নানা খোয়াবের ঘোরে বিএনপি ঘুরছে

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
| আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ১০:৫৪ | প্রকাশিত : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:২৬

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতি গত এক বছর ধরে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। তখন থেকেই বিএনপির নেতৃত্বে অনেক নামসর্বস্ব দল যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছিল। তাদের দাবি বর্তমান সরকারের অধীনে নয়- নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। এজন্য দলগুলো বর্তমান সরকারের পদত্যাগ দাবি করে আসছিল। সে প্রেক্ষিতে গত বছর ১০ ডিসেম্বর সরকার উৎখাতের ডেডলাইন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই তারিখে কিছু করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এভাবে ডেডলাইন দেওয়ার বিষয়টি রাজনীতি সচেতন মানুষের কাছেই বেশ বিস্ময়কর মনে হয়েছিল তখন। এরপরও আরও কয়েকবার ডেডলাইন দেওয়া হয়েছিল। নেতাকর্মীদেরও সেভাবে উজ্জীবিত করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেসব কিছুই কাজে লাগেনি। মনে হয়েছিল বিএনপির নেতৃত্ব থেকে এভাবে সরকার পতনের দিনক্ষণ ঘোষণার পেছনে তাদের খোয়াবে দেখা কোনো ঘোর কাজ করছিল। সে কারণেই বারবার সরকার পতনের তারিখ বাস্তব নেতাকর্মীরাও দেখতে পায়নি। সরকার পতনে শুধু বিএনপির নেতৃত্বই নয়- ছোটো ছোটো নামসর্বস্ব কিছু দলের নেতারাও গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টির কথা দাবি করেছিলেন। তাদের নেতৃত্বে দেশে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হবে, সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হবে, এমনকি দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হবে এমন কথাও বারবার উচ্চারণ করা হয়েছিল। যারা গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টির দাবি করছিলেন তারা নিজেদেরকে বাম রাজনৈতিক দলের পরিচয় দিয়ে থাকেন। তাদের জনসমর্থন এদেশে কোন পর্যায়ে রয়েছে তা তারা কখনো হিসাব করে দেখেছেন কি না জানি না। কিন্তু তারা যখন গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টির কথা চিন্তা করেন তখন মনে হচ্ছে তারাও খোয়াবে গণঅভ্যুত্থান দেখে জনগণকে সেই গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টির কথা বারবার বলছেন।

আবার যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিসানীতির কথা ঘোষণা করা হলো তখনও সরকার পতন খুব নিকটবর্তীতে হতে যাচ্ছে এমন দাবিও তারা করছিলেন। তাদের এই দাবিও মনে হচ্ছে খোয়াবে দেখা সরকার পতনের কোনো বিষয়- বাস্তবের সঙ্গে আদৌ এর কোনো সংগতি আছে কি না তা বলা মুশকিল। এরপর বিদেশি কিছু সংস্থা বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে যখন কথা বলছিলেন, তখনও খোয়াবের ঘোরে থাকা মানুষের মতো সরকার পতনের নিশ্চয়তা তারা দিচ্ছিলেন। এভাবে বারবার সরকার পতনের দিনক্ষণ বলার মাধ্যমে মনে হচ্ছিল, তাদের খোয়াবের ঘোর যেন কাটছিলই না। বিদেশিদের কথাবার্তা, ভিসানীতি, স্যাংশন ইত্যাদিতে বাংলাদেশের সরকারের পতন ঘটার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যারা কথা বলছিলেন তারা আসলে অন্যের শক্তির ওপরই আস্থাশীল ছিলেন। অনেকটা যেন আমাদের দেশে এক সময়ের জনপ্রিয় লাটিম খেলার মতোই। লাটিম নিজের কোনো শক্তিতে ঘোরে না। যিনি নিক্ষেপ করেন তার শক্তিতেই লাটিম কিছুক্ষণ ঘোরে। যুগপৎ আন্দোলনকারীদের সরকার পতনের নিশ্চয়তাদান অনেকটাই যেন সেরকম লাটিম খেলার মতো। কিংবা ঘুমিয়ে খোয়াব দেখার ঘোরে আচ্ছন্ন ব্যক্তির অসংলগ্ন কথাবার্তার মতোই কিছু একটা বলা এবং শোনা।

গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পূর্বশর্ত সম্পর্কে যারা বৈজ্ঞানিক ধারণা রাখেন তারা বলতে পারেন যে একটি দেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটার জন্য অনেক পূর্বশর্ত পূরণ করতে হয়। ১৯৬৯ সালে আমাদের দেশে যে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল সেটি কারো খোয়াবে দেখা গণ-আন্দোলন নয়। পাকিস্তানের শুরু থেকে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষের মনে জমে ওঠা ক্ষোভ ১৯৬৬ সালে ৬ দফার স্বায়ত্তশাসনের দাবিনামায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কর্তৃক উত্থাপিত হয়। সেই আন্দোলনের পর যে জাতীয় চেতনা সংগঠিত হয়েছিল সেটিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ১৯৬৯-এর আইয়ুববিরোধী শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনমানুষের। সেখানেই গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সকল মানুষ ব্যাপক পরিবর্তনের জন্য মাঠে নেমে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মুক্তির জন্য অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন। সেটিই হচ্ছে একমাত্র গণঅভ্যুত্থান। সেই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়ার রাজনৈতিক শক্তি যেমন ছিল, একইভাবে জনগণের ঐক্যও সুদৃঢ় ছিল। এটি ২৩ বছরের গড়ে ওঠা বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনমানুষের রাজনৈতিক বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণ জনসমর্থনহীন কোনো বাম বা ডানদের খোয়াবে পাওয়া আন্দোলন নয়। সুতরাং সরকার পতন আন্দোলনে যারা এখন গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টির কথা শোনাচ্ছেন তারা যেন বিদেশি শক্তির নড়াচড়া দেখে দেশের রাজনীতির পরিবর্তনের খোয়াব দেখছেন। কিন্তু বাস্তবে এভাবে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয় না। ইতোপূর্বে গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস জনগণের অংশগ্রহণেই ঘটেছে এবং জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক দলের ডাকেই মানুষ সাড়া দিয়েছে। ইতিহাসের এই পাঠ না জেনে যারা গণঅভ্যুত্থান এবং সরকার পতনের স্বপ্ন দেখছেন তারা লাটিমের মতো অন্যের শক্তিতেই ঘোরেন কিংবা ঘুমের ঘোরে তাড়িত হয়েই কথা বলছেন।

২৮ অক্টোবর যুগপৎ আন্দোলনকারীরা ঢাকায় মহাসমাবেশ ডেকেছিল। সেদিন জামায়াতে ইসলামীও মাঠে নেমেছিল। বিএনপি থেকে বলা হয়েছিল শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু আগেই বোঝা গিয়েছিল ২৮ তারিখ সরকারবিরোধী শক্তিসমূহ কিছু একটা করবে। সারাদেশ থেকে নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসার আহ্বান জানানোর মধ্যেই সেই ইঙ্গিত ছিল। একইভাবে জামায়াতের সেদিন শাপলা চত্বরে সমাবেশ করতে চাওয়া এবং বিএনপির সম্মতি দেওয়ার মধ্যেই ছিল গোপন সমঝোতা। এরপর যা ঘটেছিল তা এতদিনে সকলেই জানতে পেরেছেন। বুঝাই গেছে সেদিন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের পুলিশ-সাংবাদিকদের বেপরোয়া আক্রমণ করার মধ্যে ছিল লাশ ফেলার ইন্ধন। সেই ইন্ধন থেকে ঢাকায় কয়েকদিন তাণ্ডব চালিয়ে সরকারের পতন ঘটানোর খোয়াবও তারা দেখেছিলেন। ২৮ তারিখ জো বাইডেনের কথিত উপদেষ্টা ঠিক ঠিক অফিসে হাজির হয়েছিলেন। তিনি তার সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে আরও স্যাংশন দেওয়ার কথাও বলছিলেন। এসবই ছিল অন্যের শক্তিতে দেশের সরকারকে ভয় দেখানোর গোপন পরিকল্পনা। মিয়া আরেফি বেশ আগে থেকেই ঢাকায় বিএনপির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। সেসব বৈঠকেরই কিছু কিছু বিষয়কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসানীতি, স্যাংশন-নীতি হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছিল।

২৮ তারিখ থেকে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলন সাজানো হয়েছিল। সেটি বিএনপি নেতারা একভাবে করেছিলেন, লন্ডনস্থ মূল নেতা তারেক রহমান তার মতো করে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলে সমাবেশ শুরু হওয়ার আগেই সরকার পতনের মিনি রিহার্সেল শুরু হয়ে যায়। একজন পুলিশ কনস্টেবলকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সাংবাদিক-পুলিশদের নির্বিচারে লাঠিপেটা করা হয়। পোড়াপুড়ি, ভাঙচুর যা করার তাও হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের নারী কর্মীদের ওপর বিএনপির কর্মীরা চড়াও হয়। এমন অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাউন্ড গ্রেনেড আর টিয়ার শেল ব্যবহার করে রাস্তা থেকে নেতাকর্মীদের তাড়িয়ে দিলে নেতারা ক্ষুব্ধ হয়ে পরদিন ২৯ তারিখে হরতাল ডাকেন। হরতালের আগেই কিছু গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। ২৯ তারিখ ঢিলেঢালা হরতাল হলেও আওয়ামী লীগের দুইজন কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেপ্তার হন, অন্য নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। পরে অবশ্য একে একে ধরা পড়তে থাকেন তারা। এরপর তিনদিনের অবরোধ ডাকা হয়। বিএনপির উদ্ভাবিত এই আন্দোলন কর্মসূচি ২০১৩ ও ২০১৫ সালে দেশে অগ্নিসন্ত্রাস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। সেই কর্মসূচি পুনরায় আমদানি করা হয়। অবরোধ কর্মসূচিতে কিছু গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ঘটলেও এবার অবরোধ ২০১৩ ও ২০১৫-এর মতো করা যাচ্ছে না। নেতাকর্মীদের অনেকেই এখন আর মাঠে নেই। এখন নির্বাচনি তফসিল যেকোনো দিনই ঘোষিত হতে যাচ্ছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বিএনপি-জামায়াত তফসিল ঘোষণার পরই ব্যাপক শক্তি নিয়ে মাঠে নামবে। তারা গণআন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর কথাও বলছে। একইসঙ্গে তাদের প্রতীক্ষার বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্ব তখন কী করবে?

ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস কী করবেন? বিএনপির ধারণা তাদের পাশেই এরা দাঁড়াবে। আসলে বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারীরা সরকার পতনের নানা খোয়াবের ঘোরে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে। সরকার পতনটাই যেন তাদের মূল উদ্দেশ্য। অথচ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা যদি সম্মিলিতভাবে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিত তাহলে সেটিই হতো রাজনৈতিকভাবে তাদের বিচক্ষণতার পরিচয়। কিন্তু সেপথে তারা হাঁটছেন না। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল ২৮ তারিখের পর সরকার উৎখাত হবেই। দেশে তাদের মতো করে নির্দলীয় সরকার হবে। কিন্তু সেই বাস্তবতা আগেও ছিল না, এখনও চিন্তা করার কোনো সুযোগই নেই। তবুও তারা খোয়াবের ঘোরে যদি সরকার পতন, নির্বাচন ঠেকাতে ২০১৩ ও ২০১৫ সালের মতো অগ্নিসংযোগ, রাস্তাঘাট বিচ্ছিন্ন করা ইত্যাদি কর্মসূচি দেওয়ার কথা ভাবে, তাহলে সেটি কতটা সফল হবে তা নিয়ে এবার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বলা হচ্ছে- তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর ঢাকা থেকে সারাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে।

মূলত জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে কোনো কোনো মহল ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিগত দিনগুলোতে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা হরতাল-অবরোধে সমর্থন জানালেও রাস্তায় নামেনি। আন্দোলনের রিজার্ভ হিসেবে তারা এতদিন অংশ নেয়নি। তফসিল ঘোষণার পর সেটিই তারা নিতে যাচ্ছে বলে বলা হচ্ছে। এসবই ভবিষ্যতের কথা। তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চয়ই সে ধরনের কোনো অবস্থা সৃষ্টি হলে তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। তফিসল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের আদেশমতো থাকবে বলে যে ধারণা দেওয়া হয় তাতে কি জ্বালাও-পোড়াও, অবরোধকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে থাকবে না? নির্বাচনের সময় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুষ্ঠু নির্বাচন করার দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকার কোনো সুযোগ আছে কি?

মমতাউদ্দীন পাটোয়ারী: ইতিহাসবিদ, ইউজিসি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফেলো ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :