কোমর ব্যথা থেকে মুক্তির প্রাকৃতিক উপায়

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:৩৪ | প্রকাশিত : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:২৭

আজকাল মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে অজস্র মানুষ কোমরের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন। শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে এ ব্যথার শিকার হন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভুলভাবে বসে কাজ করার কারণে মানুষের মধ্যে এই সমস্যা বাড়ছে। মেরুদণ্ডের নিচের হাড়ের মধ্যবর্তী তরুণাস্থি বা ডিস্কের বার্ধক্যজনিত পরিবর্তনের ফলে এ ব্যথার সূত্রপাত হয়। তরুণাস্থির এই পরিবর্তনের সাথে সাথে মেরুদণ্ডের নিচের দিকে সংবেদনশীলতার পরিবর্তন হয়। সাধারণত এ পরিবর্তন ৩০ বছর বয়স থেকে শুরু হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ রোগের কোনো উপসর্গ থাকে না। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোগের উপসর্গও বাড়তে থাকে।

কোমরের স্বল্পমেয়াদি ব্যথা এক মাসের কম সময় থাকে এবং দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক ব্যথা এক মাসের বেশি সময় স্থায়ী হয়। উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বেশির ভাগ রোগী দুই মাসের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।

বড় কোনো আঘাতের ইতিহাস থাকলে, কোমর ব্যথার পাশাপাশি বুকে ব্যথা হলে, রোগীর আগে কখনো যক্ষ্মা হয়ে থাকলেও বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে।

ক্যানসার, অস্টিওপোরোসিস, এইডস, দীর্ঘকাল স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবনের ইতিহাস থাকলে কোমর ব্যথা হয়।

লিগামেন্ট হলো সুতার মতো টিস্যু যা বিভিন্ন হাড় ও জয়েন্টের (গিরার) মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শরীরের পেশি ও লিগামেন্টে হঠাৎ করে টান অথবা চাপ খেলে কোমর ব্যথা হয়।

কখনো কখনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই ব্যথা হতে পারে। এমনকি মানসিক চাপে থাকলেও এ ধরনের ব্যথা হয়।

আমরা যাকে ‘কোমর’ বলি, চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় তাকে বলে লাম্বার স্পাইন, বললেন ফিজিক্যাল মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ মৌলিমাধব ঘটক। ভুল ভঙ্গিমায় শোওয়া-বসা, হাঁটা চলা, সামনে ঝুঁকে ভারী জিনিস তোলা বা কখনো কখনো রিকশা, ট্যাক্সি বা বাসে ঝাঁকুনি লেগেও কোমরে ব্যথা শুরু হতে পারে।

কোমরের পাঁচটি হাড় আছে। বেশি বয়সে হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মেরুদণ্ডের দুটি কশেরুকার মাঝখানে যে ডিস্ক আছে, তাও ক্ষয়ে যায় বলে ব্যথা শুরু হয়, একে বলে ‘স্পন্ডাইলোসিস’।

প্রতিদিনের কাজকর্মের সময় শরীরের বিভিন্ন অংশে ওয়্যার অ্যান্ড টিয়ার হয়। অল্প বয়সে এই ক্ষয় পূরণ হয়ে গেলেও বেশি বয়সে তা হয় না। ফলস্বরূপ কোমরে ব্যথা করে। কোমরে ব্যথা শুরু হলে প্রথম চিকিৎসা বিশ্রাম।

ব্যথা কিন্তু হাড়ে হয় না, হয় পেশিতে। যথাযথ শরীরচর্চার অভাবে কোমরের দিকের পেশি বা মাসল শক্ত হয়ে যায়। এর সঙ্গে হাড়ের ক্ষয় যোগ হলে স্প্যাজম শুরু হয়।

কোমরে ব্যথা হলে বিশ্রাম নেওয়ার পাশাপাশি পেশির স্প্যাজমের ওষুধ দেওয়া হয়। ফলে ব্যথা কমে। অবশ্য খুব প্রয়োজন না হলে ব্যথার ওষুধ দেওয়া হয় না। এই প্রসঙ্গে চিকিৎসকরা বলেন, পেশির সংকোচন বা স্প্যাজম কিন্তু শরীরের একটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। স্প্যাজমের ফলে ব্যথা হলে মানুষ বাধ্য হয়েও বিশ্রাম নেয়। এর ফলে হাড় কিছুটা রক্ষা পায়, শরীর বড় ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্যে স্প্যাজম তৈরি করে। শুধু ব্যথার ওষুধ খেয়ে ব্যথা কমালে হাড়ের ক্ষয় বাড়বে। তাই কোমরের ব্যথায় অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ব্যথার কারণ জেনে চিকিৎসা করা উচিত।

কোমরে ব্যথা যে শুধু বয়স্ক মানুষদের হয় তা নয়, অল্প বয়সেও কোমরের ব্যথার ভোগান্তি হয়, বললেন অর্থোপেডিক সার্জন সুদীপ্ত ঘোষ। কম বয়সে কোমরের ব্যথার বিভিন্ন কারণের মধ্যে আছে স্লিপ ডিস্ক এবং দাঁড়িয়ে, বসে বা একই ভঙ্গিতে দীর্ঘক্ষণ থাকা এবং সামনে ঝুঁকে ভারি ওজন তোলার মতো ভুল ভঙ্গিমা। এর থেকে স্লিপ ডিস্ক ও মাসল স্প্যাজম হয়ে ব্যথার সূত্রপাত হয়।

চিকিৎসকের মতে, কোমর ব্যথার সমস্যার ডাক্তারি নাম স্পন্ডাইলোলিস্থেসিস। এই সমস্যা হলে কোমরের ব্যথার পাশাপাশি ব্যথা ঊরু হয়ে পায়ের দিকে নেমে আসতে পারে। পায়ের পিছন দিকের পেশিও শক্ত হয়ে যায়। মূলত খেলোয়াড়দের মধ্যে এই সমস্যার ঝুঁকি বেশি। ফুটবল, জিমন্যাস্টিক, ভারোত্তোলন ছাড়াও যাঁরা স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ করেন তাদেরও এই সমস্যা হতে পারে।

বয়স্ক মানুষদের কোমরে ব্যথার মূলে আছে অস্টিওপোরোসিসের কারণে মেরুদণ্ডের হাড় সংকুচিত হয়ে পড়া। এর ফলে নার্ভ ও পেশিতে চাপ পড়ে ব্যথার কষ্ট হয়।

কিডনিতে স্টোন হলে, প্যাংক্রিয়াসের অসুখ হলে, স্পাইনা-বাইফিডা নামে জন্মগত ত্রুটি থাকলে, বা অন্য কোনও বড় অসুখের উপসর্গ হিসেবেও কোমরের ব্যথা হতে পারে।

দৈনন্দিন কাজে সতর্কতা

নিচ থেকে কিছু তোলার সময়: কোমর ভাঁজ করে কিংবা ঝুঁকে তুলবেন না। হাঁটু ভাঁজ করে তুলুন।

কোনো কিছু বহন করার সময়: ঘাড়ের ওপর কিছু তুলবেন না। ভারি জিনিস শরীরের কাছাকাছি রাখুন। পিঠের ওপর ভারি কিছু বহন করার সময় সামনের দিকে ঝুঁকে বহন করুন।

শোয়ার সময়: উপুড় হয়ে শোবেন না। ভাঙ্গা খাট, ফোম বা স্প্রিংয়ের খাটে শোবেন না। সমান তোশক ব্যবহার করুন। বিছানা শক্ত, চওড়া ও সমান হতে হবে। শক্ত বিছানা বলতে সমান কিছুর ওপর পাতলা তোশক বিছানোকে বোঝায়।

দাঁড়িয়ে থাকার সময়: ১০ মিনিটের বেশি দাঁড়িয়ে থাকবেন না। হাঁটু না ভেঙে সামনের দিকে ঝুঁকবেন না। দীর্ঘক্ষণ হাঁটতে বা দাঁড়াতে হলে উঁচু হিল পরবেন না। অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হলে কিছুক্ষণ পর পর শরীরের ভর এক পা থেকে অন্য পায়ে নিন। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলে ছোট ফুট রেস্ট ব্যবহার করুন।

বসে থাকার সময়: আপনার চেয়ারটি টেবিল থেকে বেশি দূরে নেবেন না। সামনে ঝুঁকে কাজ করবেন না। কোমরের পেছনে সাপোর্ট দিন। এমনভাবে বসুন যাতে ঊরু মাটির সমান্তরালে থাকে। নরম গদি বা স্প্রিংযুক্ত সোফা বা চেয়ারে বসবেন না।

যানবাহনে চড়ার সময়: গাড়ি চলানোর সময় স্টিয়ারিং হুইল থেকে দূরে সরে বসবেন না। সোজা হয়ে বসুন। ভ্রমণে ব্যথার সময় লাম্বার করসেট ব্যবহার করুন।

এছাড়া অস্বাস্থ্যকর খাওয়া এবং শরীরে পুষ্টির অভাবও এর কয়েকটি কারণ। তবে ব্যায়াম ছাড়াও ডায়েটে নজর দিলে এবং পুষ্টিতে সমৃদ্ধ খাবার খেলে এই ব্যথা কমতে পারে। এখন দেখে নেওয়া যাক, কোন জাতীয় খাবার খেলে এই সমস্যা কিছুটা কমতে পারে।

ওমেগা-৩ ফ্যাটি সমৃদ্ধ অ্যাসিড খাবার খাওয়া উচিত। বাদাম, আখরোট, চিয়া বীজ, শণের বীজ এবং মাছ খাওয়া উচিত বেশি করে। কারণ এগুলোর মধ্যে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ভালো পরিমাণে পাওয়া যায়। রান্নায় সরষের তেল ও অলিভ অয়েল ব্যবহার করতে পারেন।

অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি খাবার যেমন দারুচিনি, গোলমরিচ এবং আদা ইত্যাদি। এছাড়াও, হলুদ এমন একটি মশলা, যা জয়েন্টের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।

ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার ডিম, দুধ, ডাল ইত্যাদি খেতে হবে।

ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে, আপনি ফুলকপি, ব্রকোলি, পালং শাক এবং বাঁধাকপি ইত্যাদির মতো সবুজ শাকসবজিও খেতে পারেন। বীট, গাজর, আনারস, আপেল, চেরি, বেরি, লেবু জাতীয় ফল, আঙুর খেতে পারেন।

ব্যথা হওয়ার আগেই কোমর ব্যথার সমস্যাকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। নিয়মিত শরীরচর্চা করা, পুষ্টিকর খাবার খেয়ে ওজন ঠিক রাখলে ভবিষ্যতে কোমরের ব্যথায় কষ্ট পেতে হবে না। ব্যথার ওষুধ না খেয়ে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, ব্যথা মুক্ত থাকুন। জেনে নিন কোমর ব্যথা মুক্ত থাকার কয়েকটি উপায়-

কোমর ব্যথায় আদা

কোমর ব্যথা খুব সহজে দূর করা সম্ভব। আদা যে কোনো ব্যথা কমাতে সক্ষম। আদার মাধ্যমেই দূর করে দিতে পারবেন এই সমস্যা। আসুন জেনে নিই এই সমস্যা সমাধানে কার্যকরী আদা পানি বানানোর প্রক্রিয়াটি। যা যা লাগবে- আদা, পরিষ্কার পাতলা কাপড়, গরম পানি। প্রথমে আদা কুচি করে ফেলুন। এরপর আদা কুচিগুলো পাতলা কাপড়ে রাখুন। কাপড়টির মুখ সুতা বা রশি দিয়ে বন্ধ করে দিন। একটা পুটলি বানিয়ে ফেলুন। এবার চুলায় পানি গরম করতে দিন। এই পানির মধ্যে আদার পটলিটা চিপে রস পানিতে দিন। রস ভাল করে চিপে ফেলার পর আদার পুটলিটা পানির মধ্যে দিয়ে দিন। এবার একটি কাপড় গরম আদা পানিতে চুবিয়ে নিন। এবার কাপড়টি থেকে ভাল করে পানি চিপড়িয়ে ফেলুন। এই আদা পানিতে চুবানো কাপড়টি ব্যথার জায়গায় রাখুন। লক্ষ্য রাখবেন কাপড়টা যেন খুব বেশি মোটা না হয়। সারা রাত কাপড়টি ব্যথার জায়গায় রেখে দিন। সারা রাত সম্ভব না হলে কয়েক ঘণ্টা এটি ব্যথার জায়গায় রেখে দিন। দেখবেন কোমর ব্যথা গায়েব হয়ে গেছে। এটি আপনাকে দীর্ঘমেয়াদি আরাম দেবে।

হট ব্যাগের ব্যবহার

কোমরের ব্যথা কমাতে হট ব্যাগ ব্যবহার করুন। মাঝে মাঝে হট ব্যাগ কোমরে চেপে ধরে রাখুন। এতে অনেকটা কমবে ব্যথা।

বরফ ব্যবহার করুন

কোমরে ব্যথা কমাতে বরফ ব্যবহার করতে পারেন। বরফের ব্যাগ কোমরে কিছুক্ষণ চেপে ধরে রাখুন। এতে সহজেই ব্যথা কমবে।

বসার কায়দা পাল্টান

দীর্ঘক্ষণ একভাবে বসে কাজ করেন? বসার কায়দা পাল্টান। মাঝে মাঝে হাঁটাহাঁটি করুন। এতেই ব্যথা থেকে অনেকটা রেহাই পাবেন।

পুদিনার তেল

পুদিনার তেলের ব্যথা উপশমকারী গুণ রয়েছে। এই তেল প্রতিদিন শোয়ার আগে মালিশ করুন। দুই দিনেই ব্যথা উধাও হবে।

(ঢাকাটাইমস/১ ফেব্রুয়ারি/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :