সুন্দরীনামা

সুন্দরীনামা ১
প্রেমে মূল্যহ্রাস—তাই, উবে যাচ্ছে সম্পর্কের বিমা। এত-এত
রক্তফুল ফুটছে সর্বত্র: বঙ্গে, মধ্যপ্রাচ্যে, মধ্যএশিয়ায়—
সবখানে তোমার রোমশ হাত, তোমারই তো চুল; আর,
চোখের কালোয় অবরুদ্ধ পদবাচ্য সব—কে রেহাই পায়?!
তোমার ধ্রুপদী নাচ—বাজে রাগ কাহারবা, ঢোল ও ডমরু...
সমুদ্র সরব এবং আকাশটা ছেয়ে গেছে অগ্নি আর ড্রোনে:
ভেঙে যাচ্ছে সংসার, দাম্পত্য, ঘর, শুভাকাঙ্খী, বিশ্বজনপদ—
উড়িতেছে সভ্যতার প্ল্যাকার্ড, পতাকা—উচ্চ আনন্দভবনে…
মাহমুদা—যে-সামান্য প্রেম ছিল পিরামিডে-পঞ্চবটী বনে,
যদি তা থাকত মনে—এত রক্ত থাকত না তোমার চুম্বনে!সুন্দরীনামা ৩
জীবনে কেবল একটিই গোলাপ চুরি করেছি—না, গোলাপ না—
গোলাপের ডাল: গাছ থেকে ফুল কক্ষনো কি ছিঁড়েছি, বলো—শ্রী!
গোলাপের ডাল থেকে গোলাপ গজায়—এ-রকমই শুনেছি:
তাই মনে হলো—একটা গোলাপডাল তোমার জন্য না হয় ছিঁড়ি…
লোকে বলে—চুরি মহাপাপ—তবু, আমার মালিক তো আমাকে
ঠকায় প্রতিনিয়ত—তার গোলাপের ঝাড় থেকে একটিমাত্র
ডাল আমি নিলে ক্ষতি কি! সে-ডাল পুতে দিয়ে কোমল মাটিতে
জল ঢালি, নিড়ানি দিই—যেন আমি বোটানির একনিষ্ঠ ছাত্র!
সেই গাছ—তোমাকে দিলাম—যখন আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ…
অথচ, সে গোলাপ-পাপড়ি দিয়ে তুমি আজ চা বানিয়ে খাচ্ছ!সুন্দরীনামা ৪
মাহমুদা শোনো—পৃথিবীর সব সুন্দরী মেয়েই অহংকারী,
বাকপটিয়সী আর পাক্কা অভিনেত্রী হয়। তাদের প্রতিটি
অঙ্গ সুচতুর, কিন্তু তারা বুদ্ধিমতী নয়—যে-রকম কালো মেয়ে হয়। পৃথিবীর সব ফর্সা মেয়েগুলো বোকা—পিটিপিটি
করলেও তাদের সে-প্রেম খুব কমই ফলে—যে-রকম সাদা
ফুল কম পরিণত হয় ফলে। শোনো, মনোযোগ দিয়ে তুমি
শোনো—পৃথিবীর সব সুন্দরী মেয়েগুলো চমৎকার হাসে,
সে-কারণে মৌমাছি-বোল্লারা উড়ে-উড়ে আসে—তারা তো মৌসুমি:
মধু খেয়ে চলে যায়, শেষে কালো পিঁপড়েতে সুসুন্দর ফাঁসে!
সাদা-সাদা ছেলেগুলো তাই কালো মেয়েদের খুব ভালোবাসে।সুন্দরীনামা ৬
যখন আমি ব্রতকালীন সময় পার করতাম। অর্থাৎ,
তোমার কাছ থেকে দূরে সরে থাকতাম—যেকোনো কারণে,
তুমি খুব অস্থির-ব্যাকুল হয়ে যেতে: ফোন আর ফোন এবং
ইনবক্স ভরে ফেলতে চুপচাপ থাকার নিষেধ-বারণে।
কত-শত হুমকি-ধমকি, আর, ইনিয়েবিনিয়ে তুমি খুব
জানতে চাইতে—সম্পর্ক ছিন্ন করার কী তোমার দোষ, শুধু
এইটুকু যেন বলি। তোমার প্রেমের টানে, শোনো রম্ভা, মুনি
ভীষ্মমিত্রের সে-ব্রত ভেঙে যেত। কিন্তু আজ তুমি দূর ধু-ধু…
অভিশপ্ত ভীষ্মমিত্র একাএকা তোমাকে সাধনে ব্রত সাধে—
তুমি সেই তুমি নেই, হানিমুনে আর কারো সাথে গেছ চাঁদে!সুন্দরীনামা ৭
মহাবিশ্বে অসংখ্য মোচড় গর্ত ঘূর্ণমান থাকে—আমাদের
জন্ম হয় মৃত্যু হয় সেই ঘূর্ণিপাকে। মরে গেলে প্রাণী-জীব
কী করে আগের কথা বলো মনে রাখে? তবু কারো-কারো কিন্তু
পূর্বস্মৃতি থাকে। তারা—পূর্বাপর স্মৃতিধর এবং চিরঞ্জীব,
যারা মাতৃঋণ-পিতৃপরিচয় কখনো ভোলে না আর খুব
সামান্যেই তৃপ্ত, করে না সংহার। সেই সব লোক যেন সেই
সব ডাল, যারা মাতৃকাণ্ড থেকে জন্মে ক্রমশ শিকড় ছেড়ে
নিজেস্ব জীবনে যায়—তাদের কখনো কোনো স্মৃতিভ্রম নেই:
হে সুন্দরী, তোমার দৈহিক সৌন্দর্যের জন্য কৃতি তুমি নও—
বরং পূর্ব বংশক্রম—বুঝতে পারবে যদি স্মৃতিস্মর হও।সুন্দরীনামা ৯
রিডাকশনে সেকেন্ডহ্যান্ড কিনলাম—চকচকে। এখন তো
দেখছি—ইনটেকের চেয়ে দামি—লেবেল তুলতেই প্রকৃত
সত্য বের হয়ে এল! ব্যবহার হতে-হতে সোনার মতোই
ঝকমকা চাঁদ হয় পিতল আর কাঁশার বাটি, তা বলে তো
সোনা কিংবা চাঁদ হয়ে যায় না—এ-সব বাটি। তবু ও-রূপসী
শু, ঢুকিয়ে দিলাম পা—কোনো তেলাপোকা লেঙুড়জাগানো বিছা
আছে নাকি তোমার ভেতরে?! যদি থেকে থাকে মোজা পরে নিই,
নয় তো চটজলদি বের করো তাকে। জুতা, এ-কথা কি মিছা—
তোমার ভেতরে ঢুকে, পড়ি যদি পোকার কবলে—তলে-তলে
যদি নড়েচড়ে আর কামড়ায়, এ-জীবন যাাবে যে বিফলে!সুন্দরীনামা ১০
হেমন্ত নেমেছে ফের এ-শহরে—শীত-শীত—চলো শ্রী, আমরা
দুজন আবার লাভ রোডে যাই। বসব দুজন ফের আম
গাছটার তলে—টুলে, ফুটপাতে—বাতিজ্বলা অস্পষ্ট সন্ধ্যায়।
চুপচাপ মুখামুখি আমরা দুজন—কথা নেই, ছিমছাম
অন্ধকারে মিশে আছে কিছু ধূসরতা। নারকেল-খেঁজুরগুঁড়ে
চালগুঁড়ো দিয়ে পাতা ভাঁপাপিঠা—পাকিয়ে-পাকিয়ে ওঠা ধোঁয়া—
ভেঙেচুরে খাচ্ছে জোড়া তরুণ-তরুণী—আমরা না-হয় বসে
সেই দৃশ্য দেখি: রিকশার টুংটাং, পিঠাবানুনীর দেওয়া-থোয়া—
সবটাই কি মেকী—শ্রী! হেমন্ত এসেছ ফের—হাতে হাত ধরে
চলো—লাভ রোডে যাই, রাত হলে ফিরে যাব নিজ-নিজ ঘরে…সুন্দরীনামা ১১
‘দিলাম সাগর, তবে, কাউকে কিচ্ছুটি যেন না বলেন। যদি
বলতেই হয়, তবে, অজস্র প্ল্যাস্টিক-পলিথিন জলতলে—
আমিও বলব তা-ই, তুলব দুজন মিলে—সে-কারণে তরী
রণতরী থাকতেই পারে সীমানায়—কে-বা তাকে দোষ বলে?!
আর, ভয় দেখিয়ে কোনোই লাভ নাই, ট্যাকা নিয়ে আসেন—যা
বলেছে পত্রবাহক আমার, তা কিন্তু প্রেমরীতি—গুসতাকি
নেবেন না জনাব—এ-তো মাঠের আলাপ, তা না হলে
সাঙপাঙ্গ
ধরে রাখাটা কি যায়?!’ ‘আচ্ছা, তবে শর্তহীন টি-টেবিল ডাকি:
কিন্তু হে সুন্দরী—ফের যদি যাও তুমি উত্তুরে যুবকের কাছে,
তোমার কপালে তবে, সাদ্দামের কপালের, শনি লেখা আছে…’সুন্দরীনামা ১২
এই পৃথিবীর সব, সবটাই নিছক নাটক —এই প্রেম,
এই ঘৃণা, এই শ্লেষ, অভিমান—চোখে চোখে এই চেয়ে থাকা—
কতক্ষণ, বলো কতক্ষণ অপলক চেয়ে থাকা যায়— বলো
মাহমুদা?! এই শীত, এ-বসন্ত, মৌমাছি, পাখিডাকা—
সমুদ্র-পাহাড়-মেঘ, গভীরবনানী-চাঁদ, নীলাকাশ তারা
ভরা—সব-কিছু জলতল থেকে উঠে আসা বুদবুদ—আর,
এই রং এই রেণু, এই যে দেহের ভঙ্গিমা: নিরেট নিপূন ফাঁদ—
এই ফুল বৃক্ষলিঙ্গ, এই মধু কামরস: উৎকৃষ্ট আহার—
এ-জন্যই যত যুদ্ধ, আগ্রাসন, ধ্বংসজজ্ঞ, মহাবোমাবাজি
—আছে জাতিসংঘ—যদি ভালোবাস, আসো— বলো, আছ তুমি রাজি?সুন্দরীনামা ১৩
হেমন্তের শীত-শীতে দেখা হলো—আমাদের দুজনের—ফের…
গাজায় তুমুল যুদ্ধ—আকাশে উড়ছে ড্রোন, হাইপারসনিক
মিসাইল, রকেট লঞ্চার আর ধুলাস্তূপমতো ধসে-খসে
পড়ছে হাইরাইজ বিল্ডিং—চিৎকারে মুখরিত চারিদিক—
আমরা দুজন তবু মুখোমুখি—চেয়ে আছি অপলক—এক
জন আরেক জনের চোখে। দৃশ্যটা যেন-বা বাঘ-বাঘিনীর
—যেন রাতে রমণার বৃক্ষতলে দু-জোড়া টর্চলাইট জ্বলে। না প্রেম, না ভালোবাসা—আমরা দুজন তবু ক্ষিপ্র ও অধীর—
ঘনশ্বাস, খামচা-খামচি, কামড়া-কামড়ি, তীব্র চুমাচুমি—
খুলে যাচ্ছে পেটিকোট, ছিঁড়ছে শার্ট, ব্র্যা—বাজছে ঝুমঝুমি…সুন্দরীনামা ১৪
তোমার নাম দিলাম—মৌরি। মৌরিফুলের সৌন্দর্যের
মতোই
সে-এক দেশ আছে—সুন্দরীতমা। সে-দেশের মানুষেরা কালো,
তবু, মন ভালো—এর বেশি বলিব না—তাহা। এই সব সূত্র ধরে-ধরে যদি-বা কেউ তোমাকে খুঁজে পায়—পেযে যাক—ভালো:
আমি মোটে চিন্তিত নই—তা নিয়া। কিন্তু, মেয়ে—তুমি সেই ভয়ে,
সরে গেছ: হয়তো বাসনি ভালো, নয় তো প্রেমিক ছিল—আর,
আমাকে বানিয়ে ছিলে সিঁড়ি—কী আমার হয়েছে তাতে ক্ষয়?
এ-বুকে—পা রেখে-রেখে—ধুলা ফেলে ছেঁড়া স্যান্ডেল-জুতার—
এক তলা দুই তলা করে—কত কত জন গেল ছাদে—আর,
ছাদের রেলিং বেয়ে পড়ে গেল—কতটুকু ক্ষতি হলো কার?!সুন্দরীনামা ১৫
যদি ভালোবাস, সহজ-সরল ভাবে আসো—তারপর বলো,
ভালোবাসি। এর চেয়ে বেশি কিছু না—না-গোলাপ, না-নতজানু…
মনে রেখো—পৃথিবীর সব চেয়ে দামি—তুমি আর আমি—আর
সব ছাই: মনে মন মিলে গেলে মুহূর্তেই হয়ে যাব জানু—
না মিললে-বা ক্ষতি কি—চলো, দুজন নতুন এক সম্পর্কে জড়াই—
এই মুক্ত বিশ্বায়নযুগে—রোগে-শোকে ভুগে—ক্যানো বলো, দেবু আর
পারু হতে যাব! কিংবা রেগে প্রতিশোধ নিতে—অ্যাসিড কি
ছুরি
মেরে দেব?!—এ বড় অমানবিক, পাশবিক, অসভ্য আচার।
প্রেমিক-প্রেমিকা যদি না-ই হই—চলো আমরা বন্ধু হয়ে যাই—
হাতে হাত ধরে ঘুরি—ওলি-গোলি—হইচই—পাড়াটা দাপাই…সুন্দরীনামা ১৬
সারা মাঠ সোনা হয়ে গেছে। চেয়ে দেখি—হেমন্ত এসেছে! আর,
হেমন্ত এলেই খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে কিষান-কিষানী:
নাওয়া নেই, খাওয়া নেই—নেই ঘুম, বিশ্রামের এক বিন্দু লেষ:
এই সব ব্যস্ততার হেতু কেন আগে আমি বুঝতে পারিনি?
ধান পেকে গেছে, আমাদের প্রেমও পেকে গিয়েছিল—হায়! ধান
পেকে গেলে মাঠে-মাঠে ঝরে যায়—তাই, খুব বেশি পাকবার
আগেই সে-ধান কেটে, উঠোনে শুকিয়ে, গোলা ভরে রাখে বোদ্ধা
কিষান-কিষানী। প্রেম পেকে গেছে জেনেও তুলিনি যেই প্রেমভার
ঘরে—গেল ঝরে: চেয়ে-চেয়ে দেখি—সেই প্রেম আজ কাকে খায়!
ধান, প্রেম যদি পাকে—ঠিক-সময়ে না তুললে তা—ঝরে যায়…সুন্দরীনামা ১৭
চুপ থেকে-থেকে একদম বৃক্ষ হয়ে গেছি—যখন আমাকে
ঠোকরাও আর উচ্চ-উল্লাসে মুহুর্মুহু হাস—আমার হৃদয়
টুকরো-টুকরো—হয়—ফালি-ফালি: হে ঝুঁটিওয়ালী—কী আনন্দ
পাও তুমি—বলো?! ভাবি—তোমার সুন্দর ঠোঁট কী-করে যে হয়
এতটা কঠিন-শক্ত—ধারালো ইস্পাত যেন—সুতীক্ষ্ণ হ্যামার!
যে গর্ত করেছ বুকে, ছিলে সুখে—ছা-বাচ্চা-সমেত উড়ে গেলে—
এতটুকু টু-শব্দ করিনি। চুপ থাকতে-থাকতে পুরোপুরি
অন্ধ হয়ে গেছি আজ—এমন বৃক্ষ-মানব—বলো, কোথা মেলে?!
হে সুন্দরী কাঠঠোকরা—ফের যদি পৃথিবীতে আসি—মানুষ না,
যেন আমি বৃক্ষ হই—কারণ, বৃক্ষের নাকি হৃদয় থাকে না…
মন্তব্য করুন