রাজনীতিতে মানবিক সংকট বাড়ছে

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের বয়স অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের অর্জন কম নয়। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক- সব দিক দিয়েই এগিয়েছে বাংলাদেশ। পঁচাত্তর পরবর্তী প্রায় দেড় দশকের সামরিক শাসনামলে জাতীয় রাজনীতিতে আদর্শিক পরিবর্তন ঘটেছিল। তবে উন্নয়ন ভাবনায় সামরিক শাসকরা খুব বেশি পিছিয়ে ছিলেন- এ কথা বলা যাবে না। নব্বই পরবর্তী দেড় দশক বিএনপি ও আওয়ামী লীগ- উভয় দলই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিল। সে কালপর্বে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা কখনো মন্থর ছিল, কখনো বেশ গতি লাভ করেছিল। তারপর নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে তোয়াক্কা না করে সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে প্রায় দুই বছর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে। অতঃপর নবম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করে। পর পর তিনটি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ একটানা দেড় দশক ধরে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে আসছে। মধ্য নভেম্বরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো তফসিল প্রত্যাখ্যান করে দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিচ্ছে। ক্রমাগত এসব ভাংচুর, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের ফলে রাজনীতিতে মানবিক সংকট ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে।
বিএনপি ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে সংসদে বিরোধী দলের আসন লাভ করে জাতীয় পার্টি। মাঠের বিরোধী দল হিসেবে তখন থেকেই বিএনপি নানা আন্দোলন-সংগ্রাম, হরতাল-অবরোধ, ভাংচুর ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। দেশজুড়ে চরম মানবিক সংকট দেখা দেয়। তারপর দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠ অনেকটাই স্থিতিশীল ছিল। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল বাতিলের দাবিতে এখন আবার রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। দেশের মানুষকে আবার হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও এবং মানুষ হত্যার রাজনীতি দেখতে হচ্ছে। এ রাজনীতি দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে। জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। মানবিক সংকট সৃষ্টি করছে। গত এক বছরে নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ও কসমেটিক-টয়লেট্রিজ সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ এমনিতেই খুব সংকটে আছে। তার ওপর চলমান হরতাল-অবরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। দিনমজুর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে। হরতাল- অবরোধে তাদের কাজ প্রায় বন্ধ বন্ধ অবস্থা। হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বিক্রি অনেক কমে গেছে।
একটি মৃত্যু সরকারের কাছে একটি সংখ্যা। বিরোধীপক্ষের কাছেও একটি সংখ্যা। কিন্তু যিনি মৃত্যুবরণ করলেন তার পরিবারের সারা জীবনের কান্না। এমনও হতে পারে, রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যুবরণকারী লোকটিই ছিল তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। এমন মৃত্যুতে একটি পরিবার মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয়। বিএনপির মতো একটি মূলধারার রাজনৈতিক দলের কাছে দেশের মানুষ এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি আশা করে না। গাড়ি পুড়িয়ে, মানুষ মেরে মানুষের জন্য রাজনীতি করা যায় না। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা, মানুষের বাসযোগ্য একটি দেশ ও সমাজ বিনির্মাণ করাই হলো সবচেয়ে বড়ো রাজনীতি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এখনো একটি শ্রেণি মানুষ মেরে রাজনীতি করতে চায়। মানবিক সংকট তৈরি করে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চায়। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রাজনীতির কেন্দ্রে থাকে মানুষ। মানুষকে কেন্দ্র করেই সকল মতাদর্শিক রাজনীতি বিকশিত হয়। তাই রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সর্বাগ্রে মানুষের কথাই ভাবতে হবে। মানুষকে দুর্ভোগ ও দুর্যোগের মধ্যে না ফেলে যেকোনো দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি যদি সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয় তাহলে সেটি হবে অমানবিক রাজনীতি। মূলধারার রাজনীতি কখনো সহিংস ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করতে পারে না। মহাত্মা গান্ধি বৃটিশ-ভারতের রাজনীতিকে অহিংস ও মানবিক করে তোলার জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু রাজনীতিকে মানবকেন্দ্রিক করে তুলতে চেয়েছিলেন। এ কারণে তিনি রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করতেন। সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির মধ্যেও তিনি গরিব-দুঃখী ও মেহনতি মানুষের কথা মনে রাখতেন। ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি যখন বলেন: ‘আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেজন্য সমস্ত অন্যান্য যে জিনিসগুলো আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবেÑ শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দপ্তর, ওয়াপদা কোনোকিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন’; তখন বঙ্গবন্ধুর এই মানবিক রাজনীতির কথা আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ না করে পারি না। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ও হিংস্র পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়েও বঙ্গবন্ধু প্রতিপদে ভেবেছেন সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কথা। ‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে’- বঙ্গবন্ধুর এই কথাটি সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিটি নেতা-কর্মীর রাজনীতির মূলমন্ত্র হওয়া উচিৎ। দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি সাধারণ মানুষের পক্ষে নেই। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে সরকার খুব একটা বেকায়দায় পড়ছে না। সরকারি অফিস-আদালত, কল-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- সবকিছু চলছে। আর সবকিছু চলছে বলে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ- কেউ ঘরে বসে থাকতে পারছে না। কিন্তু রাস্তায় বের হতে হচ্ছে ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে। রাজনীতিতে নীতির জায়গাটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অসৎ উপায়ে অর্জিত সম্পদের মালিক হয়ে কিছু মানুষ এখন রাজনীতিকে পেশা হিসেবে নিচ্ছে। তারা অনেক ক্ষেত্রেই মানবিক মূল্যবোধহীন মানুষ। এলিট শ্রেণি এখন রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের মেধারীরা রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে না। দেশের জন্য এটা কোনো স্বস্তিদায়ক বিষয় নয়।
সরকার একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারণ করে রাজনীতি। তাই রাজনীতিতে মেধাবীদের অংশগ্রহণ জরুরি। কিন্তু দেশ সেদিকে যাচ্ছে না। বর্তমান রাজনীতিতে আদর্শিক দিকটি খুব দুর্বল। রাজনৈতিক দলগুলো যতটা ক্ষমতাকেন্দ্রিক ততটা মানবকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে না। ফলে রাজনীতিতে মানবিক সংকট বাড়ছে। রাজনীতিতে ‘ক্ষমতা’ শব্দটিকে আপত্তিকর মনে করা যায়। জনগণ আসলে কাউকে ক্ষমতা দেয় না, দেয় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্ষমতাধর না হয়ে দায়িত্বশীল হওয়া উচিৎ। একটি রাজনৈতিক দল যখন দেশ ও জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল হবে তখন সে দলটি মানবিকও হবে। কিন্তু সেই আদর্শিক অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছে রাজনীতি। বিএনপির মতো একটি বৃহৎ দল নির্বাচন বর্জন করে নাশকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চলমান হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও ও প্রত্যাখ্যানের রাজনীতি মানবিক সংকটকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে- যা কারো কাম্য নয়।
আলী রেজা: পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন