বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ দুই পরাশক্তির

সামিয়া রহমান প্রিমা, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ০৯:৫৪ | প্রকাশিত : ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ০৯:৫০

বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভারত, চীন এবং রাশিয়া মনে করে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচন করতে সক্ষম। একইসঙ্গে এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা চায় বলে বারবার স্পষ্ট করেছে ভারত। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলে আসছে। বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে তাদের সমর্থন নেই বলেও জানিয়েছে পশ্চিমারা।

গত ২৭ মে বাংলাদেশের উদ্দেশে ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। বলা হয়, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। এর আওতায় রয়েছে দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনী বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারপন্থি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, এবং বিচার বিভাগ। গত ২২ সেপ্টেম্বর এই নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ শুরু হয়েছে বলে জানায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার।

সম্প্রতি রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভাও বাংলাদেশ নিয়ে মন্তব্য করেছেন। ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি. হাস বংলাদেশে সরকারবিরোধী পরিকল্পনা করছে- এমন অভিযোগ এনেছেন রুশ মুখপাত্র। দেশটির এমন মন্তব্যে পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো দলকে সমর্থন করে না, তারা বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

এমন বাস্তবতায় বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য সমর্থন করে না ঢাকা। এ থেকে বিরত থাকার আহ্বানও জানায় বাংলাদেশ।

এই পরিস্থিতিতে দেশের জনগণের মাঝেও উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। রাজধানীর বাংলামোটরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন ৭০ বছর বয়সী মো. লিয়াকত আলী। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেছিলেন, ‘বাইরের হস্তক্ষেপ তো কামনা করি না। আমাদের নিজস্ব ব্যাপারে অন্যদেরকে মাথা ঘামাতে কেন দেবো? আমি আপনি ভাই-ভাই। আমরা মারামারি করবো, পরে আবার মিলবো। অন্যরা আইসা তো পরে আবার তাদের স্বার্থ দেখবে। আমাদেরকে বাধায় দিয়া তাদের স্বার্থ হাসিল হয়। এটা আমরা চাই না। আমি চাই, ঝগড়া বিবাদ যা বাঁধছে, সেটার মীমাংসা আমরাই করবো।’

জনগণের মাঝে এই উদ্বেগের বস্তুগত ভিত্তি আছে বলে মত দিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে তো ঝুঁকি থাকবেই। আমরা যদি মানুষকে বিশ্বাস করতে পারতাম, মানুষের ক্ষমতায়ন ঘটাতে পারতাম এবং তাদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যদি ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন এবং এক্ষেত্রে উত্তরণ ঘটাতে পারতাম তাহলেই কিন্তু বিদেশিদের ওপর নির্ভরতা কমে যেত।’

আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন জাতির জন্য বিদেশিদের এই হস্তক্ষেপ দুঃখজনক, অপমানজনক এবং খুব বিপজ্জনক বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। এই বিশ্লেষক বলেন, ‘সংবিধানে লেখা আছে দেশের মালিক জনগণ। অথচ দেশের সম্পদ ও মানুষের কী হবে তা নিয়ে দেশের মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। আর এখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী, এবং ক্ষমতাবান গোষ্ঠী। বিদেশিরা ঠিক করছেন এ দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ।’

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিকভাবে খুব দুর্বল ও অপরিণত ব্যবস্থায় আছি। এখন ক্ষমতায় থাকতে হলে বিদেশি শক্তিগুলোকেও খুশি রাখতে হয়। বর্তমান সময়ে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া এরা হলো শক্তিশালী পক্ষ। এদের বিনিয়োগ যদি আমরা লক্ষ্য করি, এতেই বোঝা যায় বাংলাদেশের কত বড় ক্ষতি হচ্ছে।’

ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি স্পষ্ট করে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমরা যদি ভূরাজনৈতিকভাবে আমাদেরকে শক্তিশালী করতে পারতাম তাহলে সেভাবেই নেগোশিয়েট করতে পারতাম। সেটা হলো যে আমাদের প্রয়োজনে আমরা কাদের সঙ্গে কতটুকু কাজ করব। কাজেই আমার যদি মাটিতে পা না থাকে, জনগণের মত প্রকাশ থেকে যদি শক্তি না আসে তবে সেটা অবশ্যই দুর্বলতা।’

বাংলাদেশে ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লির স্বার্থ বিশ্লেষণ করে এই সাবেক রাষ্ট্রদূত জানান, ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটবর্তী দেশ হওয়ায়, নয়াদিল্লির প্রধান বিষয় নিরাপত্তা। এবং ওয়াশিংটনের অন্যতম কারণ বাণিজ্য। এছাড়া ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যেকের জন্যই বাণিজ্যিকভাবে একটি বড় বাজারে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের ভূরাজনীতিতে চীনের প্রভাব নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দুপক্ষই শঙ্কিত বলেও মত দিয়েছেন এম. হুমায়ুন কবির। এই কূটনীতিক বলেন, ‘আজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন এত সক্রিয়? কারণ মার্কিনরা বুঝে ভারত কে দিয়ে চীনকে ঠেকানো যায় না। চীন ভারতের চেয়ে পাঁচ গুণ শক্তিশালী হওয়ায় ঠেকানোর সক্ষমতা নয়াদিল্লির নেই। এজন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে সরাসরি অবস্থান নিয়েছে।’

দেশের ইতিহাসে যারা বিরোধিতায় থাকেন তারা বরাবরই এই পথেই যান উল্লেখ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ জানান, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী ছিল তখন তারাও বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়েছিল। এরশাদ পতনের আন্দোলন থেকে শুরু করে বরাবরই বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশি শক্তিগুলো সরব ছিল। এখনো বিদেশিদের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতা নির্ধারণের কাজ চলছে।

গত ১০ নভেম্বর নয়াদিল্লিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের (২+২) বৈঠকেও বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি আলোচিত হয়। বৈঠক শেষে সেসময় ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন একটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। সে দেশের জনগণই নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি ভারত শ্রদ্ধাশীল বলেও মন্তব্য করেছেন বিনয় কোয়াত্রা।

এদিকে ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লির বৈঠকের পর ভোটের আগে ভারত সফর করেছেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। গত ২৪ নভেম্বর দিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পাশাপাশি রাজনীতি ও নির্বাচন প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়। ঢাকায় ফিরে পররাষ্ট্রসচিব সাংবাদিকদের জানান, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকারের অঙ্গীকারে আস্থা রেখেছে ভারত।’

দেশের মানুষের উদ্বেগ, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোনো কিছু পাত্তা না দিয়ে সরকার নিজের পরিকল্পনাতেই হাঁটছে বলে জানান সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বাংলাদেশ তো আন্তর্জাতিক মহলের সদস্য। সেসব বিবেচনায় আচরণ নির্ধারণ করতে হবে। বাইরের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরায় তৈরি করতে হতে পারে। এই চাপ সামলানোর সক্ষমতা আমাদের আছে কি না, সেটা ভেবেই কাজ করতে হবে।’

২০২১ সালের সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আসে বাংলাদেশে। র‌্যাবের সাতজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগে এই নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটি।

(ঢাকাটাইমস/২৮নভেম্বর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

বেড়ার মেয়র আসিফ ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি, দেশ ছাড়লেন কীভাবে? কৌতূহল সর্বত্র

শিক্ষকদের পেনশনের টেনসনে স্থবির উচ্চশিক্ষা

কেরাণীগঞ্জে দেড় কোটি টাকার নিষিদ্ধ ব্রাহমা গরুর সন্ধান

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি চালুর উদ্যোগ কতটা গ্রহণযোগ্য? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

সর্বজনীন পেনশনে অনীহা কেন, যা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকনেতারা

সাদিক অ্যাগ্রোর সবই ছিল চটক

ঢাকা মহানগর বিএনপি ও যুবদলের কমিটি দিতে ধীরগতি যে কারণে

রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক: উপজেলা হাসপাতালগুলোতে নেই চিকিৎসা সক্ষমতা

মাগুরায় বাড়ি-জমি উত্তম কুমারের: কোথাও খোঁজ নেই তার, দুদকের অনুসন্ধান সম্পন্ন

কোথায় পালিয়েছে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বার, জানে না পুলিশ, স্থায়ী বরখাস্ত হলেই ডুমাইনে ভোট

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :