কম্পিউটারের ক্যারিশমায় ৪০০০ কোটি টাকা লুট

রুদ্র রাসেল, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৮ মে ২০২৩, ১৩:৫১ | প্রকাশিত : ১৮ মে ২০২৩, ০৯:৩৪

‘শুধু একটি কম্পিউটার ব্যবহার করে কাগুজে প্রতিষ্ঠান বানিয়ে তা দিয়ে কীভাবে রাতারাতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট করা যায় পি কে হালদার তার নজির।’

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারির হোতা ভারতের কারাগারে বন্দি প্রশান্ত কুমার ওরফে পি কে হালদার সম্পর্কে এমন মন্তব্যই করা হয়েছে।

তবে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পি কে হালদার মোট কত টাকা লোপাট করেছেন, তার নির্দিষ্ট হিসাব পেতে গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছে দুদক। এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে ৩ হাজার কোটি টাকা পাচারসহ ৪ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণ পেয়েছে এ সংস্থাটি।

যদিও দুদক পি কে হালদার ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছিল। তদন্তের এ পর্যায়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাটের প্রমাণ এসেছে দুদকের হাতে।

দুদক থেকে পাওয়া সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংসহ অন্যান্য অভিযোগে ৫২টি মামলা করেছে দুদক। এর মধ্যে ৩৮টি মামলাই পি কে হালদারের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় ৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।

ওই ৫২ মামলার মধ্যে প্রথম দায়ের করা মামলাটির বিচারকাজ চলছে। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি ২৭৫ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়। কিন্তু মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসে পি কে ও পি কে সিন্ডিকেটের ৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য।

এরপর এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি পি কে হালদারসহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিলের অনুমোদন দেয় দুদক। এরপর ৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগ এনে ২০২১ সালের নভেম্বরে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়।

মামলাটির ১০৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ১০২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। চলছে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আসামি পক্ষের আইনজীবীর জেরার পর্ব। গতকালও ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০ এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের আদালতে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এদিন তার জেরা শেষ না হওয়ায় আগামী ২৪ মে দিন ধার্য করেছেন আদালত।

আরও পড়ুন>> লুটপাট হয়ে যাচ্ছে পি কে হালদারের ক্রোক করা সম্পদ

গতকাল জেরা শুরুর আগে কারাগারে থাকা চার আসামি অবন্তিকা বড়াল, শংখ বেপারী, সুকুমার মৃধা ও অনিন্দিতা মৃধাকে আদালতে হাজির করা হয়। পি কে হালদারসহ ১০ আসামি পলাতক রয়েছেন। পি কে ছাড়া বাকি পলাতকরা হলেন, পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, পূর্ণিমা রানী হালদার, উত্তম কুমার মিস্ত্রি, অমিতাভ অধিকারী, প্রীতিশ কুমার হালদার, রাজীব সোম, সুব্রত দাস, অনঙ্গ মোহন রায় ও স্বপন কুমার মিস্ত্রি।

দুদকের একজন মহাপরিচালক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মামলা তদন্তে পি কে হালদারের আরও অর্থ আত্মসাত ও পাচারের প্রমাণ মিলতে পারে। সে ক্ষেত্রে লোপাট ও পাচারের অর্থের পরিমাণ বেড়ে যাবে। আর ভারতে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে যেসব মামলা চলছে, তার ওপরই নির্ভর করছে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি।’

পি কে হালদারকে ফেরানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ভারতের সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি।’

আরও পড়ুন>> বাংলাদেশি সুকুমার মৃধা কীভাবে ভারতে বিপুল সম্পদ কিনলেন?

পি কে হালদারের মামলাগুলোর তদন্ততকারী কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বুধবার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘একটি মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। বাকি মামলা তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পি কে হালদার ও তার পুরো চক্রটির বিরুদ্ধে জোরদার তদন্ত করছি। এই সময়ে তাদের যেসব সম্পদ তদন্তের আওতায় এসেছে তা আদালতের আদেশে ক্রোক করা হয়েছে।’

এদিকে দুদকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘একটি কম্পিউটার ব্যবহার করেই পি কে হালদার ৩০টির বেশি কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে দেশের আর্থিক খাত থেকে লোপাট করেন ২০০০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব না থাকলেও ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে তার মাধ্যমেই অতি সুক্ষ্ম চক্রান্তে ওই অর্থ লুট করা হয়। দুদকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পি কে হালদার সিঙ্গাপুর, ভারত এবং কানাডায় চারশ কোটি টাকার বেশি পাচার করেছেন। কানাডার টরেন্টোতে মার্কেট কিনেছেন, বিলাসবহুল বাড়ি ক্রয় করেছেন।

আরও পড়ুন>> কলকাতার সিবিআই স্পেশাল কোর্টে পিকে হালদার সংক্রান্ত দুদকের নথি

প্রতিবেদন বলা হয়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ঋণের নামে যাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান টাকা লুট করে, প্রায় একই মালিকানাধীন আরো প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান এফএএস ফাইন্যান্স, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং পিপলস লিজিং থেকে একই কায়দায় ঋণের নামে টাকা তুলে আত্নসাত করে। এসব ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ নেই বললেই চলে। ফলে ঋণ পরিশোধ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্সের প্রায় ৩০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে মর্টগেজ ছাড়াই প্রায় ২০০০ কোটি টাকা জালিয়াতিপূর্ণ ঋণ প্রদানের রেকর্ড পেয়েছে দুদক। আরবি এন্টারপ্রাইজ, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজ, তামিম এন্ড তালহা এন্টারপ্রাইজ, ক্রসরোড কর্পোরেশন, মেরিন ট্রাস্ট, নিউটেক, এমএসটি মেরিন, গ্রীন লাইন ডেভেলপমেন্ট, মেসার্স বর্ণসহ প্রায় ৩০টি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে ভিন্নখাতে এ অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে। পি কে হালদার, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান, এমডিসহ প্রায় ৭৫ জনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এতে।

দুদকের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কাগুজে-ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে জালিয়াতি করে নেওয়া এসব ঋণের অর্থ নানা পর্যায় পেরিয়ে যোগ হতো পি কে হালদারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। পি কে হালদার বিভিন্ন কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) নামের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেন। এসব কোম্পানি থেকে তিনি ঋণের নামে বিপুল অঙ্কের টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন।

অন্যদিকে পি কে ও পি কে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মামলার তদন্তকালে এখন পর্যন্ত ১২ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পিকে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারী, রাশেদুল হক, অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ ১০ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ছাড়া এক হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে আদালতের মাধ্যমে ৬৪ জনের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।

২০১৯ সালে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের মধ্যে দেশ থেকে পালিয়ে যান পিকে হালদার। এ সময় তার দুর্নীতি ফাঁস হলে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। একপর্যায়ে ২০২২ সালের ১৪ মে পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার করে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। একইসঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় তার ভাই প্রাণেশ হালদার, স্বপন মিস্ত্রি ওরফে স্বপন মৈত্র, উত্তম মিস্ত্রি ওরফে উত্তম মৈত্র, ইমাম হোসেন ওরফে ইমন হালদার এবং আমানা সুলতানা ওরফে শর্মী হালদারসহ বাকি অভিযুক্তদের।

গত বছরের ১১ জুলাই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কলকাতার আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় ইডি। অর্থপাচার আইন-২০০২ এবং দুর্নীতি দমন আইন-১৯৮৮’র বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। বর্তমানে অভিযুক্ত পি কে হালদারসহ ৫ জন রয়েছেন ভারতের প্রেসিডেন্সি কারাগারে। আর এ মামলার একমাত্র নারী আসামি আমানা সুলতানা রয়েছেন দেশটির আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে।

(ঢাকাটাইমস/১৮মে/আরকেএইচ/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

সোনার ধানের মায়ায় হাওরে নারী শ্রমে কৃষকের স্বস্তি

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর বার্তা দেবে আ. লীগ 

গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন: চাহিদা বেড়েছে তরমুজের, ক্রেতা কম ডাবের

গাছ কাটার অপরাধে মামলা নেই 

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

উইমেন্স ওয়ার্ল্ড: স্পর্শকাতর ভিডিও পর্নোগ্রাফিতে গেছে কি না খুঁজছে পুলিশ

জাবির হলে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে জঙ্গলে ধর্ষণ, কোথায় আটকে আছে তদন্ত?

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :