শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতের দিন হোক পহেলা মে

সাফা আক্তার নোলক
  প্রকাশিত : ০১ মে ২০২৩, ০৯:২৮| আপডেট : ০১ মে ২০২৩, ১১:১৬
অ- অ+

শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের দিন পহেলা মে বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। মে দিবস পালনের মূল লক্ষ্য শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্যটি বাস্তবে সংরক্ষণ করা হোক বা না হোক তবে এই মর্মেই প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস।

মে মাসের প্রথম এই দিনটিকে শ্রমিক দিবস হিসেবে সরকারিভাবে পালন করে আসছে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশ। এছাড়াও বেসরকারিভাবে অন্যান্য কিছু দেশে পালিত হয়ে আসছে এই দিনটি। বিশ্বের ৮০টি দেশে একাধারে পালন করা এই দিনটির পেছনে রয়ে গেছে এক ইতিহাস। ঘটনাটি ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেট এর ম্যাসাকার শহিদদের। সেদিন দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে শহরের শ্রমিকেরা জমায়েত হয়েছিল। সেখানে এক অজ্ঞাতনামা সেদিন জমায়েত হওয়া শ্রমিকদের ঘিরে থাকা পুলিশদের প্রতি বোমা নিক্ষেপ করে। যার প্রেক্ষিতে পুলিশের গুলিবর্ষণ শুরু হয় এবং নিহত হয় ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ। পরবর্তীতে জমায়েত হওয়া সেই শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘন্টা কাজের সেই দাবি আদায় হয়। আর এই মর্মেই প্রতিবছর পালিত হচ্ছে এই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসটি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিবসটি একযোগে পহেলা মে তে পালন করা হলেও আমেরিকা এবং কানাডাতে এই দিবসটি পালিত হয় সেপ্টেম্বর মাসে।

দেশের অর্থনীতি কিংবা উন্নয়ন উভয় খাতেই শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির পরিমাণ ৫ কোটি ৬৭ লাখ লোক। এই বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত দেশের অগ্রগতিতে অবদান রেখে যাচ্ছে। আর এই বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করাই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশের এই সংখ্যক জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুরুষ শ্রমশক্তির পরিমাণ ৩ কোটি ৯৫ লাখ এবং নারী শ্রমশক্তির পরিমাণ ১ কোটি ৭২ লাখ।

বাংলাদেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রাখছে দেশের অগ্রযাত্রাতে। কিন্তু বিপরীতে তারা অনেক সময় বঞ্চিত হচ্ছে তাদের নিজ ন্যায্য অধিকার থেকেও। অপ্রত্যাশিত হলেও সত্যি যে দেশের এই বিশাল সংখ্যক শ্রমিকদের ৯২ শতাংশের কোনো প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। তারা অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক হিসেবে পরিচিত। আর যেহেতু তাদের প্রাতিষ্ঠানিকতার কোনো স্বীকৃতি নেই তাই তাদের শ্রমের ন্যায্য মূল্যও নেই তাদের।

শ্রম দিবসের পর্যালোচনায় বাংলাদেশের এক বিশাল শ্রমজীবী শ্রেণির কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে তৈরি পোশাক খাতে কাজ করা শ্রমিকদের কথা। এরা দেশের রপ্তানি খাতে অবদান রেখে, দেশের অর্থনীতিকে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে এক সম্ভাবনার দিকে। বিজিএমইএ এর হিসেবে শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এই পোশাক খাতের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তাদের ও অনেক সময় আদায় হচ্ছে না ন্যায্য অধিকার। তাদের নেই কোনো সুরক্ষা কিংবা সুনির্দিষ্ট মজুরি। কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট থাকলেও করতে হয় ওভারটাইম। নেই তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এর বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে কাজ করেন কিন্তু কোনো মজুরি পান না এমন মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ১১ লাখ। এর সাথে শ্রমশক্তির ১ কোটি ৬ লাখ মানুষ দিনমজুর যাদের প্রতিদিনের কাজের কিংবা মজুরির নেই কোনো নিশ্চয়তা। দেশের পোশাক কারখানাসহ ৫৪ ধরনের শিল্পে সর্বনিম্ন একটি মজুরি বেঁধে দিলে ও শ্রমশক্তির এক বিশাল অংশ রয়েছে অনিশ্চিয়তার।

শ্রমশক্তির এই বিশাল অংশে রয়েছে তাদের অনিশ্চিত জীবনযাপন ও মৃত্যু ঝুঁকি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) হিসেবে, ২০২১ সালে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায়, ২০২১ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৫৩ জনের মৃত্যু হয়; এর মধ্যে ১ হাজার ৩ জন পুরুষ এবং ৫০ জন নারী শ্রমিক। এ সময়ে আহত হয়েছিলেন ৫৯৪ জন।

২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় বিভিন্ন খাতে ৭২৯ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল; এর মধ্যে ৭২৩ জন পুরুষ এবং ৬ জন নারী ছিলেন। অর্থাৎ ২০২১ সালে ২০২০ এর তুলনায় মৃত্যু বেড়ে যায় ৩২৪ জন অর্থাৎ মৃত্যু বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল শতকরা ৪৪%।

বিলসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২১ সালে মৃত্যুর মধ্যে পরিবহন খাতে মৃত্যুর সংখ্যা সবচাইতে বেশি। পরিবহন খাতে ৫১৩ জন, নির্মাণ খাতে ১৫৪, কৃষি খাতে ৮৭ জন, খাদ্য উৎপাদনকারী শিল্পে ৫৫ জন, দিনমজুরদের মধ্যে ৪৬ জন, মৎস ও মৎস শ্রমিকদের মধ্যে ২৭ জন, নৌ-পরিবহনে ২৪ জন, অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে ১৮ জন, জাহাজ ভাঙা শিল্পে ১২ জন, বিদ্যুৎ খাতে ১১ জন, তৈরি পোশাক খাতে ১১ জন এবং অন্যান্য খাতে ১০২ জনের মৃত্যু ঘটে।

বিলসের তথ্যানুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনা, বিদ্যুৎষ্পৃষ্ট হওয়া, বজ্রপাত, অগ্নিকাণ্ড, উপর থেকে পড়ে যাওয়া, পড়ন্ত বস্তুর আঘাত, বিষাক্ত গ্যাস, নৌ দুর্ঘটনা, দেয়াল বা ছাদ ধসে পড়া, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ইত্যাদি কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক দুর্ঘটনা গুলোর অন্যতম কারণ।

বিলসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে বিভিন্ন খাতে ৪৩১টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে; এর মধ্যে ১৭২টি শ্রমিক অসন্তোষ ঘটে তৈরি পোশাক খাতে। এছাড়াও বিলসের তথ্যানুযায়ী জানা যায়, ২০২১ সালে ২৮৬ জন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এর মধ্যে ২৩২ জন পুরুষ ও ৫৪ জন নারী।

নির্যাতিতদের মধ্যে ১৪৭ জনের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া ১২৫ জন আহত, ৬ জন নিখোঁজ, ২ জনের ক্ষেত্রে আত্মহত্যা, ৫ জন অপহৃত হওয়ার পর উদ্ধার হয়েছেন।

২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ২৩২ জন শ্রমিক।

বিলস এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে ৩০০ জন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রের বাহিরে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যাদের ১৯১ জনেরই মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ৭০ জন আহত, ৩ জন নিখোঁজ, ২৬ জনের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

অপহৃত অবস্থা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল ৮ জনকে। এদের মধ্যে ২১৫ জন পুরুষ এবং ৮৫ জন নারী শ্রমিক।

তৈরি পোশাক খাতে কর্মক্ষেত্রের বাইরে ৮৭ জন শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলে, যার মধ্যে ৩০ জন নিহত, ৩৭ জন আহত ও ২ জন নিখোঁজ রয়েছেন। আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ১৩ জনের ক্ষেত্রে। ৩ জনকে অপহৃত হওয়ার পর উদ্ধার করা হয়েছে। অর্থাৎ এতেই বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবস্থান।

পহেলা মে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের জন্যই নয়, বরং এটি শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতের এক প্রতিশ্রুতি। অর্থাৎ শুধুমাত্র দিবস হিসেবে এটিকে পালন না করে রক্ষা করতে হবে এর যথার্থ মর্মার্থ। সঠিক অধিকার ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বজায় থাকুক শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে। কারণ তারা আমাদের দেশের অগ্রগতিতে প্রতিনিয়ত অবদান রেখে যাচ্ছে। তাই তাদের যথার্থ অধিকার নিশ্চিত একান্তই কাম্য।

সাফা আক্তার নোলক, শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
মোহাম্মদপুরে ৩৮০০ পিস ইয়াবাসহ মাদক কারবারি গ্রেপ্তার
সাংবাদিক সাইদুরের প্রাণনাশের হুমকির প্রতিবাদে সাতক্ষীরায় বিক্ষোভ 
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যার তদন্ত রিপোর্ট দাখিল সোমবার
এবার বাংলাদেশের চার টিভি চ্যানেল ইউটিউবে বন্ধ করল ভারত
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা