লেখা শেষ হলো না ‘রোবেলের’, পিচঢালা সড়কেই রচিত হলো গল্পের শেষটা

আহমাদ সোহান সিরাজী, সাভার (ঢাকা), ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৩৬ | প্রকাশিত : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:২১

‘আব্বা বহুকষ্টে ঘরটা বানাইছিলো। আব্বা নাই, ঘরটা তবুও দাঁড়িয়ে আছে! আব্বা তার নামটাও লিখতে পারতো না! তার বড় ছেলে আজ বিসিএস ক্যাডার! ছোট দুই ছেলেও দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত।’-এটিই ছিলো তরুণ লেখক রোবেল পারভেজের মৃত্যুর আগে দেয়া শেষ ফেসবুক স্ট্যাটাস।

ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির পাশাপাশি রোবেলের স্বপ্ন ছিল সে বিসিএস ক্যাডার হবে। তাই পড়াশোনা শেষে ব্যাংকে চাকরি হবার পরও পুরোদমে চালিয়ে গেছেন বিসিএসের প্রস্তুতি এবং দুমাস আগে ৪১তম বিসিএসের ফলাফলে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হবার মাধ্যমে পৌঁছে গিয়েছিলেন স্বপ্নের একেবারেই কাছাকাছি বাকি ছিলো কেবল আনুষ্ঠানিকতার। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণের শেষটুকু লেখা হলো না তার। বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে পিচঢালা পথেই গল্পের শেষ অধ্যায় রচনা করলেন স্বপ্নবাজ এই তরুণ।

বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে নয়টার দিকে অফিস যাবার উদ্দ্যেশ্যে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঢাকার ধামরাই বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাসের জন্য অপেক্ষমাণ অবস্থান বেপরোয়া গতির সেলফি পরিবহনের বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যান তিনি।

নিহত রোবেল পারভেজ টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার মৃত মোকছেদ আলীর ছেলে তবে পরিবারসহ বসবাস করতেন ঢাকার ধামরাই পৌরসভার বাগনগর এলাকায়। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ৪০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। লেখাপড়া শেষ করে বেসরকারি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মানিকগঞ্জের ঝিটকা শাখায় কর্মরত ছিলেন।

বাবাহারা পুরো সংসারে একমাত্র রোবেলই ছিলো আশার বাতিঘর। টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি জুগিয়েছেন ছোট দুইভায়ের উচ্চশিক্ষার খরচ। কিছুদিন আগে নিজেও হয়েছিলেন পিতা। সবমিলিয়ে ভাঙা ঘরের চালে যখন সুখের পূর্ণিমার আলো ধরা দিয়েছিলো তখনই নিষ্ঠুর বিদায় নিতে হলো তাকে।

মুঠোফোনে নিহত রোবেলের ছোটভাই সোহেল পারভেজ কান্নাজড়িতকণ্ঠে বড়ভাইয়ের স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে বলেন, বাবা মারা যাবার পর এই ভাই ই আমাদের সকল আবদার মিটিয়েছেন। নিজে টিউশনি করে আমাদের লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। কখনো কস্ট বুঝতে দেননি। নিজে একজন স্বপ্নবাজ মানুষ ছিলেন আমাদেরকেও বলতেন আমাদের বাবা অশিক্ষিত ছিলেন কিন্তু আজ আমরা তিনভাই আজ সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত দেখবি একদিন আমরা সবাই সমাজে অনেক প্রতিষ্ঠিত হব। আমাদের সংসারটা যখন একটু সুখের মুখ দেখা শুরু করেছিলো তখনই আমরা আমাদের মাথার উপরের ছাদটাকে হারিয়ে ফেললাম। জন্মের মাত্র দেড় বছরের মাথায় এতিম হওয়া আমার ছোট্ট ভাতিজিটাকে আমরা কি জবাব দিবো বলতে পারেন? ঘাতক বাস আজ শুধু আমার ভাইয়ের একার প্রাণ নয়, কেড়ে নিয়েছে আমাদের পরিবারের সবার প্রাণ। আমার ভাইয়ের এই মৃত্যু স্বাভাবিক কোন মৃত্যু নয়। আমি আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই।

এদিকে রোবেলের মৃত্যুতে কার্যত শোকে ভাসছেন তার শিক্ষক, সহপাঠী ও এলাকাবাসীরা। অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে আবেগঘন ভাষায় অভিব্যক্তি প্রকাশ করছেন। রোবেলের মৃত্যু পরিচিতদের কেউই যেন মেনে নিতে পারছেন না। আল আমীন হালদার নামের এক বিসিএস কর্মকর্তা তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ঘাতক বাস প্রান কেড়ে নিলো একজন সুপারিশপ্রাপ্ত বিসিএস ক্যাডারকে, একজন ভবিষ্যতের অর্থনীতিবিদকে, একজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে, সম্ভাবনাময় একজন লেখককে, একজন জাবিয়ানকে। বাসচালক ও সেলফি পরিবহনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। মহান আল্লাহ তায়ালা রোবেল পারভেজ বন্ধুকে জান্নাতুল ফেরদৌসে আসীন করুন।

ধামরাই উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন লিখেছেন, কি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। এটি দুর্ঘটনা নয়, সেলফি নামক ঘাতক স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের উপর হামলে পরে তিনজনের তাজা প্রাণ কেড়ে নিল।

রুবেল পারভেজ ব্যাংক কর্মকর্তা, বিসিএস ক্যাডার হিসেবে সদ্য সুপারিশপ্রাপ্ত। লেখক, সাহিত্যিক আমার অত্যন্ত প্রিয় ভাজন, তার লেখা ‘শিলা তলে পদ্মপাতা’ বইটি আমাকে উপহার দেয়ার জন্য এসেছিল আমার কার্যালয়ে। অনেক আলাপ হয়েছিল সেদিন এই সম্ভাবনাময় যুবকের সাথে। আমার ভাবতেই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রুবেল নেই। তার ছোট্ট শিশু, তার পরিজন কতই না কষ্ট পাচ্ছে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে। আমরা উপযুক্ত বিচার চাই, শাস্তি চাই বাস চালক নামের সেই ঘাতকের। সর্বোপরি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে প্রার্থনা যেন রুবেলকে ক্ষমা করে দেন আর বেহেস্ত নসীব করেন।

এছাড়া রোবেলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পরলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রধান ফটকের সামনে অভিযুক্ত সেলফি পরিবহনের প্রায় পঁচিশটি বাস আটক করে। এ সময় এই বাসের রুট পারমিট বাতিলসহ ঘাতক বাস চালকের শাস্তি ও নিহতের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তারা।

এদিকে সেলফি পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের বেপরোয়া চলাচলের কারণে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করেছেন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মীসহ স্থানীয় বাসিন্দারা। নিয়ম ভেঙে সার্ভিস লেনে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানোর বিষয়টি না মেনে নিরবচ্ছিন্নভাবে গাড়ি চলাচলের লেনে যাত্রী ওঠানো–নামানোয় অনেক যাত্রী বাধ্য হয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গাড়ি চলাচলের লেনে বাসের জন্য অপেক্ষা করেন বলে দাবি করেন তারা।

এ বিষয়ে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) ধামরাই উপজেলা শাখার সহসভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, কয়েকটি পরিবহনের বেপরোয়া মনোভাব এবং সড়কে একক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার ফলে মহাসড়কে নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। সড়কে নিয়ম অনুযায়ী বাসে যাত্রী ওঠানামা করাতে হলে পরিবহনগুলোকে অবশ্যই সার্ভিস লেনে আসতে হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রশাসনের নজরদারির অভাবই মূলত দায়ী।

(ঢাকাটাইমস/০৮ডিসেম্বর/জেডএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :