওয়ার পাশাপাশি কোন ক্রমে সেই খাবার খাওয়া হচ্ছে তার উপরেও রক্তের শর্করার পরিমাণ অনেকটা নির্ভর করে। গবেষকদের দাবি, কার্বোহাইড্রেট প্রথমে খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ যতটা বৃদ্ধি পায় তার তুলনায় আগে শাক-সব্জি ও প্রোটিন জাতীয় খাবার খেলে অনেকটাই কম থাকে রক্তে শর্করার মাত্রা। আগে প্রোটিন ও শাক-সব্জি খেলে আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ও দু'ঘণ্টা পর রক্তে শর্করার মাত্রা কম থাকে যথাক্রমে ২৯, ৩৭ ও ১৭ শতাংশ।

প্রতিদিনের অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া, মাত্রাতিরিক্ত ফাস্টফুড, চিনি, কার্বোহাইড্রেট খাওয়া, মদ পান, ধূমপান- এইসবই কিন্তু বাড়িয়ে দেয় ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা। যে কারণে ডায়াবেটিসের সমস্যায় আগেই যেমন রাশ টানতে হবে জীবনযাত্রায় তেমনই খাদ্যাভ্যাসেও আনতে হবে পরিবর্তন।

রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়। কিছু প্রাকৃতিক উপাদানের মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস আক্রান্ত একজন ব্যক্তি শতভাগ সুস্থ থেকে দীর্ঘায়ু লাভ করতে পারেন। ওষুধের ব্যবহার ছাড়া শুধুমাত্র ব্যায়াম, খাদ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এক ঝলকে দেখে নিন কী খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

মেথি

ডায়াবেটিসের সবচেয়ে ভালো একটি প্রতিকার হচ্ছে মেথি। ২ টেবিল চামচ মেথি বীজ ১ গ্লাস জলে ভিজিয়ে রাখুন সারা রাত। সকালে মেথি বীজ-সহ জল পান করুন। মেথি বীজের জৈব উপাদান ইনসুলিনকে উদ্দীপিত করে। এছাড়াও এতে উচ্চ মাত্রার ফাইবার থাকে বলে স্টার্চকে গ্লুকোজে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ধীর করে যা ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের সাহায্য করে।

করলা

করলা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কারণ এটি রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে পারে। ইনসুলিনের নিঃসরণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে করলা। দুই বা তিনটি করলার বীজগুলো ফেলে দিয়ে রস বের করে নিন। করলার রসের সঙ্গে জল মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খান।

দারচিনি

যাদের টাইপ ২ ডায়াবেটিস আছে তাদের জন্য দারচিনি খুবই উপকারী। এটি অগ্নাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে উদ্দীপ্ত করে এবং রক্তের সুগার লেভেল কমায়। দারচিনির গুঁড়া চা, পানি বা অন্য পানীয়ের সঙ্গে মিশিয়ে পান করতে পারেন।

অ্যালোভেরা

অ্যালোভেরা জেলে ফাইটোস্ট্যারলস নামক শক্তিশালী উপাদান থাকে যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ফাইটোস্ট্যারলসের অ্যান্টিহাইপার গ্লাইসেমিক প্রভাব আছে যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের জন্য উপকারী। হলুদ, তেজপাতা ও অ্যালোভেরা জেল জলের সঙ্গে মিশিয়ে দিনে দুবার পান করুন।

আম পাতা

৩-৪ টি আম পাতা জলে ফুটিয়ে নিন। প্রতিদিন সকালে এই মিশ্রণটি খেলে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা কমে। আম পাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে রাখতে পারেন। দিনে দুবার আধা চামচ করে এই আম পাতার গুঁড়ো খেতে পারেন।

পেঁয়াজ

ব্রিটিশ ওয়েবসাইট এক্সপ্রেসের ডায়াবেটিস সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, পেঁয়াজ খাওয়া রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে সস্তা এবং কার্যকর পদ্ধতি। পেঁয়াজের নির্যাস রক্তে শর্করার পরিমাণ ৫০ শতাংশ কমাতে পারে। পেঁয়াজের নির্যাস, অ্যালিয়াম সিপা এবং মেটফরমিন ডায়াবেটিসকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মার্কিন গবেষণা পত্রে এই তথ্য উঠে এসেছে। মেটফরমিন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত বেশি ব্যবহৃত একটি ওষুধ৷ এই গবেষণার গবেষক জানিয়েছেন পেঁয়াজ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে সস্তা এবং সহজলভ্য জিনিস।

নয়ন তারা উদ্ভিদ

ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পেতে নয়নতারা ফুলের গুরুত্ব অপরিসীম। নয়ন তারা গাছের ফুল ও মূল, শুকনো হলে ১ গ্রাম আর কাঁচা হলে ২ গ্রাম এক সঙ্গে করে মাঝারি মাপের ১ কাপ পানি সারা রাত ভিজিয়ে রাখুন। সকালে পানিটা ছেঁকে ফুটিয়ে অর্ধেক কাপ করে নিন। এবার ওই পানি অর্ধেক করে সকাল ও রাতে পান করুন। দিন দশেক ব্যবহারের পর পুনরায় রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। কয়েক দিনের মধ্যেই ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া এবং অন্যান্য উপসর্গ গুলিও কমে গিয়ে নিয়ন্ত্রণে আসবে ডায়াবেটিস অসুখ ।

পনির ফুল

ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণে অব্যর্থ হিসেবে কাজ করে পনির ফুল। প্রাকৃতিক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, পনির ফুল একটি বন্য প্রজাতির ফুল, যা সোলান পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত। পনির ফুলের উৎপত্তি ভারতেই, তাই পনির ফুল ভারতীয় রেনেট নামেও পরিচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ফুলটি শরীরে ইনসুলিনের আরও ভাল ব্যবহারের জন্য অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলোকে সারিয়ে তুলতে কাজ করে। যদি এটি প্রতিদিন অল্প পরিমাণে গ্রহণ করা হয় তবে এটি ইনসুলিনের ভারসাম্য বজায় রাখে। এটি ব্যবহার করা খুবই সহজ। প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে একটি গ্লাসে ১০ থেকে ১২টি ফুল রেখে সারা রাত রেখে দিন। তারপর এই পানি সকালে খালি পেটে ছেঁকে পান করুন। সুষম খাদ্য এবং পনির ফুলের সাহায্যে আমরা অবশ্যই ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি এমনটাই দাবি করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চর্বিযুক্ত মাছ

চর্বিযুক্ত মাছের তালিকায় রয়েছে স্যালমন, সার্ডিন, হেরিং ইত্যাদি মাছ। যে সব মাছ ওমেগা-৩-ফ্যাটি অ্যাসিড পূর্ণ, যে সব মাছ ডিএইচএ এবং ইপিএ-এর বড় উৎস সে সব মাছই পারে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এছাড়াও নিয়মিত এই সব মাছ খেলে হৃদরোগের ঝুঁকিও কিন্তু কমে যায় অনেকটাই। এছাড়াও এই সব খাবারে থাকে ওমেগা-৩ব ফ্যাটি অ্যাসিড। যা আমাদের শরীরের জন্য কিন্তু খুবই ভাল।

ডুমুর

পুষ্টিবিদের মতে, ডায়াবেটিসের রোগীদের ওপর দারুণ প্রভাব ফেলে ডুমুর। ডুমুরের মধ্যে ফাইবারের পরিমাণ বেশি। ফাইবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ রিসার্চ ইন ফার্মেসি অ্যান্ড বায়োসায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণায় অনুযায়ী, ডুমুরে হাইপোগ্লাইসেমিক উপাদান রয়েছে, যা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারে। গবেষকরা দেখেছেন যে ডুমুর পাতা ইনসুলিন প্রতিরোধের উন্নতিতেও উপকারী।

ডায়াবেটিস গাছ গায়নূরা প্রোকাম্বেন্স

‘গায়নূরা প্রোকাম্বেন্স’ নামের এ ওষধি গাছ ডায়াবেটিস সারাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। চীনে এন্টি ভাইরাস হিসেবেও এটির ব্যবহার আছে। ‘গায়নূরা প্রোকাম্বেন্স’ গাছটির বোটানিক্যাল নাম হলেও ইংরেজিতে একে ‘সাবুঙ্গা’ এবং চীনে এটিকে ‘জিয়ান ফেঙ উইই’ বলা হয়। যাদের ডায়াবেটিস, প্রেশার এবং কোলেস্টেরল আছে তারা প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ২টি পাতা সেবন করলে এসব রোগ থেকে বাঁচা যাবে। তবে যারা ইনসুলিন ব্যবহার করেন এবং গ্যাস্ট্রিকে আক্রান্ত তাদেরকে সকালে খালি পেটে ২টি পাতা ও রাতে শোবার আগে ২টি পাতা সেবন করতে হবে।

শরীরচর্চা

শরীরচর্চা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সহায়ক সেরা ব্যায়ামগুলোর একটি হাঁটাহাঁটি। এই একটা মাত্র রোগেই আমরা শরীরচর্চা বা ব্যায়ামকে ওষুধ হিসাবে দেখে থাকি। কারণ একজন ডায়াবেটিসের রোগী যখন হাঁটতে শুরু করেন বা ব্যায়াম করতে শুরু করেন তখন তার শরীরের ইনসুলিন এর কার্যকারিতা কমে যায়। তখন তার নিজের দেহের ইনসুলিন নিজের দেহে বেশি করে কাজ করতে শুরু করে। প্রতিটি কোষগুলো তখন ইনসুলিনের প্রতি সেনসিটিভ হয়ে যায়। তখন আপনাকে নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হবে না। প্রতিদিন অন্তত ৪০মিনিট হাঁটাহাঁটি করলেই আপনার বিপাকীয় হার এমন পর্যায়ে থাকবে যা আপনার দেহে ইনসুলিনের মাত্রাকেও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রাখতে যথেষ্ট। ফলে ডায়াবেটিসেরও ঝুঁকিও কমে আসবে।

(ঢাকাটাইমস/০৬ মার্চ/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :