কী পেল ‘কিংস’ পার্টিগুলো 

তাওহিদুল ইসলাম, ঢাকা টাইমস
 | প্রকাশিত : ০১ মার্চ ২০২৪, ১০:১৩

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে আলোচনায় ছিল তিনটি রাজনৈতিক দল। এগুলো হলো- বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও তৃণমূল বিএনপি। নির্বাচনে ‘সরকারের হয়ে’ অংশ নিয়ে ব্যাপক আলোচনায় থাকলেও দৃশ্যত কোনো অর্জন নেই দলগুলোর। আপাতত এ নির্বাচনে তারা দেশব্যাপী সহজেই পরিচিতি লাভেই ‘তৃপ্ত’ এবং এটিই বড় অর্জন হিসেবে দেখছেন দল তিনটির নেতারা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে অংশ নিয়ে এসব দলের প্রথম লাভ হলো নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন ও পরিচিতি পাওয়া। এছাড়া তারা যেহেতু এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে একটা আলোচনায় ছিল, একটা পরিচিতি পেয়েছে, এটা কাজে লাাগিয়ে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দলকে তৈরি করতে পারে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাসে আগে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়া দলগুলোকে ‘কিংস পার্টি’ বলে আখ্যায়িত করে নানা আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল রাজনীতির টেবিলে। জনমনে আলোচনা ছিল এমন- আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় তড়িগড়ি করে নতুন দলগুলোকে নিবন্ধন দিয়ে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে চেয়েছে সরকার। কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিত এই দলগুলো নির্বাচনে অনেকটা আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু শেষমেশ দেখা গেছে নির্বাচনে জয় তো দূরের কথা, বেশিরভাগ প্রার্থীই জামানত হারিয়েছেন।

নির্বাচনের আগে অর্থাৎ ২০২৩ সালের ১০ আগস্ট নিবন্ধন পায় বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম)। আর ২০১৫ সালে তৃণমূল বিএনপি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হলেও দলটি নিবন্ধন পায় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এই দলের প্রথম কাউন্সিলে (গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর) যোগ দেন বিএনপির দলছুট দুই নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকার। তাদের যোগদানকে কেন্দ্র করে আলোচনা আরও তুমুল ছিল। অন্তত তৃণমূল বিএনপির এই দুই নেতাকে সরকার দুটি আসন ছেড়ে দিবে এমনটা আভাস ছিল। ধারণাটিকে আরও পোক্ত করেছে তৈমুর আলমের ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও।

গত বছরের ৩০ নভেম্বরের আগে কোন আসনে নির্বাচন করবেন, তা নিয়ে তৈমুর আলম খন্দকারের কথোপকথনের একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেখানে তৈমুর আলমকে বলতে শুনা যায়, ‘৫-এ (নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন) কিনব না। প্রধানমন্ত্রীর সামনে যা বলার বলেছি। কথার পরিবর্তন করব না। ওনারা গাজীর (গোলাম দস্তগীর) কাছ থেকে বায়াসড (প্রভাবিত) হয়েছে। আমাদের দিয়ে যা খুশি করাবেন, তা হবে না।’

তবে ভোটের ফলাফলে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে ভোটে করে জামানত হারিয়েছেন তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার। তিনি প্রদত্ত ভোটের মাত্র দেড় শতাংশ পেয়েছেন।

এসব পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক আলোচনায় বড় প্রশ্ন- বিশেষ সুবিধা পেয়ে নির্বাচনের আগে নিবন্ধন পাওয়া এই দলগুলোর মূলত অর্জন কী।

বিএসপি, তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমের নেতারা নিজেদেরকে ‘কিংস পার্টি’ আখ্যায়িত করাকে অস্বীকার করেন। তারা মনে করেন, নির্বাচনে অংশ নিয়ে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। সারাদেশের মানুষ তাদের দল ও প্রতীক চিনেছে।

এ বিষয় জানতে চাইলে তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘নির্বাচনের পর আমরা সাংগঠনিক কাজে মনযোগ দিয়েছি। এক লাখ সদস্য ফরম ছাপিয়েছি। নতুন সদস্য করছি। সদস্য হওয়ার পর কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করব এবং আমরা তৃণমূল পর্যায় রাজনীতিটাকে নিয়ে যাব।’

বিএনপির বহিষ্কৃত এই নেতা বলেন, ‘তৃণমূল বিএনপি হবে বাংলাদেশের তৃণমূল কংগ্রেস। মানুষ এখন তৃতীয় দল দেখতে চায়। কারণ বড় দুটি দলই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা অন্যান্য দলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য করার চেষ্টা করছি।’

তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য আমরা মাত্র দুই মাস সময় পেয়েছি। বাংলাদেশে নিবন্ধিত ৪৪টা দল আছে। কিন্তু কয়টা দলের নাম মানুষ জানে? তৃণমূল বিএনপির নাম ও মার্কা সবাই জানে। নির্বাচনের মাধ্যমে এটা আমরা অর্জন করেছি।’

নির্বাচনের পর দল অনেকটাই নিস্ক্রিয় এবং নির্বাচনে অংশ নিয়ে কী অর্জন হয়েছে- জানতে চাইলে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির যুগ্ম সম্পাদক মো. ইব্রাহিম মিয়া ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম ভালোই চলছে। আমরা ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে জাতীয় প্রেসক্লাবে মাতৃভাষা দিবসের আলোচনা করেছি এবং ২৪ তারিখে চট্টগ্রামে আমাদের যুব মহাসমাবেশ ছিল। বিভিন্ন দাবিতে মাঠে আমরা সক্রিয় আছি।’

ইব্রাহিম মিয়া বলেন, ‘আমরা এখন দলকে সুসংগঠিত করতে কাজ করছি। জাতীয় কাউন্সিলকে লক্ষ্য করে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছি। পাশাপাশি বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথে থাকব।’

নির্বাচনে অংশ নিয়ে অর্জন সম্পর্কে সুপ্রিম পার্টির এই নেতা বলেন, ‘নির্বাচন তো হয়ে গেছে। আমরা যদি অংশগ্রহণ না করতাম তাহলে কী হতো? দেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার জন্য এবং অশুভ শক্তির উত্থান যাতে না ঘটে তার জন্য সুপ্রিম পার্টি নির্বাচনে গেছে। নির্বাচনে গিয়ে হারিনি, এর মাধ্যমে আমরা দেশকে বাঁচিয়েছি।’

কিংস পার্টি প্রসঙ্গে ইব্রাহিম মিয়া বলেন, ‘যারা আমাদেরকে কিংস পার্টি বলছেন, তারা আমাদের বিষয়গুলো না জেনেই বলছেন। তারা আমাদের সক্ষমতা সম্পর্কে জানেন না। ১৯৮১ সাল থেকে আমাদের প্রায় ১০ থেকে ১২টি সংগঠন চলছে। এরপর আমরা বৃহৎ পরিসরে রাজনীতির মাঠে এসেছি। আমাদের কিংস পার্টি বলার কোনো অবকাশ নেই।’

বিএনএমের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ও স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. আব্দুর রহমান খোকন ঢাকা টাইমসকে বলেন, দলের পক্ষ থেকে বিভাগীয় নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা জেলা, উপজেলা কমিটিগুলো করছেন। আমরা দেশব্যাপী সাংগঠনিক কার্যক্রম গুছাতে কাজ করছি।

আব্দুর রহমান খোকন বলেন, ‘আমরা সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করার পর ফিরব পুরো কার্যক্রমে। এখন একবিংশ শতাব্দিতে জ্বালাও পোড়াও হরতাল অবরোধের রাজনীতি অচল। বিরোধী দলের সবাইকেই গঠনমূলক রাজনীতি করা উচিত। যেমন, সরকারের এই কাজটা করলে ভালো হতো। সরকারের এই সিদ্ধান্ত জনগণের বিপক্ষে, এই সিদ্ধান্ত সরকারে বিবেচনার আহ্বান জানাই আমরা। আর সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করা। এসবই বিরোধী দলের দায়িত্ব।’

নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলের অর্জন কী- জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. আব্দুর রহমান খোকন বলেন, ‘দলের কোনো প্রার্থী জয়লাভ করেনি, এটা ঠিক। কিন্তু নতুন দল বিএনএমের নাম দেশের মানুষ জেনেছে। খারাপ হিসেবে হোক আর ভালো হিসেবে হোক দলের নামটা সর্বস্তরের মানুষের কাজে পৌঁছে গেছে। এটাই নির্বাচনে আমাদের অর্জন।’

দল তিনটির সার্বিক অর্জন নিয়ে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ঢাকা টাইমসকে বলেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় এসব দলের প্রথম অর্জন নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়েছ। দ্বিতীয়ত সংশ্লিষ্ট নেতাদের পরিচিতি বেড়েছে, সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে উঠেছে। এছাড়া পলিটিক্যাল ট্যুরিজম (রাজনৈতিক পর্যটন) হয়েছে। কারণ নির্বাচনের উদ্দেশ্যে দলগুলোর নেতারা নানা জায়গায় গেছেন।

নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘ওই অর্থে ঐতিহ্যটাও বহাল থেকেছে। এর আগে ওয়ান ইলেভেনের সময়ও কিংস পার্টি যেমন কলকে (স্বীকৃতি) পায়নি, তেমনি এরাও পায়নি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রাশেদা রওনক খান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এসব দল গঠন হয়েছে। এখন নির্বাচন শেষ। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে জনগণের কাছে যাওয়া, সেবা করা, জনগণের পক্ষে কথা বলা, সরকোরের কাছে জনগণের দাবি তুলে ধরা- এসবই গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের পক্ষ হয়ে আওয়াজ তোলা দরকার। এই কাজগুলো তারা করতে পারে কি না সেটা দেখার বিষয়। এটার ওপর নির্ভর করছে রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা কতটা নিজেদেরকে ভালো জায়গায় নিতে পারবে।’

ড. রওনক বলেন, ‘একটা বিশেষ সুবিধাকে মাথায় রেখে তারা নির্বাচনের আগে দল তৈরি করেছে। এখন নির্বাচন শেষে তারা চলে যাবে, সেটা হবে না। এটা নির্ভর করছে এখন তারা সামনে রাজনৈতিক দল হিসেবে কী ভূমিকা রাখবে সেটার ওপর।’

রাশেদা রওনক খান বলেন, ‘নির্বাচন হচ্ছে পলিটিক্যাল গেইম (রাজনৈতিক খেলা)। যেকোনো খেলাতেই হার-জিত থাকে। তারা এই খেলায় অংশগ্রহণ করেছে, কিন্তু জিততে পারেননি। তার মানে এই না যে তারা ভবিষ্যতে কিছু করতে পারবে না। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা ভালো কাজ। কিন্তু নির্বাচন থেকে সুফল বয়ে আনতে যে সময় দরকার ছিল অর্থাৎ একটা দল গঠন করার যে সিদ্ধান্ত তা যদি তারা আরও আগে নিত, তাহলে রাজনৈতিক মাঠে কিছুটা জায়গা তৈরি করতে পারত। এখন তারা যেহেতু এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে একটা আলোচনায় ছিল, একটা পরিচিতি পেয়ে গেছে, এটা কাজে লাাগিয়ে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য তৈরি হতে পারে। পরবর্তী নির্বাচনে আর তাদের একদম নতুন মুখ হতে হবে না। এটাই তাদের অর্জন।’

(ঢাকাটাইমস/০১মার্চ/টিআই/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজনীতি এর সর্বশেষ

সরকারের উৎপাদন করার চেয়ে আমদানি করার চাহিদা বেশি: নজরুল ইসলাম খান

‘ফারাক্কা দিবস’ যেকোনো অধিকার আদায়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে: মির্জা ফখরুল 

বাংলাদেশকে রক্ষা করতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোল‌নের বিকল্প নেই: দুদু

রিজার্ভ আর অবৈধ সরকারের পতন কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না: এবি পার্টি

ফারাক্কা দিবসের অঙ্গীকার- যৌথ নদী রক্ষায় সোচ্চার হোন: বাংলাদেশ ন্যাপ

অসুস্থ তাঁতীদল নেতা রেজাউল করিমকে দেখতে গেলেন কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ

শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে ছাত্রলীগের কর্মসূচি

জাপাকে বিক্রি করে নেতাকর্মীদের ক্রীতদাস বানানোর চেষ্টা হয়েছে: কাজী মামুন

আ.লীগই ষড়যন্ত্র করে: সালাম

দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের কিছুই অবশিষ্ট নেই: জামায়াত

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :