মৌলভিত্তির শেয়ার দর পড়ে থাকার নেপথ্যে কারা?

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ০৭ জুন ২০২৩, ১১:২৮ | প্রকাশিত : ০৭ জুন ২০২৩, ০৮:৫০

মৌলভিত্তি আছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) তালিকাভুক্ত এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার কেনাবেচা নেই বললেই চলে। নেপথ্য কারণ কী?

বছরের পর বছর ভালো ডিভিডেন্ট (লভ্যাংশ) দেওয়া এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। কারণ কি?

দুর্বল ক্যাটাগরির শেয়ারে বিনিয়োগ করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাই কি কারসাজি চক্রকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন না? এই প্রশ্ন বিশ্লেষক, বিনিয়োগকারীসহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট অনেকেরই।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গ্যাম্বলিংয়ে যুক্ত। দুর্বল নিম্নমানের জেড ক্যাটাগরির শেয়ার অর্থাৎ যেসব প্রতিষ্ঠান ডিভিডেন্ট পায় না, তাদের শেয়ারে বিনিয়োগ করছে এক শ্রেণির ব্রোকার হাউজসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। মৌলভিত্তি শেয়ারের বদলে তারা দুর্বল প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দিকেই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঝোঁকানোর চেষ্টা চালিয়ে থাকেন বিভিন্ন কৌশলে।

এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মৌলভিত্তি কোম্পানির শেয়ারের যেভাবে চাহিদা থাকা দরকার, তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম মৌলভিত্তি (দুর্বল কোম্পানি) শেয়ারের চাহিদা বেশি। বিষয়টি আমরাও লক্ষ্য করেছি।’

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘যারা বিনিয়োগকারী তাদের মৌলভিত্তি শেয়ার বোঝার মতো হয়তো পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই। এছাড়া অন্যান্য শেয়ার বলতে দুর্বল কোম্পানির বা মৌলভিত্তি তুলনামূলক কম, এমন কোম্পানির যে শেয়ারগুলো কেনাবেচা হচ্ছে তা নিয়ে ট্রেডাররা ট্রেডিং করতে পারেন। তবে যদি অস্বাভাবিক কিছু দেখা যায় বা কোনো পক্ষের মাধ্যমে কিংবা কোনো গুজব বা প্রলুব্ধ হয়ে দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে সেক্ষেত্রে সেটা বিনিয়োগকারীদের দুর্বলতাই বোঝায়।’

বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘বিষয়টি নজরে আসায় বিনিয়োগকারীদের মৌলভিত্তি শেয়ারের বিষয়ে বোঝাতে অফলাইনে, অনলাইনে বিভিন্ন উপায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে বিএসইসির পক্ষ থেকে। আমরা বিনিয়োগকারীদের মৌলভিত্তি বোঝানোর চেষ্টা করছি।’

‘গ্লোবালি ইকুইটির পাশাপাশি ট্রেড প্রোডাক্টও থাকে মৌলভিত্তির জন্য। মৌলভিত্তি শেয়ারে বিনিয়োগ বাড়াতে বিএসইসির পক্ষ থেকে আমরা আরও মৌলভিত্তি প্রতিষ্ঠানকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছি।’

এছাড়া যে বিনিয়োগকারীরা মৌলভিত্তি বোঝেন না তাদের মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেন বিএসইসির এ কমিশনার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মৌলভিত্তির শেয়ার বাদ দিয়ে জেড ক্যাটাগরির বা দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করার পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরও দায় আছে। ডিভিডেন্ট দেয় না বা নামমাত্র ডিভিডেন্ট দেওয়া দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে জুয়াড়ি (গ্যাম্বলার) চক্রকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা হাতিয়ে নেয়।

এদিকে পুঁজিবাজারে রাজত্ব করছে স্বল্প মূলধনি, লোকসানি ও হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি। বিপরীতে বছরের পর বছর ধরে ভালো লভ্যাংশ দেওয়া মৌলভিত্তির বড় মূলধনী কোম্পানির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায় না।

উদাহরণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাটা সু, রেকিট বেনকিজার, মেরিকো বাংলাদেশ, ইউনিলিভার, লিন্ডেবিডি, রেনেটার মতো কোম্পানিগুলো ভালো মৌলভিত্তির। অথচ, এসব শেয়ারের দর পড়ে আছে। দাম উঠছে মেঘনা লাইফের মতো দুর্বল শেয়ারের। এ কোম্পানি গত ২০২২ সালের ডিভিডেন্ট এখনো দিতে পারেনি। আর ২০২১ সালের ডিভিডেন্ট ক্যাশ হিসেবে মেঘনা লাইফ দিয়েছে ১৫%, ২০২০ সালে ১৫%।

ইন্স্যুরেন্স খাতের এ কোম্পানির শেয়ারদর গত এক মাসের কম সময়ের ব্যবধানে রাতারাতি ফুলে-ফেঁপে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেঘনা লাইফের যে শেয়ার ১৫ দিন আগে ৬৭ টাকা ছিল, গতকাল দাম উঠেছে ১১৬ টাকা ৬০ পয়সা।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মৌলভিত্তি প্রতিষ্ঠান রেকিট বেনকিজার ২০২২ সালের ডিভিডেন্ট ৯৮০%, ২০২১ সালে ১৬৫০% আর ২০২০ সালে ১৪০০%। মেরিকো বাংলাদেশ ২০২২ সালে ডিভিডেন্ট দিয়েছে ৮০০%, ২০২১ সালে ৯০০% আর ২০২০ সালে ৯৫০%, ইউনিলিভার কনজুমার কেয়ার লি. ২০২২ সালে ডিভিডেন্ট দিয়েছে ২৪০%, ২০২১ সালে ৪৪০% আর ২০২০ সালে ৪৪০%। বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লি. ২০২২ সালে ডিভিডেন্ট দিয়েছে ৪০০%, ২০২১ সালে ৩৭৫% আর ২০২০ সালে ২৯৫%। লিনডি বাংলাদেশ লি. ২০২২ সালে ডিভিডেন্ট দিয়েছে ৪২০%, ২০২১ সালে ৫৫০% আর ২০২০ সালে ৪০০%। রেনেটা ২০২২ সালে ডিভিডেন্ট দিয়েছে ১৪০%, ২০২১ সালে ১৪৫% আর ২০২০ সালে ১৩০%। বাটা সু ২০২১ সালে ডিভিডেন্ট দিয়েছে ৭৫%, আর ২০২০ সালে ২৫%। ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো ২০২২ সালে ডিভিডেন্ট দিয়েছে ২০০%, ২০২১ সালে ২৭৫% আর ২০২০ সালে ৬০০%। ইউনাইটেড পাওয়ার ২০২২ সালে ডিভিডেন্ট দিয়েছে ১৭০%, ২০২১ সালে ১৭০% আর ২০২০ সালে ১৪৫%। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ২০২২ সালে ডিভিডেন্ট দিয়েছে ১০০%, ২০২১ সালে ৬০% আর ২০২০ সালে ৪৭%। বেক্সিমকো ফার্মা ২০২২ সালে ডিভিডেন্ট দিয়েছে ৩৫০% ও ২০২১ সালে ৩৫০%। একইভাবে মতিন স্পিনিং ২০২২ সালে ডিভিডেন্ট দিয়েছে ৫০%, ২০২১ সালে ৪০% আর ২০২০ সালে ১৮%।

প্রতি বছর এত ভালো লভ্যাংশ দিয়ে আসা এসব প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। একটি চক্রের যোগসাজশে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করানো রেখে দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে আকৃষ্ট ও প্রলুব্ধ করছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারের দাম না বাড়লে, বিনিয়োগ না বাড়ালে বাজারের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন। এছাড়া মৌলভিত্তি শেয়ারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ না হওয়ায় এসব কোম্পানির প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এ কারণে মৌলভিত্তির ওই সব কোম্পানির শেয়ারের ট্রেডও হয় না।

এ বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা চেষ্টা করছে, সেই কথাও সত্যি। তবে একটি চক্র কারসাজি করে দুর্বল মৌলভিত্তি শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’

অথচ শেয়ার দর বাড়ার ক্ষেত্রে বা আগ্রহের শীর্ষে বেশিরভাগই লোকসানি আর স্বল্প মূলধনি কোম্পানি। কোনো রকম ব্যবসা চালানো বা ব্যবসার খারাপ অবস্থা, লোকসানি ও স্বল্প পরিশোধিত মূলধনি এসব কোম্পানির কোনো কোনোটির দর বেড়ে দ্বিগুণ, তিন গুণ, এমনকি অল্প সময়ের ব্যবধানে চার গুণও হয়েছে এবং দর বাড়ছেই।

অনেক সময় এসব ‘দুর্বল’ কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে খারাপ প্রতিষ্ঠানের কারসাজি রয়েছে বলে মনে করেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। সেই কারসাজি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে হোক বা বাজার খেলোয়াড়দের পক্ষ থেকেই হোক।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কারসাজি বন্ধ করে পচা বা জাঙ্ক শেয়ার থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি বন্ধ করতে মূল উদ্যোগ নিতে হবে বিএসইসিকে। এক্ষেত্রে ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ার এবং মৌলভিত্তি কোম্পানির তালিকাভুক্তিও বাড়াতে হবে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মৌলভিত্তি শেয়ার ও কম মৌলভিত্তি শেয়ারের পার্থক্যটা সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে। যখন তারা বিষয়টি বুঝতে পারবেন, তখন দুর্বল বা ঝুঁকিপূর্ণ বা তুলনামূলক কম মৌলভিত্তি কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকবে এবং কোনো কারসাজি চক্রের মাধ্যমে প্রলুব্ধ হয়ে কম মৌলভিত্তি শেয়ারে বিনিয়োগ করে সর্বস্ব হারাবেন না সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।’

এছাড়া মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বৃদ্ধিরও উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এই বাজার বিশ্লেষক।

(ঢাকাটাইমস/০৭জুন/আরআর/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :