বাংলা ভাষা: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

বাংলা ভাষা-আন্দোলনের বয়স ৭২ বছর হয়ে গেছে। ভাষা সৃষ্টির ইতিহাস ও সন্ধানেও এর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সাতশ পঞ্চাশ খ্রিষ্টাব্দে (মতভেদ আছে) যে ভাষাটির সন্ধান আমরা পেয়েছিলাম তার সফলতার, স্বীকৃতির ইতিহাস এতটা সহজ ছিল না। অনেক রক্ত আর জীবন ক্ষয়ের ভেতর দিয়ে গৌরবের এ ভাষা পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে; আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে উন্নীত হয়েছে। বাংলা ভাষার জন্যে এসব সংবাদ আর স্বীকৃতি আমাদের ভেতরে শিহরণ জাগায়, আনন্দিত করে, স্বপ্ন আনে মনে। একটি ভাষা একটি জাতির প্রধান পরিচায়ক। বাংলা ভাষার সঙ্গে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট পরিচয় বহন করে চলেছে। ভাষার নামের সঙ্গে মিলিয়েই তো আজকের বাঙালি জাতিসত্তার প্রধান পরিচয়। কিন্তু এই ভাষার সম্মান, মর্যাদা ও গৌরব আমরা কতটা রক্ষা করে চলতে পেরেছি। সরকারি তরফ থেকে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে? বাংলা ভাষাকে অফিসের ভাষা হিসেবে ব্যবহারের গান শুনে আসছি আমরা দীর্ঘকাল ধরে। সেই উদযোগ কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে? ইংরেজি ভাষার দাপট ও সর্বগ্রাসী ব্যবহার চারদিকে। তার ওপর রয়েছে হিন্দি ভাষার অবাধ প্রচলন এ দেশে তথা বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে। ইংরেজি ভাষার প্রভাব পৃথিবীব্যাপী। এর প্রভাবকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সুকৌশলে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কাল থেকেই কার্যত বাংলা ভাষার দাবি ও অধিকারের প্রসঙ্গগুলো উঠে এসেছিল। ইংরেজরা এই উপমহাদেশ থেকে বিদায় নিলেও তাদের রেখে যাওয়া বিষবৃক্ষের চারা আজ মহীরুহরূপ ধারণ করে বহমান রয়েছে। এটা ঠিক যে, ভাষা হলো মানুষে মানুষে ভাব বিনিময় ও কর্মপ্রণালী বাস্তবায়নের মাধ্যম। অন্য ভাষা শিখতে কোনো দোষ নেই, প্রয়োজনমাফিক তার ব্যবহার করতেও কোনো সমস্যা নেই; সমস্যা হলো তখনই যখন নিজের ভাষাকে, নিজের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে অন্যের ওপর নগ্ন ভরসায় নিজের সফল দ্বার উন্মোচন করে দেওয়া। বাংলাদেশের সর্বত্রই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। বাংলা ভাষার সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। ইংরেজি না শিখলে নাকি ভদ্রলোক হওয়া যায় না! যেকোনো ভাষাই শেখা যায়, সম্মান রাখা যায়, তাই বলে নিজের ভাষাকে অযত্নে রেখে সযতনে অন্য ভাষাকে লালন- রীতিমতো আত্মবিসর্জন দেওয়ার মতো। এখন চলছেও তাই। তার ওপর আছে হিন্দি ভাষার খড়গ। বাসাবাড়িতে, অফিসে, সর্বত্রই মিডিয়াগুলোতে হিন্দি চ্যানেলে ভরপুর, বাসাবাড়িতে অবস্থানরত মানুষগুলো বিশেষত বাচ্চারা প্রবল আসক্তি নিয়ে দেখে এসব চ্যানেল। নিদারুণ প্রভাবিত হয় এসব ভাষার আলিঙ্গনে। দেখার কেউ নেই, সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম-নীতির ব্যবস্থা নেই। কেন এমন হচ্ছে সে বিষয়েও আমাদের চিন্তা করতে হবে।
বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ রীতির ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থাটা কি সে বিষয়েও আমরা আমাদের দায়িত্ব ও অবহেলাকে একেবারে অস্বীকার করতে পারি না। সাহিত্যক্ষেত্রে, সিলোবাস প্রণয়নে, কারিকুলাম সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমরা বাংলা ভাষাকে কতটা যুগোপযোগী করতে পেরেছি, সেই ভাবনাটাও আমাদের ভাবতে হবে। ভাষা নিয়ে পৃথিবীতে, ভাষার আধুনিকায়নে বহু বিদগ্ধ পণ্ডিত-মনীষীরা কাজ করছেন; এক্ষেত্রে বাংলাদেশে এই উদযোগের পার্থসারথী কারা, তার তালিকা খুবই সংক্ষিপ্ত হবে বলেই অনুমান করি। কিন্তু একে অপরের সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই সম্প্রদায়ের গাত্রদাহের উদাহরণ ভূরিভূরি। রবীন্দ্র-পরবতী শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক, জীবনানন্দ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো সাহিত্যিক বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের বাংলা ভাষার সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বশীল সাহিত্যিক হয়ে উঠতে পারলেন না। ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আর যাহোক মহৎ কোনো সাহিত্য তৈরি হতে পারে না। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোও বাঙালি সমাজকে টানতে পারছে না। একঘেয়েমি যতসব বস্তাপচা ভাবনা নিয়ে অনুষ্ঠানগুলো সাজানো হয়। মনোমুগ্ধকর, আনন্দদায়ী, হৃদয়গ্রাহী ও গভীর ভাবনার দ্যোতক হয়ে উঠতে পারে না বলে এসব অনুষ্ঠান থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলা যায় বাধ্য হয়েই তারা অন্য ভাষার চ্যানেলগুলোতে আসক্ত হয়ে পড়ে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও চলছে বাংলা ভাষা-বিমুখতা। বাঙালিরা হিন্দিতে কথা বলে। তারা জাতে উঠতে চায়। হিন্দি ছাড়া নাকি তাদের চলাফেরায়, ব্যবহারে সমস্যা হয়। কি এক গভীর ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আটকে পড়েছে বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষা নিয়ে রয়েছে চর্চার অভাব। আগে পাড়া-মহল্লায়, ইউনিয়ন, থানা পর্যায়ে সাহিত্য আড্ডা হতো। এগুলো কমে এসেছে। সহায়তার, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে, আন্তরিক মানুষ থাকলেও তারা গাঁটের পয়সা খরচ করে এগুলো আর চালিয়ে নিতে পারছেন না। পাড়া-মহল্লায়, ইউনিয়ন পর্যায়ে লাইব্রেরি গড়ে তোলা দরকার। সেখানে মানুষ যাতায়াত করলে সমাজে খারাপ কাজের মাত্রা অনেক কমে আসবে। সাহিত্যিকদের প্রতি, ভাষা সৃষ্টিকারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও পৃষ্ঠপোষকতার মনোভাব না থাকলে বাংলা ভাষা বিনির্মাণে তারা আগ্রহ হারাবে এবং হারাচ্ছে। বাংলা ভাষাকে পৃথিবীতে গুরুত্বপূর্ণ করার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার বিখ্যাত গ্রন্থগুলোকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করতে হবে। বাংলা ভাষায় ভালো ভালো সিনেমা তৈরি করা প্রয়োজন। সিনেমা হলো ভাষা ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম মাধ্যম। বাংলাদেশে এই শিল্পটি বিনষ্ট হয়ে গেছে। আগে সপরিবারে সিনেমা হলগুলোতে সিনেমা দেখতে যেত মানুষ, সেই পরিবেশ নেই; সিনেমা হলগুলোও ধ্বংস হয়ে গেছে। সরকারের এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতিটি সাবজেক্টে অন্তত একটি বাংলা বিষয়ক কোর্স রাখার নির্দেশ প্রদান করেছিল। সেই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো কি এ বিষয়ে কোনো উদযোগ গ্রহণ করেছে? বিষয় হলো বাংলাকে মানি, বাংলা ভাষাকে জানি কিন্তু হৃদয়ে নিই না; মেনে নিই কিন্তু মনে নিই না- এই দ্বিচারিতা থেকে আমাদের বের হতে হবে। আমাদের ভালোবাসা, আমাদের গঠনমূলক চর্চা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও আন্তরিক শ্রদ্ধা ব্যতিরেকে বাংলা ভাষাকে সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ভালোবাসার ভেতর দিয়ে বাংলা ভাষা পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যাক এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

মন্তব্য করুন