চতুর্থ মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে প্রত্যাশা

রেজাউল করিম হীরা
| আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:৪৩ | প্রকাশিত : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:৩৭

দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা চতুর্থবার জয় পেয়ে সরকার পরিচালনা শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করেছে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ঐতিহ্যবাহী এই দলটি। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়ে দেশ পরিচালনা শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। এর মধ্য দিয়ে নতুন সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে নতুনভাবে দেশ গড়ার উদ্যোম নিয়ে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন এই সরকারের কাছে এখন জন-আকাক্সক্ষা সবচেয়ে বেশি। কারণ, ১৫ বছর আগের বাংলাদেশ আর বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। দিন বদলের সনদ নিয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে বদলে দিয়েছে এই দেশ। স্বাধীনতার পর আর কোনো সরকারের আমলেই দেশে এতটা উন্নয়ন হয়নি। শুধু উন্নয়নই নয়, দেশকে ডিজিটালাইজড করা থেকে শুরু করে অবকাঠামোসহ সব ক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিশেষ করে নানা ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার জন্য সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ এবং সেই চ্যলেঞ্জে বঙ্গবন্ধু কন্যার যে বিরাট সাফল্য প্রমাণিত হয়েছে তা আজ বিশ^বাসী সম্পূর্ণ অবগত। এই সেতু বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর যাতায়াত বিষয়ক দুঃখ ঘুচেছে। এছাড়া চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল খুলে দিয়েছে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আরেক দুয়ার। ঢাকাবাসীর নিত্য দুর্ভোগ যানজট থেকে অনেকটাই মুক্তি দিয়েছে মেট্রোরেল। রাজধানীতে এক্সপ্রেস এলিভেটেড ওয়ের মাধ্যমে উত্তরা থেকে ফার্মগেইট আসতে এখন সময় লাগে মাত্র পনেরো মিনিট। অথচ এই পথ আসতে যানজটের কারণে এখনো সড়কপথে আসতে সময় লাগে দুই ঘণ্টারও বেশি। এছাড়া দেশজুড়ে নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ ও পুরোনো সড়কগুলো প্রশস্তকরণের মধ্যদিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে ব্যাপক ও যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে তা এক কথায় অভাবনীয়।

শেখ হাসিনা সরকারের আরেক সাফল্য রেলওয়ে যোগাযোগের ব্যাপক উন্নতি সাধনের মধ্যে। পদ্মা সেতু হয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোকে রেলসেবার আওতায় আনা, কক্সবাজারের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন করে দেশজুড়ে যোগাযোগের নতুন দ্বার উম্মোচন হয়েছে। সারা দেশেই বিদ্যুৎ খাতের বিস্ময়কর উন্নয়ন হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের গত টানা তিন মেয়াদে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। স্থাপন করা হয়েছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এছাড়া নতুন সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণসহ বহু উন্নয়ন ঘটেছে গত ১৫ বছরে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে কটাক্ষ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন মার্কিন মদদপুষ্ট বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার সবচেয়ে বড়ো প্রকল্প পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে। স্বাধীনতার মাত্র ৫৩ বছরে এই পরিবর্তন হয়েছে বাংলাদেশের। পাকিস্তানের চেয়ে এখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। অনেক ক্ষেত্রে ভারত-চীনের থেকেও এগিয়ে। স্বাস্থ্য-শিক্ষার দিক দিয়ে ছাড়িয়ে গেছে ভারত-পাকিস্তানকে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জিডিপি ও মাথাপিছু জিডিপিতে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। গ্রস সেভিংস জিডিপিতে ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ শীর্ষে। শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় অনেক উচ্চতায় বাংলাদেশ। জন্মহার নিয়ন্ত্রণে প্রতিবেশীদের গড় আয়ুর ক্ষেত্রেও ভারত-পাকিস্তান দুই দেশের তুলনায় এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ।

কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে- দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বেড়েছে সাক্ষরতার হারও। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হারও হ্রাস পেয়েছে। এখন নির্বিঘ্নে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার মতো পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তবে সব রাজনৈতিক দলেরই দায় ও দায়িত্ব রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের মানুষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইতিবাচক সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা ঠিক যে, গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত ও সুসংহত করতে হলে বহুমতের রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচি যেন কোনোভাবেই অর্থনীতি ও জননিরাপত্তার জন্য প্রতিপক্ষ হয়ে না দাঁড়ায়, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সচেতন থাকতে হবে।

গত ১৫ বছরে দেশ আর্থসামাজিক উন্নয়নের এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। বেশকছিু দিন ধরেই উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে পেরেছে বাংলাদেশ। আজকের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ঐক্যটাই সবচেয়ে জরুরি। পারস্পরিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হরতাল, অবরোধ, মিছিল, ভাঙচুর ও জ¦ালাও-পোড়াও যদি না থাকে তাহলে উন্নয়নের ধারবাহিকতা রক্ষিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা মুখে যতই গণতন্ত্রের কথা বলি না কেন, আমাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব এখন পর্যন্ত রয়ে গেছে। অতীতেও এমনটি দেখা গেছে যে, যখনই একটু একটু করে স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়েছে বাংলাদেশ, প্রতিবারই হোঁচট খেয়েছে। কখনো কখনো রাজনীতি উন্নয়নের প্রতিপক্ষ হয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখনই জটিল হয়েছে, তখনই ত্বরান্বিত হয়েছে অর্থনীতির ক্ষতি। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে কখনো কখনো জঙ্গি তৎপরতার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। বেড়েছে সাধারণ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডও। নতুন সরকারকে এটা সর্বাত্মকভাবে দূর করতে হবে। তবে এই বিষয়টি স্বীকার করতেই হবে যেÑ সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এক সংকটকাল অতিক্রম করছে। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। সেই বাধা অতিক্রম করে নতুনভাবে পথচলা শুরু করতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেখা দেয় নতুন সংকট। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো মূল্যস্ফীতির ধাক্কা লাগে দেশের অর্থনীতিতেও। কেননা, এখন বর্তমানের এই বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিশ্বে যেকোনো এক জায়গার সংকট মানেই তা সকল জায়গায় একটা নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। মুক্তবাজার পণ্যসভ্যতার সবচেয়ে মূল বৈশিষ্ট্যই হলো যে- কোথাও জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোতেও তার একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

ইতোমধ্যেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের উন্নয়ন দেশ-বিদেশে বহু প্রশংসা কুড়িয়েছে। সেই সঙ্গে বিশ্ব দরবারে বাঙালি জাতিকে দিয়েছে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি। কৃষিতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা আওয়ামী লীগ সরকারের আরও একটি বড়ো সাফল্য। ভূমিহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বাড়ি বানিয়ে দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধা নিবাস নির্মাণ, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে তার আওতায় নিয়ে আসাসহ রয়েছে আরও নানামুখী জনবান্ধব কর্মকাণ্ড। তবে এত উন্নয়ন এবং জনবান্ধব কর্মকাণ্ডের পরও জন-আকাক্সক্ষা পূরণে একটা বড়ো ঘাটতি রয়েই গেছে। এখন সবার চাওয়া হলো নির্বাচনি ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর সফল বাস্তবায়ন। জোর দিতে হবে সুশাসনের ওপরও। কঠোর হস্তে দমন করতে হবে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, রাহাজানি আর মাদকের আগ্রাসন। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

২০১৪ ও ২০১৮ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছিল দেশকে দুর্নীতি ও মাদকমুক্ত করা হবে। ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছিলেন। তারপরও দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল হওয়া তো দূরের কথা, তার লাগাম পর্যন্ত টেনে ধরা যায়নি। সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি একটা ব্যাধির মতো রূপ ধারণ করেছে। এই দুর্নীতির লাগাম টেনে না ধরলে ভবিষ্যতে দেশকে চড়া মূল্য দিতে হবে। তাই এই মেয়াদে শেখ হাসিনার সরকারের কাছে মানুষের সবচেয়ে বড়ো প্রত্যাশা হচ্ছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

শেখ হাসিনার সরকারের টানা ১৫ বছরের মেয়াদে বাজার ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে খারাপ সময় গেছে গত প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময়। এই সময়ে মানুষ অভাবনীয় সংকটে পড়েছে নিত্যপণ্যের মূল্যের অস্বাভাবিক চড়া দামের কারণে। চাল, ডাল, ভোজ্যতেল থেকে শুরু করে শেষ বেলায় পেঁয়াজ, আলুর মতো পণ্যের দামও ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এতে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের অবস্থা ছিল নাজুক। এসব মানুষের একটাই বক্তব্য ছিল- দেশব্যাপী উন্নয়ন হোক দুর্বার গতিতে কিন্তু সবার আগে মানুষকে খেয়ে-পরে বাঁচতে দিতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাজারের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে হবে। কিন্তু মানুষের এই আর্তনাদ সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে না ঠিক মতো। এখন সবার একটাই চাওয়া নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করুন সবকিছুর আগে।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুনভাবে আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করেছে। সরকারের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জটাই সবচেয়ে বড়ো। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা, মানুষকে শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া, সুশাসন নিশ্চিত করা অন্যতম। তবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে স্বস্তি দেওয়াটা হচ্ছে সব চেয়ে বড়ো কাজ। আর বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে বাজারের কন্ট্রোল যাদের হাতে, সেসব সিন্ডিকেটের কোমর ভেঙে দিতে হবে। এতেই বাজার অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে সাধারণ মানুষ মনে করে। এ জন্য সরকার সংশ্লিষ্টদের সুনজরই যথেষ্ট। এই সিন্ডিকেট, দুর্নীতিবাজ, লুটেরাদের কঠোর হস্তে দমনের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার জনগণের পুরোনো প্রত্যাশা পূরণে সফল হবে। দেশের সাধারণ মানুষ এটাই প্রত্যাশা করে।

রেজাউল করিম হীরা: ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশের খবর

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :