মানসিক রোগ থেকে বাঁচার উপায়

স্বাস্থ্য ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১০ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:৪১

আধুনিক নগরায়ণ, আর্থসামাজিক অবস্থা, মানসিক চাপ, বংশগতি, অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় ও মনোসামাজিক কারণে দেশে দিনদিন মানসিক রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার অনেকে মানসিক সমস্যাকে রোগ মনে করে না। বিশেষ গুরুত্বও দেন না এবং সঠিক চিকিৎসা করাতেও উদ্যোগী হন না। ফলে মানসিক সমস্যা ভেতরে ভেতরে আরও বেশি বাড়তে থাকে। একজন মানুষ পুরোপুরি তখনই সুস্থ, যখন তার শরীর ও মন দুটোই পরিপূর্ণভাবে সুস্থ থাকে। কিন্তু অনেক সময় আমাদের শরীর সুস্থ থাকলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থা, দীর্ঘদিন মানসিক অস্থিরতা এবং সুস্থ, স্বাভাবিক আচার-ব্যবহার পরিপন্থী জীবনযাপন করার ফলে মানসিক সুস্থতা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলতে থাকলে এতে অনেক সময় ভুক্তভোগীরা পরিণত হয় মানসিক রোগীতে।

আজ মঙ্গলবার বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। সারা বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ১০ অক্টোবর নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই দিবস পালন করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। ১৯৯২ সালে প্রথমবার মতো পালন করা হয় দিবসটি। কিছু দেশে দিবসটিকে মানসিক রোগ সচেতনতা সপ্তাহের অংশ হিসাবেও পালন করা হয়। এ বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য রাখা হয়েছে—‘মানসিক স্বাস্থ্য সর্বজনীন মানবাধিকার’।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৩০ সাল নাগাদ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বিষণ্ণতা ব্যাপক আকার নেবে। হতাশা, বিষণ্নতা এবং অন্যান্য সামাজিক-মানসিক অস্থিরতা আগের তুলনায় অনেক বেশি। এদের মধ্যে আত্মহত্যার হারও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

শারীরিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারের আমরা সচেতন হলেও অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে তেমন একটা খেয়াল রাখি না। কিন্তু উভয় ধরনের সুস্থতা আমাদের জন্য অপরিহার্য। মানসিক রোগ কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক আচরণ ও জীবন-যাপনের চিত্র। এক্ষেত্রে মানুষ নানারকম মানসিক চাপ, অস্বস্তিতে ভোগেন এবং বিচলিত হয়ে পড়েন। এটি সাধারণত ঘটে মস্তিষ্কের রোগের কারণে। একজন মানসিক রোগীর নিজের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক ও পেশাগত জীবন ব্যাহত হয়।

বাংলাদেশে প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ মানসিক রোগের শিকার। মানসিক রোগের প্রকৃত কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে মূলত কয়েকটি কারণে মানসিক রোগের সৃষ্টি হতে পারে। সেগুলো হলো জেনেটিক বা বংশগত প্রভাব, পরিবেশগত প্রভাব, শারীরিক ও মানসিক যৌন-নির্যাতন, অস্বাভাবিকভাবে শিশুর লালন-পালন, দীর্ঘমেয়াদী অস্বাভাবিক চাপ, ইন্টারনেটসহ অন্যান্য নেশা দ্রব্যের প্রতি অধিক আগ্রহ, মস্তিষ্কের গঠন জনিত সমস্যা, নিউরো ট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা, কিডনি, যকৃত, দীর্ঘমেয়াদী ঘুমের অভাব। এছাড়া মৃগীরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিকস্, মাথায় আঘাত, ব্রেইন টিউমার, হৃদপিণ্ডের ফেইলিয়রও মানসিক রোগের কারণ হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক অসুস্থতার কারণেই সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে, এ থেকে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। দেশে ২৫ শতাংশ মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছেন। যাদের বেশির ভাগই কখনো চিকিৎসা পায়নি। অনেকে আত্মহত্যা না করে উলটো অন্য কোনো আপনজনকে হত্যা করার মতো অপরাধেও লিপ্ত থাকে। প্রতিদিন বিশ্বে গড়ে ৩ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছে। এর চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি লোক আত্মহত্যার চেষ্টা করছে।

মানসিক রোগকে মুলত দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে- নিউরোটিক ও সাইকোসিস।

নিউরোটিক মানসিক রোগ হয় সাধারণত দুশ্চিন্তা, অস্বাভাবিক রাগ, ইন্টারনেট ও মাদকাসক্তি, প্যানিক, যৌন সমস্যা ইতাদি কারণে। এই ধরনের মানসিক রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।

অপরদিকে সাইকোসিস হলো সবচেয়ে গুরুতর মানসিক সমস্যা। সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার ইত্যাদি কারণে সাইকোসিস মেন্টাল ডিজ-অর্ডার হয়ে থাকে।

মানসিক রোগের লক্ষণ

বিশেষজ্ঞদের মতে, যখন কোনো ব্যক্তির আচরণের বড় ধরনের ও লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যায়, বিশেষ করে আবেগ প্রকাশে পরিবর্তন আসে এবং সেটা দৈনন্দিন কর্মকান্ডে প্রভাব ফেলে তখন বুঝতে হবে সেই ব্যক্তি মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। বিশেষজ্ঞরা মানসিক রোগের কিছু লক্ষণ উল্লেখ করেছেন।

হঠাৎ করে কারণ ছাড়াই উত্তেজিত হয়ে ওঠা। অন্যদের সঙ্গ এড়িয়ে চলা। সবার সাথে ঝগড়া বা বাগবিতন্ডায় জড়ানো। অনেকদিন যাবত নিজেকে সবার থেকে গুটিয়ে রাখা। টানা ১৪ দিনের বেশি সময় ধরে বিষন্নতায় ভোগা। বিনা কারণে অন্যদেরকে সন্দেহ করা। গোসল করা, দাঁত ব্রাশ করার মতো নিয়মিত কাজে গাফিলতি করা। নিজের প্রতি উদাসীন থাকা এবং শারীরিক যত্ন না নেওয়া। পূর্বে ভালো লাগতো এমন কর্মকান্ডে আগ্রহ কমে যাওয়া। খাবারে অরুচি তৈরি হওয়া। অতিরিক্ত শুচিবায়ুগ্রস্থ হয়ে ওঠা। সামাজিক সম্পর্ক থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা। পেশাগত কাজের প্রতি অনীহা তৈরি হওয়া। সময়মতো না ঘুমানো এবং ঘুমের পরিমাণ কমে যাওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া।

শারীরিক ও মানসিক রোগ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য এক ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বলে। এটি মানুষের জৈবিক গঠন, মানসিক গঠন ও সামগ্রিক মনোদৈহিক প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। অন্যান্য রোগের মতো মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর বেশ কতগুলো কার্যকরী উপায় আছে। সেগুলো হলো:

পরিস্থিতি এড়িয়ে না যাওয়া

মানুষের জীবনে কখনো কোনো ধরনের অপ্রীতিকর, কষ্টদায়ক পরিস্থিতি তৈরি হলে আমরা সেটাকে এড়িয়ে যেতে চাই এবং সেখান থেকে মুক্তি পেতে চাই। কিন্তু বেশিরভাগ সময় এই ধরনের সিদ্ধান্ত মানুষের জন্য নেতিবাচক প্রভাব হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে না গিয়ে বরং সেটাকে মোকাবিলা করে সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আগামী দিনগুলো অতিবাহিত করা উচিৎ। এতে করে নিজেদের মাঝে একটা আত্মবিশ্বাস ও আত্মতৃপ্তি পাওয়া যাবে।

বর্তমানে কাজে মনোযোগ দিন

আমরা, মানুষেরা স্বভাবতই অতীত ও ভবিষ্যত নিয়ে বেশি চিন্তা করতে থাকি। অতীতের নানা রকম পাওয়া, না-পাওয়ার হিসাব আমাদেরকে আফসোস করায়। এতে নানারকম দুশ্চিন্তা তৈরি হয়। আবার ভবিষ্যতের নানাবিধ পরিকল্পনা আমাদেরকে বিচলিত করে তোলে। বর্তমান কাজে মননিবেশ করতে পারি না। এতে করে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি।

পর্যাপ্ত ঘুমান

মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য ঘুম খুবই দরকারী। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থে বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই শরীর ও মন সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। এতে করে মানসিক ক্লান্তি ও বিষাদও দূর হবে।

মানুষকে সঙ্গ দেওয়া

একাকিত্ব মানুষকে মানসিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করুন সবসময় ভালো মানুষদের সাথে থাকতে। সকলের সাথে হাসিখুশি আচরণ করলে এটা আপনাকে মানসিক তৃপ্তি দিবে এবং আপনি বিচলিত হবেন না বরং প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

সৃজনশীল ও কর্মঠ হয়ে ওঠা

সৃজনশীলতা মানুষকে নতুন কিছু সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আর মানুষ নিজে কিছু সৃষ্টি করতে পারলে তার আনন্দিত হয় এবং তৃপ্তি দেয়। এতে করে নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখা সম্ভব এবং অন্যান্য দুশ্চিন্তা থেকে দূরে রাখা সম্ভব।

ক্ষমা করতে শিখুন

মনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ জমিয়ে রাখবেন না। একটা সময় পর এই সমস্যাটি আপনাকে মানসিক চাপে ফেলতে পারে। মনে রাখবেন, যে কেউ ভুল করতে পারে—এমনকি আপনিও প্রায় সময় ভুল করেন। ভুল করা আমাদের জীবনের একটি অংশ! আর তাই সেই ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন এবং কেউ ভুল করলে তাকে ক্ষমা করে দিন। অযথা বিষয়টি মনের মধ্যে পুষে রাখবেন না!

নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খান

সু-স্বাস্থ্যই সকল সুখের মুল—প্রচলিত এই কথাটি একদমই সত্য। আর শারীরিক ভাবে ভালো ও ফিট থাকার জন্য নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলুন। হতে পারে সেটা প্রতিদিন সকালে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি অথবা কোন জিমে ভর্তি হয়ে নিয়মিত ব্যায়াম করা। আপনার শরীর সব ধরনের পুষ্টি পাচ্ছে কি না সেটা নিশ্চিত করার জন্য সব ধরনের পুষ্টিকর খাবারই পরিমিতভাবে গ্রহণ করুন।

মানসিক চাপ কমান

স্ট্রেস অর্থাৎ ‘মানসিক চাপ’ শব্দটি অনেক সহজ মনে হলেও আমাদের জীবনে এই শব্দটির প্রভাব অনেক গুরুতর। শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ করে এটা আমাদের জীবনকে রীতিমত দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। মনে রাখবেন, আপনি কিন্তু চাইলেই মানসিক চাপ কমিয়ে নিয়ে আসতে পারেন।

মদ্যপান, ধূমপান এবং মাদক থেকে দূরে থাকুন

মদ্যপান, ধূমপান এবং মাদক এই তিনটি জিনসই শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। অনেকেই মানসিক চাপ অনুভব করলে ধূমপান করে থাকেন, তবে এই অভ্যাসটি আপনার ভালো তো করেই না বরং অনেক বেশী ক্ষতি করে ফেলে। মনে রাখবেন আপনার জীবনের সমস্যাগুলো কখনো মদ, সিগারেট অথবা মাদক সমাধান করে দিতে পারবে না। সাময়িক ভাবে আপনার মধ্যে হয়ত ভালো লাগার একটা অনুভূতি তৈরি হলেও এগুলোর ক্ষতিকারক দিকটিই অনেক বেশী।

চিকিৎসকের সাহায্য নিন

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী এবং লাইসেন্সপ্রাপ্ত থেরাপিস্ট, একটি সঠিক রোগ নির্ণয় প্রদান করতে পারেন এবং ওষুধ, সাইকোথেরাপি এবং সহায়তা গোষ্ঠীসহ উপযুক্ত চিকিৎসা বিকল্পগুলো সুপারিশ করতে পারেন।

(ঢাকাটাইমস/১০ অক্টোবর/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :