কুড়িগ্রামে খাদ্য গুদামে কৃষকের বদলে ধান দিচ্ছে সিন্ডিকেট চক্র

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ১১ জুলাই ২০২৩, ১৩:০১| আপডেট : ১১ জুলাই ২০২৩, ১৪:৫২
অ- অ+

কুড়িগ্রামের উলিপুর সরকারি খাদ্য গুদামে কৃষকের বদলে সিন্ডিকেট চক্র ধান দিচ্ছে। এতে করে মাঠ পর্যায় কৃষকরা সরকারের দেয়া সুফল থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে ধান ক্রয় নিয়ম ডিজিটালাইজড করা হলেও সেখানে রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত কৃষকের তালিকাতে রয়েছে সিন্ডিকেট চক্রের স্বজনসহ জমিজমা না থাকা কৃষকরাও। ফলে উপজেলা ধান সংগ্রহ কমিটির পরোক্ষ যোগসাজশে সিন্ডিকেট চক্র লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেবার চিত্র উঠে আসে অনুসন্ধানে।

সরেজমিনে দেখা যায়, রবিবার দুপুরে উপজেলা খাদ্য গুদাম চত্বরে, প্রায় অর্ধশতাধিক ট্রলি, ট্রাক্টরে করে ধানের বস্তা নিয়ে অবস্থান করছে ধান ব্যবসায়ীরা। এসময় কোন কৃষকের দেখা পাওয়া যায়নি। মাঠ পর্যায় থেকে এক থেকে দুই হাজার টাকা দিয়ে কৃষকের নিকট হতে কৃষি কার্ড সংগ্রহ করেন এসব ধান ব্যবসায়ীরা। এসময় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একাধিক কৃষকের কৃষি কার্ড, এনআইডি এবং কৃষকের স্বাক্ষরিত ফাঁকা চেকের পাতা। উপজেলা খাদ্য গুদামকে ঘিরে গড়ে ওঠা মিল চাতাল মালিকদের সিন্ডিকেট চক্রের কারণে এসব ব্যবসায়ীদের ধান নিয়মবর্হিত হওয়ায় ফেরত পাঠায় গুদাম কর্তৃপক্ষ।

অভিযোগ উঠেছে সিন্ডিকেট চক্রটি নানা কারসাজির মাধ্যমে ভূমিহীন, দিনমজুর ও অস্বচ্ছল ব্যক্তিদের লটারিতে বিজয়ী দেখিয়ে তাদের নামে গুদামে ধান দিচ্ছে ওই চক্রটি। রবিবার অসাদুপায় অবলম্বন করে ট্রলি এবং ট্রাক্টরের ধান গুদামে ঢোকানোর চেষ্টা করলে বিষয়টি জানা জানি হয়। তালিকার সূত্র ধরে উপজেলার ধামশ্রেণী, গুনাইগাছ ও থেতরাই ইউনিয়নসহ পৌরসভা এলাকায় অনুসন্ধান করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে।

লটারিতে উপজেলা মিল চাতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহফুজার রহমান বুলেটের পরিবারের একাধিক সদস্যর নাম রয়েছে। তারা হলেন, তালিকার তিন নম্বরে মাহফুজার রহমান বুলেট, ৭৮ নম্বরে বাবা লুৎফর রহমান, দুই চাচা ৭৬ নম্বরে তৈয়বুর রহমান,৭৭ নম্বরে হাফিজার রহমান এবং দুই ভাই ৭৫ নম্বরে তৈফিক রহমান, ৭৯ নম্বরে ফয়সাল রহমান তালিকাভুক্ত রয়েছেন। এছাড়াও তালিকায় রয়েছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যদের স্বজন, প্রতিবেশি, বাড়ির কাজের লোকসহ অনেকেই।

পৌরসভার মুন্সি পাড়ার বাসিন্দা মাসুদ রানা বলেন, শনিবার রাত ১১টা থেকে আমি ১৫০ বস্তা ধান নিয়ে খাদ্য গুদামে পড়ে আছি। রাত থেকে আমরা পড়ে থাকলেও গুদাম কর্তৃপক্ষ গেট খুলে না। কিন্তু সকাল বেলা সিন্ডিকেট চক্র আর বড় ব্যবসায়ীরা আসার পর গেট খুলে দেয়া হয়। ব্যবসায়ীদের নিয়ে পরীক্ষা করতেছে। সিন্ডিকেটের সদস্যদের ধান গুদামে নিচ্ছে আর আমাদেরটা ধানের মান খারাপ দেখিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। সিন্ডিকেট সদস্য আর বড় বড় ব্যবসায়ীর ছাড়া এখানে কেউ ধান দিতে পারে না। আমাদের চেয়ে খারাপ মানের ধান সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ক্রয় করে গুদামে রেখেছে।

একই এলাকার বাসিন্দা সেকেন্দার আলী বলেন, আমি দু’হাজার টাকার বিনিময়ে কৃষকের নিকট হতে কৃষি কার্ড সংগ্রহ করেছি। সেই কার্ড ধরে ধান দিতে আসছি খাদ্য গুদামে ধান দিতে আসছি। কিন্তু ধানের ময়েশ্চারের আদ্রতা দেখিয়ে ধান ট্রলি ফেরত দিলো ওসিএলএসডি। আমার ধানের চেয়ে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে নিম্ন মানের ধান ক্রয় করে গুদামে ভরিয়েছে ওসিএলএসডি। শুধুমাত্র সিন্ডিকেট সদস্য না হওয়ায় আজ আমার ধান নিলো না তারা। এখানে যারা ধান নিয়ে আসছে কেউ কৃষক নেই। সবাই কৃষকের নিকট হতে কার্ড কিনে নিয়ে ধান দিতে আসছে। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে চলছে এই খাদ্য গুদাম।

ট্রলি চালক জহুরুল হক বলেন, আমি এর আগেও ধান নিয়ে এসেছি ব্যবসায়ীদের। এখানে কোন কৃষক ধান দেয়নি। সব বড় বড় ব্যবসায়ীরা ধান দিচ্ছে। আজকে ১৩/১৪ ময়েশ্চারকৃত ধান নিচ্ছে না। অথচ আমি নিজেই এর আগে ১৬/১৭ ময়েশ্চার যুক্ত ধান গুদামে দিয়েছি।

গুনাইগাছ ইউনিয়নের বাসিন্দা মকবুল হোসেন বলেন, আমি এবার ৫০ শতক জমি ধান আবাদ করেছি। প্রায় ৩০ মণ ধান পেয়েছি। সেখান থেকে কিছু ধান বাজারে বিক্রি করেছি এবং খাওয়ার জন্য কিছু রেখেছি। খাদ্য গুদামে আমি এবং আমার পুত্রবধু কোন ধান বিক্রি করেনি। তালিকায় আমাদের নাম কিভাবে আসলো এটা আমরা বলতে পারি না।

এই ইউনিয়নের নাগড়াকুড়া টি-বাঁধ এলাকার বাসিন্দা ছাদিকুল ইসলাম বলেন, কিছু দিন আগে অগ্রণী ব্যাংকের ওখানে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাকসেসের শিক্ষক ওবায়দুল আমাকে এক হাজার টাকা দিয়ে কৃষি কার্ডটি নেয়। এছাড়া আমি খাদ্য গুদামে কোন ধান বিক্রি করেনি। আমার যা ধান ছিল তা বাইরে বাজারে বিক্রি করেছি।

ধামশ্রেণী এলাকার তালিকা ভুক্ত কৃষক পলাশ বলেন, আমার এবং আমার মায়ের নাম তালিকাতে রয়েছে। ধানও দিয়েছি, টাকাও পেয়েছি এক লাখ ৮০ হাজার ২০ টাকা।

কোথায় ধান দিয়েছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কুড়িগ্রাম খাদ্য গুদাম অফিস এবং গুনাইগাছ খাদ্য অফিসের নাম বলেন। তবে তিনি ধান কোথায় দিয়েছেন তার কোন সদুত্তোর দিতে না পেরে সটকে পড়েন।

এই বিষয়ে উপজেলা মিল চাতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহফুজার রহমান বুলেট ফোনে বলেন, আমি একটা মিটিংয়ে আছি। পরে এই বিষয়ে আপনার সাথে কথা বলবো। পরে তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।

উপজেলা খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা (ওসিএলএসডি) শফিকুল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে আমন-বোরো খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু হয় গত ১৮ মে। আগামী ৩১ আগষ্টের মধ্যে সরকার নির্ধারিত ৩০ টাকা কেজি দরে কৃষক প্রতি তিন টন করে ধান এবং ৪৭ জন চুক্তিকৃত মিলারের নিকট হতে ৪৪ টাকা দরে চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে। এবারে উপজেলায় এক হাজার ৯৬০মেট্রিক টন ধান এবং এক হাজার ৪৮১ মেট্রিক টন চাল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ৯জুলাই পর্যন্ত ৪০২মেট্রিক টন ধান এবং এক হাজার ২৪০মেট্রিক টন চাল অর্জিত হয়েছে। তিনি তথ্য দিলেও ধান ক্রয়ের ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন বলেন, সরকারিভাবে আমন-বোরো ধান বিক্রির জন্য উপজেলা থেকে দু হাজার ১৫৬জন কৃষক আবেদন করেন। যারা আবেদন করেছেন তাদের তালিকা আমরা কৃষি বিভাগ থেকে উপজেলা খাদ্য বিভাগের নিকট সরবরাহ করা হয়েছে। অকৃষক তালিকা ভুক্ত হবার ব্যাপারে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাহমুদুল হাছান বলেন, কৃষকের তালিকা কৃষি বিভাগ তৈরি করে। সেই তালিকা থেকে লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচিত করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ কৃষক প্রতিনিধি। খাদ্য বিভাগ শুধু তালিকা অনুযায়ী নির্বাচিত কৃষকের নিকট হতে বিধি মোতাবেক ধান সংগ্রহ করে থাকে। যেহেতু অনিয়মের বিষয়টি জানতে পারলাম সেটি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবার আশ্বাস দেন তিনি।

(ঢাকাটাইমস/১১জুলাই/এসএ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আ.লীগকে নিষিদ্ধ করলে ভালো হতো: জামায়াত আমির
জামালপুরে মাদ্রাসায় ছাত্রী ভর্তিকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষ, আহত ২০
ইউনাইটেড হাসপাতালের কাছে ডিএনসিসির কর বকেয়া ৩০ কোটি টাকা
শহীদ নিজামীর খুনিদের বিচার বাংলার মাটিতেই হবে ইনশাআল্লাহ: রফিকুল ইসলাম 
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা