ক্যানসারের ঝুঁকি কমায় ভেষজ ঔষধি কালোজিরা

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:৫০

সৃষ্টির শুরুর আদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত কালোজিরা মসলা ও ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রাচীন ইতিহাসে কালোজিরাকে মানব দেহের জন্য মহৌষধ মনে করা হত। প্রাচীনকাল থেকে এখন আয়ুর্বেদিক, ইউনানি ও কবিরাজি চিকিৎসাতে ও কালোজিরার তেল ব্যাপক ব্যবহার করা হয়।

কালোজিরার আদি নিবাস দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া। কেউ কেউ বলেন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এর উৎপত্তি স্থান। ওষুধ শিল্প, কনফেকশনারি শিল্প ও রন্ধনশালায় নিত্যদিনের ব্যঞ্জরিত খাবার তৈরিতে কালোজিরার জুড়ি নেই। বিভিন্ন খাবারের পাশাপাশি পানীয় দ্রব্যকে রুচিকর ও সুগন্ধি করার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। নিয়মিত খেলে বহু রোগই ঠেকিয়ে দেওয়া যায়।

ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা কালোজিরাকে একটি অব্যর্থ রোগ নিরাময়ের উপকরণ হিসেবে বিশ্বাস করে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেছেন, “তোমরা কালোজিরা ব্যবহার করবে, কেননা এতে একমাত্র মৃত্যু ব্যতীত সর্ব রোগের মুক্তি রয়েছে। – তিরমিযি, বুখারি, মুসলিম।

কালোজিরা একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ জাতীয় ফলের অভ্যন্তরীণ বীজ। কালোজিরার বৈজ্ঞানিক নাম নাইজেলা স্যাটিভা লিন। কালোজিরা ফলের আকার গোলাকার এবং প্রতিটি ফলে ২০-২৫ টি বীজ থাকে। কালোজিরার বীজগুলো কালো বর্ণের এবং আকৃতি প্রায় ত্রিকোণাকার। এর বীজগুলো একটি খোলসের ভিতরে থাকে। খোলসের ভিতরে অনেক বীজ থাকে। মূলত এই বীজগুলোকে বলা হয় কালোজিরা। এই বীজগুলো থেকে কালো জিরার তেল উৎপাদন করা হয়।

কালোজিরার তেলে ১০০টিরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে মানব দেহের জন্য। কালোজিরার অন্যান্য উপাদানের মধ্যে রয়েছে নাইজেলোন, থাইমোকিনোন ও স্থায়ী তেল। এতে আরও রয়েছে আমিষ, শর্করা সহ ও প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিড সমূহ। পাশাপাশি কালোজিরার তেলে আছে লিনোলিক এসিড, অলিক এসিড, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, জিংক, ম্যাগনেশিয়াম, সেলেনিয়াম, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-বি২, নিয়াসিন ও ভিটামিন-সি।

কালোজিরা তেলের মধ্যে আরও রয়েছে ফসফেট, লৌহ, ফসফরাস, কার্বো-হাইড্রেট ছাড়াও জীবাণু নাশকের বিভিন্ন উপাদান সমূহ। এতে রয়েছে ক্যানসার প্রতিরোধক কেরোটিন ও শক্তিশালী হরমোন ও প্রস্রাব সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকারী উপাদান সমূহ। এছাড়াও আরো রয়েছে এনজাইম ও অম্লনাশক উপাদান এবং অম্লরোগের প্রতিষেধক।

নিয়মিত ও পরিমিত কালিজিরা সেবনে শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সতেজ করে ও সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি সমৃদ্ধি সাধন করে। জেনে নিন আশ্চর্য বীজ কালিজিরার বহুমুখী স্বাস্থ্য উপকারিতা।

নিয়মিত কালোজিরা খেলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, একজিমা, এলার্জি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে থাকে। কালোজিরায় ভিটামিন, স্ফটিকল নাইজেলোন, অ্যামিনো অ্যাসিড, স্যাপোনিন, ক্রুড ফাইবার, প্রোটিন, ফ্যাটি অ্যাসিডের মতো লিনোলেনিক, ওলিক অ্যাসিড, উদ্বায়ী তেল, আয়রন, সোডিয়াম, পটাসিয়াম ও ক্যালসিয়াম রয়েছে।

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে কালোজিরা তেলের নিয়মিত ব্যবহার ব্রেইন ক্যানসার ও ব্রেস্ট ক্যানসার সেল জন্মাতে বাধা দেয়। কালোজিরার তেলে থাকা থাইকিউমিন প্রোগ্রাম মূলত ক্যানসার প্রতিরোধে কাজ করে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত কালোজিরা খেলে ক্যানসার প্রতিরোধের কাজে কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকবেন। এই ভেষজে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যানসার কোষ সৃষ্টিকারী ফ্রি ব়্যাডিকেলসের বাড়বাড়ন্ত কমানোর কাজে সিদ্ধহস্ত। তাই এই মারণ অসুখের থেকে দূরত্ব বজায় রাখার ইচ্ছে থাকলে প্রতিদিন অন্তত এক চামচ কালোজিরা সেবন করুন। এতেই স্বাস্থ্যের হাল-হকিকত বদলে যাবে।

পুরাতন টিউমার সারাতে বেশ প্রাচীনকাল থেকে কালোজিরা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কালোজিরার তেলে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পুরাতন টিউমারের সেল গুলোকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে।

আয়ুর্বেদ মতে, সামান্য কালোজিরা পাতলা কাপড়ে পুঁটলি করে ভাল করে ঘষে শুঁকলে নাক ও গলায় জমে থাকা সর্দি বেরিয়ে যায়। পাবমেডে প্রকাশিত এক গবেষণা পত্রে জানা গিয়েছে যে নিগেলা সাটিভা এল (কালোজিরের বিজ্ঞান সম্মত নাম) থেকে যে এসেনশিয়াল অয়েল পাওয়া যায় তাতে ৩৭.৩ শতাংশ প্যারাসাইমিন ও ১৩.৭ শতাংশ থার্মোক্যুইনিয়ন আছে। প্রাণীদেহে পরীক্ষা করে এই উদ্বায়ী তেলের অ্যানালজেসিক ও অ্যান্টিইনফ্ল্যামাটরি গুণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে।

বাজারে যে কালোজিরার তেল পাওয়া যাচ্ছে তার ঔষধিগুণ সম্পর্কে যথেষ্ট সম্বন্ধে সন্দেহ থেকে যায়। তাই বাড়ির মশলা হিসেবে যে কালোজিরা থাকে তা সরাসরি ব্যবহার করা উচিত। তেলে ফোড়ন হিসেবে ব্যবহার করার চেয়ে কালোজিরা বেটে ভাতের সঙ্গে খাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া সর্দি হাঁচি কাশি হলে কাপড়ে পুঁটলি করে ঘষে শুঁকলে ভাল কাজ হয়।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে কালোজিরা। নিয়মিত কালোজিরা খেলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সতেজ থাকে। এতে করে যে কোনও জীবানুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেহকে প্রস্তুত করে তোলে এবং সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি করে।

কালোজিরার তেল ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখতে সহায়তা করে। প্রতিদিন সকালে এক কাপ চায়ের সঙ্গে আধা চা চামচ তেল মিশিয়ে পান করুন।

ডায়েটের জন্য কালোজিরা দারুণ কাজ করে। রুটি ও তরকারিতে ব্যবহার করতে পারেন। অনেকেই মধু ও পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেয়ে থাকেন। কালোজিরা ওটমিল ও টক দইয়ের সঙ্গে যুক্ত করে খেলে বেশ উপকার পাবেন।

লেবুর রস ও কালোজিরা তেল একসঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করলে ত্বকের অনেক সমস্যার সমাধান পেতে পারেন। লেবুর রস ও কালোজিরার তেল মিশিয়ে দিনে দুইবার মুখে লাগান। ত্বকে ব্রণ ও দাগ অদৃশ্য হয়ে যাবে।

কালোজিরা তেল মাথাব্যথার জন্য একটি পুরানো ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে বলা হয়। এটি মাথার ত্বকের ম্যাসাজ করুন।

সরিষার তেলের সঙ্গে কালোজিরা তেল গরম করে হাঁটু বা অন্যান্য জয়েন্টগুলোতে ম্যাসাজ করতে পারেন। এটি জয়েন্টের ব্যথা থেকেও মুক্তি পেতে সহায়তা করবে।

কালোজিরায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায়, প্রদাহ, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হ্রাস করার ক্ষমতাসহ লিভারকে সুরক্ষিত করতে সহায়তা করে। কালোজিরা রাসায়নিকের বিষাক্ততা কমাতে পারে। লিভার ও কিডনি ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।

সর্দি-কাশিতে আরাম পেতে, এক চা চামচ কালোজিরার তেলের সঙ্গে ১ চা চামচ মধু বা এক কাপ লাল চায়ের সঙ্গে আধ চা চামচ কালোজিরের তেল মিশিয়ে দিনে তিনবার খান। পাতলা পরিষ্কার কাপড়ে কালিজিরা বেঁধে শুকালে, শ্লেষ্মা তরল হয়। পাশাপাশি, এক চা-চামচ কালোজিরার সঙ্গে তিন চা-চামচ মধু ও দুই চা-চামচ তুলসি পাতার রস মিশিয়ে খেলে জ্বর, ব্যথা, সর্দি-কাশি কমে। বুকে কফ বসে গেলে কালিজিরে বেটে, মোটা করে প্রলেপ দিন একই সাথে।

নিয়মিত কালোজিরা খেলে দেহে রক্ত সঞ্চালন ঠিকমতো হয়। এতে করে মস্তিস্কে রক্ত সঞ্চালনের বৃদ্ধি ঘটে; যা আমাদের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

নিয়মিত কালোজিরা খাওয়ালে দ্রুত শিশুর দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি ঘটে। কালোজিরা শিশুর মস্তিষ্কের সুস্থতা এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতেও অনেক কাজ করে।

এছাড়াও নিয়মিত কালোজিরা সেবনে চুলের গোড়ায় পুষ্টি ঠিকমতো পায়, ফলে চুলের বৃদ্ধি ভালো হয় এবং চুল পড়া বন্ধ হয়। অনেকেরই চুল পড়া, দুর্বল চুল, শুষ্ক চুল ইত্যাদি নানা রকম সমস্যা থাকে। এক্ষেত্রে সপ্তাহে কয়েকবার কালোজিরার তেলের ব্যবহার চুলের সমস্যাকে দূর করতে পারে।

অ্যালার্জিজনিত সর্দিকাশি ও অ্যাজমা প্রতিরোধ করতে কালোজিরে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। কালোজিরে বেটে গরম ভাতে সপ্তাহে এক দিন খেলে সর্দিকাশির প্রবণতা কমে। ত্বকের অ্যালার্জিজনিত প্রদাহ হলে কালোজিরা বাটা লাগালে দ্রুত উপশম হয়। ত্বক উজ্জ্বল রাখতে ও চুল ঝরা বন্ধ করতে কালোজিরে বেটে প্রলেপ দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়।

যেসব মায়েদের বুকে পর্যাপ্ত দুধ নেই, তাদের মহৌষধ কালোজিরা। প্রসূতি মায়েরা প্রতি রাতে শোয়ার আগে ৫-১০ গ্রাম কালোজিরা মিহি করে দুধের সাথে খেলে মাত্র ১০-১৫ দিনে দুধের প্রবাহ বেড়ে যাবে। এছাড়া এ সমস্যা সমাধানে কালোজিরা ভর্তা করে ভাতের সাথে খেলেও ভাল। এছাড়া ১ চা-চামচ কালোজিরার তেল সমপরিমাণ মধুসহ দিন ৩বার করে নিয়মিত খেলেও শতভাগ উপকার পাওয়া যায়।

যারা হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যায় ভুগে থাকেন তাদের জন্য কালোজিরা অনেক বেশি উপকারী। প্রতিদিন কালোজিরার ভর্তা রাখুন খাদ্য তালিকায়। কালোজিরা হাঁপানি বা শ্বাস কষ্টজনিত সমস্যা দূর করে।

কালোজিরার তেল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, হৃদরোগজনিত সমস্যার আশঙ্কা কমায়, ত্বকের সুস্বাস্থ্য, আর্থাইটিস ও মাংসপেশির ব্যথা কমাতে কালিজিরার তেল উপযোগী। কালোজিরা শরীরের জন্য খুব জরুরি। পেটের যাবতীয় রোগ-জীবাণু ও গ্যাস দূর করে। চুলপড়া রোধ করতে সাহায্য করে। শ্যাম্পু করার পর ১৫ মিনিট পর কালোজিরার তেল মালিশ করুন। এতে এক সপ্তাহেই চুলপড়া কমে যাবে। চায়ের সঙ্গে নিয়মিত কালোজিরা মিশিয়ে অথবা এর তেল মিশিয়ে পান করলে হৃদরোগে যেমন উপকার হয়, তেমনি মেদ কমে যায়।

(ঢাকাটাইমস/১৫ জানুয়ারি/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :