ব্যাংক তুমি যতই খেল তোমার আদায় ৩০০ গুনো

এমরান আহমদ ভূঁইয়া
| আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২৩, ২০:৩৮ | প্রকাশিত : ০১ আগস্ট ২০২৩, ২০:১৩

বর্তমান সময়ে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য দুইটি পন্থা অবলম্বন করে এক চেক ডিজঅনারের মামলা দুই অর্থঋণ আদালতে মামলা। স্যাংশন লেটার বা ঋণ মঞ্জুরি পত্র দেওয়ার সাথে সাথেই ঋণ গ্রহীতার নিকট থেকে ঋণ দাতা ব্যাংক বেশ কিছু চেকে স্বাক্ষর করে নেন। যাতে তারিখ থাকে না। ঋণগ্রহিতা খেলাপি হলে সেই চেক গুলো অনবরত গ্রহিতার অ্যাকাউন্টে উপস্থাপন করা হয়। স্বভাবতই তা ডিজঅনার হয় তারপরে মামলা। এই মামলায় ব্যাংকের জয়ের সম্ভাবনা ৯৯.৯%। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে চাইলে সাজাপ্রাপ্ত আসামির চেকে লিখিত টাকার ৫০% টাকা জমা দিয়ে তারপর আপিল করতে হয় চেক ডিজঅনার মামলায় এটাই আইন।

মানে বিষয়টি এমন ব্যাংক থেকে ১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন, ১.৫০ কোটি টাকার জমি মর্টগেজ দিয়ে তার সাথে দিয়েছেন স্বাক্ষর যুক্ত দশটি চেক। ব্যাংক মামলা করতে পারবে ১১টা। প্রতিটা চেকের জন্য আলাদা অংক বসিয়ে। ধরে নেওয়া যাক প্রতিটি ২০ লক্ষ টাকার চেক ডিজঅনার হলো। বছর খানিকের মধ্যে মামলা শেষ হল রায় হলো সর্বমোট ১০টি চেকের ২ কোটি টাকার। ঋণ গ্রহিতা আসামি হলো ফেরার। কেননা তার আপিল করতে হলে লাগবে ১ কোটি টাকা। তিনি ব্যাবসায় ধরা খেয়ে সব শেষ কেমনে দিবে। ওই দিকে চেকের মামলা করেই ব্যাংক ক্ষ্যান্ত হলো না, এবার জমি নিলামে তুললো দাম পেল ১ কোটি। সুদসহ বাদবাকি ১.৪০ কোটির টাকার জন্য করলো অর্থঋণ মামলা। খুব দ্রুত একতরফা ডিক্রি হলো। ঋণগ্রহিতা ফেরার কোর্টে উপস্থিত হবেন কীভাবে। অতপর সুদ সমেত ডিক্রি ধরে জারি মামলা করলো ব্যাংক ১.৭৫ কোটি। জমিতো আগেই নিলাম হয়ে গেছে। তাই জারি মামলায় ঋণগ্রহিতার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট হলো। বেচারা ঋণ গ্রহিতা জানলো জামিন নিতে গেলে দিতে হবে ডিক্রিকৃত অর্থের মানে সুদ সমেত টাকার ২৫% এটাও আইন। তিনি এখন ভাবছেন ২৫% টাকা দিয়ে জামিন নিতে গেলে কোর্টে যাওয়ার আগেই যদি চেকের মামলায় অ্যারেস্ট হন তাহলে সেখান থেকে বের হতে ১ কোটি কোথায় পাবেন! উচ্চতর আদালতের রায় অনুযায়ী অর্থঋণ ও চেকের মামলা একত্রে চলতে বাধা নেই। কিন্তু রায়ের পরে যে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে তাতো উদাহরণেই পরিষ্কার। অর্থঋণ আদালতের ৪৭ ধারা অনুযায়ী ১ কোটি টাকা ঋণ নিলে ৩কোটি টাকার ওপরে দাবি করে মামলা করা যায় না। অথচ চেকের মামলা আর অর্থঋণ মামলা করে তার চেয়ে অনেক বেশি দাবি করা সম্ভব যা আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলো অহরহ করে যাচ্ছে। যেমন এক্ষেত্রে যদি আইন মেনে আসামি বা ঋণগ্রহিতা মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় তাহলে তার দিতে হবে অর্থজারি মামলায় ৪৩ লক্ষ, তারপর অর্থঋণের একতরফা ডিক্রি রদ চেয়ে আপিল করলে ডিক্রি কৃত অর্থের ৫০% মানে ৭৫ লক্ষ, চেকের মামলায় ১কোটি আর জমি বিক্রি হল ১.৫০ কোটি। মানে দাড়াচ্ছে তার কেবল আপিল করার অধিকার পেতে দিতে হল ৪৩লক্ষ+৭৫লক্ষ+১কোটি+১কোটি ৫০ লক্ষ (জমির মূল্য) সর্বমোট ৩কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা! তারপরেও আপিলে যে তিনি জয়ী হবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। ধরে নেওয়া অযৌক্তিক নয় তিনি আপিলেও হারবেন। যদি হেরে যান সবগুলো মামলাতেই তখন তাকে কত দিতে হবে তা নিশ্চিত করে এখনই বলা সম্ভব নয়। কেননা ডিক্রি অনুযায়ী আদায়তক পর্যন্ত সুদ পাবে ব্যাংক।

টাকার এই জটিল ধাধা থেকে বের হয়ে একটি সত্য গল্প বলি। হযরত উমর ফারুক (রা:) খিলাফতের সময় এক ভদ্র মহিলা ইন্তেকাল করলেন তার স্বামী আর দুই সহোদর বোন রেখে। এক্ষেত্রে শরীয়া অনুযায়ী ফারায়েজ করলে অর্ধেক দিতে হয় স্বামীকে। আর তিন ভাগের দুই ভাগ পাবেন দুইবোন, যা সম্ভব নয়। কেন নয় উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হয়। ধরা যাক মৃত্যুকালে ঐ ভদ্রমহিলা ৪২ শতক ভূমি এবং স্বামী ও ২ আপন সহোদর বোন রেখে গেছেন। স্বামীর স্বাভাবিক পাওনা ৫০% তথা ২১ শতক। ২ আপন সহোদরের স্বাভাবিক পাওনা ৬৬.৬৭% তথা ২৮ শতক। স্বাভাবিক পাওনা হিসেব করলে মোট সম্পত্তি হওয়া উচিৎ ছিল ৪৯ শতক। কিন্তু সম্পত্তি আছে ৪২ শতক। বিরাট সমস্যা। হযরত উমর সভা ডাকলেন। সভা করে সিদ্ধান্ত দিলেন এভাবে- মোট জমি আছে ৪২ শতক ৪৯ নয়। তাই ৪৯ থেকে ৪২ এ বিয়োগ দিলেন হলো ৭। ৭ হলো ৪৯ এর ১৪.৩%। তার মানে প্রকৃত পরিমাণ মোট পরিমাণের চেয়ে ১৪. ৩% কম। যেহেতু স্বামীর স্বাভাবিক পাওনা ৫০% তথা ২১ শতকের ১৪.৩% হলো ৩ শতক। তাই স্বাভাবিক পাওনা ২১ শতক হতে ৩ শতক কমে স্বামীর প্রকৃত পাওনা হবে ১৮ শতক। ২ আপন সহোদরের স্বাভাবিক পাওনা ৬৬.৬৭% তথা ২৮ শতক ১৪.৩% হলো ৪ শতক। তাই স্বাভাবিক পাওনা ২৮ শতক হতে ৪ শতক কমে দুই আপন সহোদর বোনের প্রকৃত পাওনা হবে ২৪ শতক। ২৪+১৮=৪২ শতক হয়ে গেল সমাধান।

হযরত উমর জানতেন উত্তর হচ্ছে ৪২। তাই-ই মিলাতে হবে আর ইনসাফও করতে হবে উনি সেটাই করলেন। সৃষ্টি হলো নতুন দিগন্ত।

২+২=৪, এই চারকে উত্তর ধরে অনেকভাবেই অনেক সমীকরণেই চার মেলানো সম্ভব কেবল সংখ্যার অদলবদল করে। কিন্তু উত্তর শেষ পর্যন্ত ওই একই। ঠিক তেমনি আইনের একটা সহজ উত্তর আছে সেটা হলো ন্যায়বিচার। যত জটিল সমীকরণ থাকুক না কেন যেকোনো সমীকরণেই শেষ পর্যন্ত এটাতেই উত্তর।

অর্থঋণ আদালত আইনের ৪৭ ধারার বিধান অনুযায়ী মামলা দায়েরের সময় ১০০টাকার ঋণের বিপরীতে ৩০০টাকার বেশী দাবি করা যাবে না এই ৩০০ টাকাই উত্তর এবার অংক কষুন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৩০০ কীভাবে আদায় করবেন। অন্যথায় আওয়াজ কোনো না কোনো সময় উঠবেই। ব্যাংক তুমি যতই খেল তোমার আদায় ৩০০ গুনো।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়ার ফেসবুক ওয়াল থেকে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মুক্তমত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :