রক্তাক্ত ২১শে আগস্ট

শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা তথা নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ভয়াল দিন

সৈয়দা ফৌজিয়া হোসেন
  প্রকাশিত : ২০ আগস্ট ২০২৩, ১০:০৬| আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২৩, ১০:২২
অ- অ+

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের বিভীষিকার ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ছিলো নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ভয়াল দিন। মৃত্যু-ধ্বংস-রক্তস্রোতের নারকীয় গ্রেনেড হামলার ১৯তম বার্ষিকী। সেই কথা মনে পড়লেই শরীর-মনজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠে রক্ত, বাঁচার জন্য আর্তচিৎকার ও বীভৎস লাশের ছবি।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী’ সমাবেশে অকল্পনীয় এক নারকীয় গ্রেনেড হামলার ঘটনা বাংলাদেশে এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের জন্ম দেয়। ঐদিন সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে করা হয় একের পর এক গ্রেনেড হামলা। নেতাকর্মীদের মানববর্মে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান সে সময়ের বিরোধী দলীয় নেতা, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

২০০৪ সালের সেই সমাবেশে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তৃতা শুরু হয় বিকাল ৫টা ২ মিনিটে। তার দুই পাশে ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। ৫টা ২২ মিনিটে বক্তব্য শেষ করে শেখ হাসিনা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে মাইক থেকে সরে যাওয়ার মুহূর্তেই প্রথম গ্রেনেডটি ছোড়া হয়। ট্রাকের বাঁ পাশে পড়ে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকে থাকা জ্যেষ্ঠ নেতা এবং নিরাপত্তাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ট্রাকের ওপর বসিয়ে দেন। এর পরপরই আরও তিনটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়; চারদিকে ধোঁয়ায় আছন্ন হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত মেজর শোয়েব মো. তারিকুল্লাহ ট্রাকের সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে নামিয়ে আনতে বলেন আওয়ামী লীগ সভাপতিকে। মায়াসহ দেহরক্ষীরা শেখ হাসিনাকে ধরে নামিয়ে নেওয়ার সময় আরেকটি গ্রেনেড ট্রাকের পেছনের ডালায় বাড়ি খেয়ে পাশেই বিস্ফোরিত হয়। ফলে শেখ হাসিনাকে নিয়ে আবার সবাই ট্রাকের ওপর বসে পড়তে বাধ্য হন।

নেতাকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীরা সেখানে শেখ হাসিনাকে ঘিরে তৈরি করেন মানববর্ম। কিন্তু শোয়েব নিচ থেকে জানান, বিস্ফোরণে ট্রাকের তেলের ট্যাংক ফুটো হয়ে গেছে, যে কোনো মুহূর্তে ট্রাকে আগুন ধরে যেতে পারে। শেখ হাসিনার পায়ের স্যান্ডেল তখন কোথায় ছিটকে গেছে, চশমাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। ওই অবস্থায় মামুন, শোয়েব এবং অন্যরা মিলে তাকে নিয়ে গাড়ির সামনে বাঁ দিকের আসনে বসিয়ে দেন।

হামলা আর বিস্ফোরণের পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে গিয়ে বিপাকে পড়েন নেতা-কর্মীরা। ঐ অবস্থায় রিকশা, বেবিট্যাক্সি, এমনকি রিকশাভ্যানে করেও আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা। সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগাস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে। নিহত অন্যরা হলেন ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম, রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। একজনের পরিচয় এখনও জানা যায়নি।

শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে গিয়ে সেদিন গ্রেনেডের অসংখ্য স্প্লিন্টার বিদ্ধ হন তারেক আহমেদ সিদ্দিক, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও শোয়েব মো. তারিকুল্লাহসহ নেতাকর্মীদের অনেকে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যেন বাঁচতে না পারেন, তার সব চেষ্টাই সেদিন করেছিল হামলাকারীরা। তার গাড়ির কাঁচে কমপক্ষে সাতটি বুলেটের আঘাতের দাগ, গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের চিহ্ন আর পাংচার হয়ে যাওয়া গাড়ির চাকা সে কথাই প্রমাণ করে। পরে হামলার শিকার আওয়ামী লীগকেই দায়ী প্রমাণ করার নানা অপচেষ্টা চলে। বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে দিয়ে গঠন করা হয় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন। ১ মাস ১০ দিনের মাথায় ১৬২ পৃষ্ঠার একটি ফরমায়েশি রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা দেয় এই কমিশন।

এরপর আসল ঘটনা ধামাচাপা দিতে শুরু হয় নানা নাটক। তদন্তের গতি ভিন্ন খাতে নিতে শৈবাল সাহা পার্থ নামের এক তরুণকে আটক করে ফাঁসানোর চেষ্টা চলে। মঞ্চস্থ হয় জজ মিয়া নাটক। ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগে জজ মিয়াকে আটক করার পর জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়। এটি সাজানো নাটক প্রমাণ হওয়ার পর থামিয়ে দেয়া হয় তদন্ত কাজ।

নেতাকর্মীরা সাতক্ষীরার কলারোয়ার রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালায়। একই বছর ৩০ আগস্ট শেখ হাসিনা সাতক্ষীরার চন্দনপুর ইউনিয়নের হিজলি গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধার ধর্ষিতা স্ত্রীকে দেখতে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে তার গাড়ি বহরে হামলা চালানো হয়।

২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে ঘাতকের বুলেট থেকে শেখ হাসিনা রক্ষা পান। একই বছর আজকের দিনে তাকে হত্যার উদ্দেশে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলা করা হয়। এতে ২৪ জন নিহত হন। ২০০৭ সালের (সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়) ১৬ জুলাই অন্যায়ভাবে বিনা ওয়ারেন্টে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে সাব-জেলে রেখে খাদ্যে বিষক্রিয়ার মাধ্যমে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ২০১১ সালে শ্রীলংকার একটি সন্ত্রাসবাদী গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের শত্রুরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্র সুইসাইড স্কোয়াড গঠন করে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য চুক্তি করে এবং সেজন্য আগাম অর্থও দেয়া হয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করার লক্ষ্যে সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের শেষে দিকে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার কথা স্বীকার করে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেফতার জঙ্গি শাহানুর আলম ওরফে ডাক্তার। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার পথে কারওয়ান বাজারে তার গাড়ি বহরে বোমা হামলা চালানোর চেষ্টা চালায় জেএমবি। এছাড়া ২০১৮-১৯ সালে কয়েকবার তাকে বহনকারী বিমানে ত্রুটি ধরা পড়ে। এগুলোও হত্যা চেষ্টা বা হত্যা ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন অনেকে।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। সে সময়ে জার্মানিতে থাকার কারণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরি দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। দীর্ঘদিন নির্বাসিত জীবন কাটান তাঁরা। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয়। দেশে ফিরে এসে দলকে গোছাতে তিনি সারা দেশে সাংগঠনিক সফর করেন। তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন বলেই রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনা অপরিহার্য। আওয়ামী লীগের মেয়াদকালে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে, তা নজিরবিহীন। শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে এক বিস্ময় বিশ্ববাসীর কাছে। বর্তমানে বিদেশিরাও বাংলাদেশের সাফল্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। দেশে ও দেশের বাইরে ভিশনারি লিডার হিসেবে শেখ হাসিনার যে ঈর্ষণীয় সাফল্য তা এক কথায় অনন্য ও অসাধারণ।

সৈয়দা ফৌজিয়া হোসেন, আওয়ামী লীগ নেত্রী ও চেয়ারম্যান, রিভেরা গ্রুপ

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আ.লীগকে নিষিদ্ধ করলে ভালো হতো: জামায়াত আমির
জামালপুরে মাদ্রাসায় ছাত্রী ভর্তিকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষ, আহত ২০
ইউনাইটেড হাসপাতালের কাছে ডিএনসিসির কর বকেয়া ৩০ কোটি টাকা
শহীদ নিজামীর খুনিদের বিচার বাংলার মাটিতেই হবে ইনশাআল্লাহ: রফিকুল ইসলাম 
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা