বাজেট ২০২৩-২৪
আয় সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি হলে কর দিতে হবে
চলতি বাজেটে বছরে তিন লাখ টাকার বেশি আয় থাকলেই আয়কর দিতে হতো। কিন্তু আসন্ন বাজেটে করমুক্ত এই আয়ের সীমা বৃদ্ধি করে সাড়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ যারা বছরে সারে তিন লাখ টাকার বেশি আয় করবেন তাদের কর দিতে হবে। আর সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করলে কোনো আয়কর দিতে হবে না।
আসছে বাজেট ২০২৩-২৪ এর সারসংক্ষেপ থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সাধারণ করদাতাদের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমায় ৫০ হাজার টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা। ফলে বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি আয় হলেই কর দিতে হবে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট হবে প্রায় সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাজেটের আকার। আগামী ১ জুন জাতীয় সংসদে আগামী অর্থ বছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
এদিকে সাধারণ করদাতাদের আয়ের সীমা বৃদ্ধির এ প্রস্তাবনাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান এ ব্যাপারে ঢাকা টাইমসকে বলেন, সাধারণ করদাতাদের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। আর ধনীদের ওপর কর আরও বাড়াতে হবে। কেননা, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে কর আদায়ের ক্ষেত্রে আরও নমনীয় হওয়া প্রয়োজন।
তবে ধনীদের কর আরও বৃদ্ধিসহ গ্রামাঞ্চলে করজাল বিস্তারের প্রস্তাবও রয়েছে বাজেটের সারসংক্ষেপে। যদিও করোনা মহামারি চলাকালে ধনী করদাতাদের আয়কর ৫ শতাংশ কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছিল। এবার সেই ৫ শতাংশের সঙ্গে আরও কর বৃদ্ধির পরিকল্পনা যুক্ত করা হয়েছে আসছে বাজেটে।
রাজস্ব বোর্ড সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করতে আগামী তিন অর্থবছরে বাংলাদেশকে রাজস্ব হিসেবে দুই লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে বাজেটে বিদ্যমান সারচার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হবে। যাতে ধনীদের উচ্চ কর দিতে হয়।
এদিকে আয় বৈষম্য বাড়ার কারণে ধনীদের কাছ থেকে বেশি কর আহরণ করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যয় বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ (ধনীদের) আয়কর ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছিল। আগামী বাজেটে তা আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া উচিত।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে প্রথম ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর কর দিতে হয় না। ৩ লাখ টাকার পরবর্তী ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে মোট আয়ের ওপর ৫ শতাংশ কর দিতে হয়। পরবর্তী ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে আয়ের ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫ শতাংশ এবং পরবর্তী ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ২০ শতাংশ কর দিতে হয়। এর বেশি আয় করলে সেক্ষেত্রে করহার ২৫ শতাংশ।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয়কর খাত থেকে ১ লাখ ২১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এ খাত থেকে রাজস্ব এসেছে ৭০ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর আগে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে আয়কর খাত থেকে ৮৪ হাজার ৫২২ কোটি টাকার রাজস্ব সংগ্রহ করে এনবিআর।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়বে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি এবং দেশের মোট জিডিপির ১০ শতাংশের সমান। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ বেশি।
আগামী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার ৬০ হাজার কোটি টাকা। আর এনবিআরবহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা ও করবহির্ভূত রাজস্ব (এনটিআর) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।
বাড়বে জমি নিবন্ধন খরচ
আগামী অর্থবছরে জমি নিবন্ধনের খরচও বাড়তে পারে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এলাকায় বর্তমানে জমি বা বাড়ি বিক্রয়ের দলিল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে মোট মূল্যের ওপর ৪ শতাংশ হারে কর কাটা হয়। আগামীতে তা বেড়ে ৫ শতাংশ হতে পারে। এ ছাড়া রাজউক এবং সিডিএবহির্ভূত এলাকায় জমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কর ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ শতাংশ হতে পারে।
ট্রাস্টের বিষয়ে যে প্রস্তাব
ট্রাস্টের আয়ের বিপরীতে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চালু করতে এবং চলমান রাখতে রিটার্ন দাখিল ও যাচাই করার বিধান প্রবর্তন করতে যাচ্ছে এনবিআর। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এ পরিবর্তন আসতে পারে।
সূত্র জানায়, আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ অনুযায়ী ট্রাস্ট একটি করযোগ্য সত্তা। কিন্তু ট্রাস্টগুলো নিয়মিতভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল ও কর পরিশোধের বিধান পরিপালন করছে না। বিভিন্ন কোম্পানি কর ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে নানা নামে ট্রাস্ট গঠন করে নিজস্ব আয় গোপন করে। ট্রাস্ট ও ট্রাস্ট জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক লেনদেন নিয়মিত মনিটরিংয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো এজেন্সি না থাকায় কিছু ক্ষেত্রে ট্রাস্টের অর্থ সন্ত্রাসে অর্থায়ন এবং অর্থ পাচারে ব্যবহৃত হচ্ছে। আগামী বাজেটে ট্রাস্টের আয়ের বিপরীতে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করলে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি কর ফাঁকি রোধ করাও সম্ভব হবে বলে মনে করছে সরকার।
করজাল বিস্তার হচ্ছে গ্রামেও
জানা গেছে, আগামী অর্থবছর গ্রামাঞ্চল থেকে কর সংগ্রহ করতে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বেসরকারি কর সংগ্রহ এজেন্ট নিয়োগ করার কথা ভাবা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে বাজেটের অর্থ বিলে ‘ইনকাম ট্যাক্স প্রিপেয়ারার (আইটিপি)’ নামে একটি নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যার খসড়াও প্রস্তুত করা হয়েছে।
দেশীয় শিল্পকে অগ্রাধিকার
এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশীয় শিল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা হবে। আগে টিভি, ফ্রিজ বিলাসী পণ্য ছিল, এখন আর সেটি নেই। এখন এগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। এসি আমদানিতে শুল্কহার আগের চেয়েও বাড়ানো হতে পারে। তুলনামূলক একই দামে আমদানি করা এসি পেলে কেউ দেশীয় এসি কিনতে উৎসাহিত হবে না।
আমদানি করা গাড়ি, ফ্রিজ ও এসির মতো পণ্যের দাম বাড়ার ইঙ্গিত দিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, কিছু পণ্যের অগ্রিম আয়কর (এআইটি) বাড়ানো হতে পারে। অথবা সব ধরনের সম্পূরক শুল্ক ও হার বাড়ানো হতে পারে।
ঢাকাটাইমস/২০মে/আরআর/ইএস