মিজারুল কায়েস: প্রয়াণ দিনে স্মৃতির শ্রদ্ধাঞ্জলি

আবদুল্লাহ আল মোহন
 | প্রকাশিত : ১০ মার্চ ২০২৪, ১০:৫১

প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব, ব্রাজিলে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ছিলেন মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরম স্বজন মিজারুল কায়েস ব্রাজিলের স্থানীয় সময় ২০১৭ সালের ১০ই মার্চ, শুক্রবার সকাল ৯টায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনন্তলোকে যাত্রা করেন। দেখতে দেখতে মিজারুল কায়েসের অজানালোক যাপনের কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল। হায় রে সময়, হায় রে জীবন! আপনজন চলে যান ছেড়ে কিন্তু সতত প্রবহমান ধারার মতো স্মৃতির নদীর ভাঙন-ঢেউ, প্রবল জলপ্রবাহ থেমে থাকে না। ক্ষণজন্মা বাঙালি মিজারুল কায়েস দশজনের একজন ছিলেন না, ছিলেন একাদশতম, ক্ষণজন্মা উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্ব। তিনি আর দশজনের মতো গড়-পড়তা মানের মানুষও ছিলেন না। তিনি সৎ মানুষ ছিলেন, সুদক্ষ দেশসেবক ছিলেন। তিনি প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তার পাণ্ডিত্য ও বিনয় শ্রদ্ধা জাগাত। হৃদয়বান মানুষ মিজারুল কায়েসের কাছে জীবনের মানেই ছিল আজন্ম মানুষের কল্যাণের জন্য নিরন্তর-নিরলস কাজ করে যাওয়া। তার সারল্য ছিল শিশুর মতো। তার অসম্ভব ‘শিশুসুলভ’ খাদ্যপ্রীতি অস্বাস্থ্যকর জেনেও কেন যে প্রতিনিয়ত জোগান দিতাম, প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে আজো তা ভেবে ভেবে অপরাধে ভুগি। উল্লেখ্য যে,‘যুগল আঁখি সুর্য-চাঁদে’ পাওয়া নন্দন গুরু মিজারুল কায়েসকে জন্মদিনে ও প্রয়াণদিনে নিয়মিতভাবে আমাদের আনন্দময় সহশিক্ষার সৃজনশীল আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’-এ বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করে থাকি। ‘মঙ্গল আসর’-এর পক্ষ থেকে বনানী কবরস্থানে গিয়ে তাঁর সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণও করা হয়। আমার প্রকাশিতব্য ভ্রমণগদ্য গ্রন্থ ‘মালদ্বীপের মোহন মায়ায়’ উৎসর্গ করেছি এই পরম স্বজনকে। তিনি এক সময় মালদ্বীপে আমাদের হাইকমিশনার ছিলেন।

অনন্য ও অসাধারণ এবং অবশ্যই আলোকিত মহৎপ্রাণ মানুষ ছিলেন কায়েস ভাই। আমাদের প্রাণের অঙ্গন, দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতিধর্মী প্রতিষ্ঠান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্ম ও গঠন যুগের সক্রিয় কর্মী, সংগঠক ছিলেন কায়েস ভাই। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আজকের এই বেড়ে ওঠা, গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠাতা সায়ীদ স্যারের সাথে যে কয়েকজন মানুষের অবদান অনস্বীকার্য, তাদেরই একজন তিনি। সবশেষে তিনি কেন্দ্রের ট্রাস্টি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কলেজ কর্মসূচিতে ১৯৮৯ সালে অংশ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সাথে সংশ্লিষ্টতা বাড়ে, তখনই কায়েস ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় ও পরে গভীর ঘনিষ্ঠতার সৃষ্টি হয়। সেই যে তিনি আমাকে ছোটো ভাইয়ের স্নেহাশিষে স্বজন করে নিলেন, সেই অকৃত্রিম ভালোবাসার নিত্য রসধারা আমৃত্যু প্রবহমান ছিল। তার মহাপ্রয়াণ দিবসের প্রাক্কালে লিখতে বসে ভাবছি আর ভাবছি, কলম থেমে আছে, কীবোর্ডও অচল, স্তব্ধ। ২০১৭ সালের এই দিনে তিনি আমাদের ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন বড্ড অকালে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে। তবে রেখে গেছেন গৌরবের অনেক কাজ, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের নানা সাফল্য যা দেশের স্বার্থকে সমৃদ্ধ করেছে, একই সঙ্গে কাজের ধারার সুউচ্চ মানও। সংগত কারণেই তিনি কেবল স্মৃতিতে নয়; প্রতিনিয়ত বিরাজ করেন আমার, আমাদের অনেকের প্রেরণার উৎস ও পথপ্রদর্শক হিসেবে। তার প্রিয় নজরুলের বাণীতে বলি, ‘অনুরাগের রাঙা জবা থাক না মোর মনের বনে’। সাধারণ অর্থে জনপ্রিয়তা বলতে যা বোঝায় কায়েস ভাইয়ের ক্ষেত্রে ততটা দেখি না বটে তবে তার চরিত্র ছিল ভিন্ন, একান্তই স্বকীয়। তিনি ছিলেন সৎ, সজ্জন ও পরিচ্ছন্ন রুচির মানুষ। প্রাণে ফূর্তি’র সদা ঢেউ বওয়া এই মানুষটির সঙ্গে সামান্য আলাপেই বোঝা যেত তিনি সরল, আন্তরিক, মানবিক উদারতায় মণ্ডিত একজন অসম্ভব ভালো মানুষ, মনে রাখবার মতো স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাকে নিয়ে আরো বড়ো একটা লেখা আগেও লিখেছি বলে পুনরোক্তি এড়াতে সেসব বিষয় উল্লেখ থেকে দূরে থাকছি।

কায়েস ভাই জগতের স্বাভাবিক নিয়মে চলে গেছেন, কিন্তু উদ্যোগী চেতনাবান ব্যক্তি হিসেবে রেখে গেছেন একটি গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য থেকে সমগ্র দেশ, জাতিও নতুন প্রজন্মের গভীর শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ আছে। অনুপ্রাণিত হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, আমরা তার মতোন এ রকম ক্ষণজন্মা দুর্লভ মানুষদের মেধা, অভিজ্ঞতা ও চেতনাকে সামগ্রিক জাতি গঠন-প্রক্রিয়ায় কার্যকরভাবে প্রায়ই যুক্ত করতে পারিনি। তিনি দারুণ সফল পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন, ছিলেন সুযোগ্য রাষ্ট্রদূত। সরকার ও রাজনীতির শিক্ষার্থী হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পাঠ নিতে ও দিতে গিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি আলোচনা-সমালোচনার অনুসন্ধিৎসায় নজর দিতে হয়, পাঠ দিতে হয় শিক্ষক হিসেবেও। ফলে একাডেমিকভাবে পররাষ্ট্র সচিব কায়েস ভাইয়ের কর্মকালের মূল্যায়ন করার সুযোগে অন্য এক কর্মবীরের সন্ধান পাই। ফিরে ফিরে দেখি তার সাফল্যের সূত্রাবলি। মেধাবী কূটনীতিক হিসেবে কতটা কাজে লাগাতে পেরেছিলেন সেটাও ভাবনার বিষয় হয়ে ওঠে। কায়েস ভাই জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬০ সালের ২রা এপ্রিল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পিতার চাকুরির সুবাদে পাকিস্তানে আটকা পড়েন। ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরে তার পিতার পোস্টিং হয় টাঙ্গাইলে। সেখানকার বিবেকানন্দ মিশন বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। কায়েস ভাই ১৯৭৫ সালে ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৭৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েও মায়ের একান্ত ইচ্ছা অনুযায়ী চিকিৎসক হওয়ার মানসে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। সেখানেও তিনি কোর্স শেষ করেননি, রসিকতা করে বলতেন, ‘আমি সেখানকার সারাজীবনেরই ছাত্র’। কায়েস ভাই প্রায় আকস্মিক সিদ্ধান্তেই ডিগ্রি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অল্প সময়ের প্রস্তুতিতে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে মেধা তালিকায় স্থান লাভ করেন। অসম্ভব মাতৃভক্ত কায়েস ভাই ডিগ্রি পাস করেই মায়ের ইচ্ছা পূরণে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সম্মিলিত মেধা তালিকায় তৃতীয় হন। তার একটিমাত্রই পছন্দ ছিল- পররাষ্ট্র ক্যাডার। এভাবেই তৈরি হয়, প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে তার পেশাগত সাফল্যের সিঁড়ি ধরে সর্বোচ্চস্থানে পৌঁছান।

শিল্প-সাহিত্যের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ মানুষ ছিলেন। শিল্পের ভুবনের প্রিয়জন ছিলেন। শিল্পের যেকোনো ক্ষেত্রে গভীর প্রত্যয়ী জ্ঞান ছিল। তার লেখাপড়ার ব্যাপ্তি বিস্মিত করত। বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে অক্লান্ত সেনানী ছিলেন। আমার কাছে মনে হয়েছে তার মানবিক সত্তার সঙ্গে একটা আধুনিক সত্তাও ছিল, যে আধুনিক চেতনাটা বিভিন্ন সময় তাকে বিভিন্ন নাগরিক দায়িত্ব পালনের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত করেছিল। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচিসহ চলচ্চিত্র উৎসব, আন্দোলন, সংগীতের আসর আয়োজনে, চারু ও কারুকলার বিকাশে-প্রকাশের মতো নানা রকমের, মাত্রার কাজে তার অসীম উৎসাহ আমি দেখেছি, পাশে থাকার সুযোগ হয়েছে। তার ঘর এবং কর্মক্ষেত্রে আমার জন্য দ্বার অবারিত থাকার সুযোগ-স্নেহাশিষের কারণে কর্মবীর কায়েস ভাইকে আমি ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দেখার বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম বলেই বলতে পারছি এই কথাগুলো। শিক্ষকতার প্রতি তার সবিশেষ টান ছিল। পেশাগত জীবন শেষে তিনি শিক্ষকতায় ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। তিনি নানা সময়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে পাঠদানও করেছেন। তার প্রিয় বিষয় শিল্পকলা- নন্দনতত্বের উপরও পাঠদান করেছেন শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।

আমার স্বজন, পরমাত্মীয় কায়েস ভাইকে আমি ভুলতে পারি না, ভুলে থাকা অসম্ভব আমার জন্য। নানা অকাজের কাজে ছড়িয়ে গিয়ে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলাম আমরা পরস্পরের সাথে। আমাদের ভালোবাসার গভীরতা, প্রীতিরেখা সীমার মাঝে আটকানো সম্ভব নয়। যারা তার ভালোবাসার, স্নেহাশিষের অমেয় ধারায় স্নাতক হয়েছে তারা খুব ভালো করে জানেন তিনি আমাদের আনন্দের, আশাবাদের অনন্ত উৎসমুখ ছিলেন। ভালোবাসার আলোয় অন্যের বেদনার অন্ধকারকে দূর করতে জানতেন। কূটনৈতিক কলাকৌশল কিংবা শিষ্টাচারের বাইরে তিনি ভালো করে জানতেন কীভাবে সম্পর্কের সম্প্রীতির দ্বারা বেদনাকে দূরীভূত করা যায়। তিনি তথাকথিত কূটনৈতিক চালে আপনজনের দুঃসময়ে তাদের এড়িয়ে গেছেন এমনটি কখনো আমি হতে দেখিনি। তিনি অনেকটা ঝাঁপিয়েই পড়েছেন। আমার জীবনে যেমন ঘটেছে, তেমনি অন্যদের জীবনেও ঘটতে দেখেছি অসংখ্যবার। তিনি দেশে থাকলে আমি প্রায় নিয়মিতভাবে ছুটির দিনগুলোকে, বিশেষত শুক্র ও শনিবার তার অফিসে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের কক্ষে কাটাতাম। ফলে ১৯৮৯ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যোগদানের মাধ্যমে তার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম, সেই সম্পর্কের জাল আমৃত্যু অবিচ্ছিন্ন ছিল, প্রয়াণে ছিন্ন হয়নি একটু। তিনি জড়িয়ে আছেন প্রীতির স্মৃতি নিয়ে।

তার সাথে আমার যৎসামান্য কাজের ‘অবৈষয়িক’ সম্পর্ক ছিল। নানা বিষয়ে তার কাক্সিক্ষত তথ্য-উপাত্তসমূহ খুঁজে সরবরাহ করতাম। তাছাড়াও তিনি একেকদিন কোনো একটি বিষয় নিয়ে বলতেন, আর আমি সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় নোট নিতাম,এ ভাবে নোট নিয়ে তার জন্য লেখা তৈরি করতাম, তাকে দিতাম। এমনতর একান্ত আসরে বক্তব্যদানকালে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যেতে তার সময় লাগত না। এতটাই নিবিড় ও গভীর পাঠ ছিল তার বিভিন্ন বিষয়ে। ফলে তার সাথে কাজের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সময় যাপনের সুযোগ, আনন্দঘন সৎসঙ্গ আমার জন্য সবসময়ের জন্য কাক্সিক্ষত ছিল। পঞ্চকবিসহ নজরুলের শ্যামসংগীতের অসম্ভব ভক্ত ছিলেন কায়েস ভাই। আমার হিমু রঙের হলুদ পাঞ্জাবি-পরা দেখলে গেয়ে উঠতেন, ‘তরুণ ও বিবাগী, সাজিয়াছ যোগী, বলো কার লাগি?’ কিংবা, ‘সুখের গৃহ শ্মশান করি, বেড়াস মা তুই আগুন জ্বালি, আমায় দুঃখ দেওয়ার ছলে তোর ভুবন ভরা রূপ দেখালি’ গাওয়ার সেই সাধুসঙ্গ ভুলি কী করে? আমার আজন্মের স্বভাবে ভুল ও বিকৃত সুরে উচ্চারণ করতাম, ‘ওমা তোর ভুবনে জ্বলে এত আলো, আমি কেন অন্ধ হয়ে দেখি শুধুই কালো।’ তিনি শুদ্ধস্বরে জবাব দিতেন, ‘তোর (তার) চোখের মাঝে পড়ে আছি চোখের বালি হয়ে’। আহারে আমাদের সুরাসক্ত সেই অলৌকিক জীবনানন্দময় দিনগুলিকে চাপাকান্নায় স্মরণ করি কেবল। মোবাইলে কল করে না পেলে এসএমএস পাঠাতাম, ‘কায়েস ভাই, আপনি কই?’ প্রতিউত্তর পেতাম অনেকটা এরকম, ‘আমি কাঁটাযুক্ত মাছই বটে, অদ্ভুত গল্প ভুতেরাই রটে, থাকবে না কারো মাথা, যদি মৎস লোভে ভুতটি চটে।’ আমাকে নিয়ে ছড়া লেখার কাহিনি আগেও লিখেছি বলে এখানে আর উল্লেখ করছি না। শব্দ নিয়ে খেলা করতে দারুণ পারঙ্গম এই সুরসিক মানুষটি আর আমাদের সাথে নেই, ভাবতেই পারছি না, মেনে নিতে পারি না আজো। কথা প্রসঙ্গে আমি নিজেকে যমুনাপুত্র বলে পরিচয় দিলে তিনি জবাবে বলতেন- শব্দই ব্রহ্ম বটে হে, তবে আমি ব্রহ্মা নই,আমিও কিন্তু ব্রহ্মপুত্র।

তার আলো, তার ছায়ায় আজও পথ চলি, শিক্ষকতার আনন্দে সজীব থাকি। তিনি নোবেলজয়ী বাঙালি অধ্যাপক ড. অমর্ত্য সেনের সরাসরি ছাত্র ছিলেন, তাঁর কাছ থেকে মানবকল্যাণ নিয়ে কেবল পাঠই নেননি, জীবনাচরণেও প্রয়োগ করেছেন আমৃত্যু। আমেরিকায় সরকার ও রাজনীতির উপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। ফলে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সুষম সমন্বয় ঘটেছিল তার জীবনে, কাজের ক্ষেত্রেও। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো- পররাষ্ট্র সচিবের মতো অতি সংবেদনশীল গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করলেও তিনি তথাকথিত আমলা হয়ে ওঠেননি। তিনি ‘পদাধিকার বলে সর্বজ্ঞ’ হিসেবে নয়, সুশাসনের প্রাথমিক শর্ত ‘সকলের মাঝে প্রথম’ বোধ জারিত মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে সবার সঙ্গে আচরণ করেছেন। স্নেহপ্রবণ দৃষ্টিতে দেখেছেন কর্মচারী-কর্মকর্তাদের, প্রয়োজনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেননি। আমার মনে হয়েছে, বলেছিও তাকে যে আপনি শিক্ষকের মানসিকতায় দেখছেন, পরিচালনা করেছেন প্রশাসনকে। অন্য সচিবদের সঙ্গে এখানেই ছিল তার বিশেষ পার্থক্য। প্রশাসনিক আচরণের সঙ্গে তার মানবিক বোধের কোনো বিরোধ ছিল না। প্রশাসনের জটিলতা-কুটিলতার ঊর্ধ্বে, ক্ষুদ্রতা সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তিনি ছিলেন একজন যুক্তিপূর্ণ মানুষ।

তার কাজের ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। দক্ষতার সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালনায় কোনো চাপ তিনি অনুভব করছেন বলে মনে হতো না। রাষ্ট্র ও সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের সাথে কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের অতিথি ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে অথবা অন্যান্য অফিসের কর্তাব্যক্তিদের সাথে প্রয়োজনীয় আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তার সাবলীল ও স্থিতধী আচরণ আমাকে বিস্মিত করেছে। দ্বিপাক্ষিক কিংবা আমলাতান্ত্রিক পরিবেশেও স্বাভাবিক আচরণ ও সুষ্পষ্ট উচ্চারণে মেরুদণ্ড সোজা করে কথা বলার শিল্পকলা, নন্দনতত্ত্ব তার করায়ত্তে ছিল বলেই আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি। আবার তার রহস্যময় দুষ্টুমির হাত থেকে, সরস বাক্যবাণ থেকে কাউকে মুক্তি পেতে দেখিনি। সেই তাকেই অফিসে খাবার কিংবা বিশ্রামের সময়েও দেখেছি কাজ নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলছেন। সবার খোঁজ নিতেন। আসলে তার অবসর সময় বলে কিছু ছিল বলে আমার মনে হয়নি কখনো।

একজন দায়িত্ববান পিতা হিসেবে তাকে দেখেছি সুযোগ পেলেই বাসায় ফোন করে তিনি তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় মেয়ে, মাধুরী ও মানসী খেয়েছে কি-না, সেটা জানতে চাইতেন। কাজের পাশাপাশি পরিবারকে সময় দেওয়াটা তার কাছে কেবল দায়িত্ব পালন নয়, ছিল উপভোগেরও বিষয়। প্রায়ই দেখেছি বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে কন্যাদের জন্য চাহিদামাফিক উপাদেয় খাবার ও অন্যান্য আব্দার সংগ্রহ করে নিতে ভুলতেন না। আর মেয়েদের জন্য খাবার কেনার অর্ডার দান ও প্রস্তুতির মাঝের সময়ে চলতো আমাদের পছন্দের খাবার সাবার করার পালা। সেই ব অসাধারণ বিনোদন বিহারকাল বিরহী মনে স্মরণ না পড়ে উপায় আছে?

কায়েস ভাই অসম্ভব কৌতুকপ্রিয় মানুষ ছিলেন। প্রচণ্ড উল্লাসময় জীবনযাপন করেছেন। যেখানে হাজির হতেন, সেখানকার পরিবেশকে উজ্জ্বল করে তুলতেন। কিন্তু তিনি কারো জন্য কখনো বিরক্তিকর হয়ে ওঠেননি। তার রসবোধ ছিল প্রখর। একই সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত ও ক্যারিশম্যাটিক। চারপাশের সবাইকে তিনি হাসি-আনন্দে ভরিয়ে রাখতে পারতেন। তার সাথে থাকা মানে জ্ঞান আহরণ করার সুযোগ লাভ। তিনি সেবামূলক কাজকে গুরুত্ব দিতেন। শিক্ষার প্রসার ও মান বাড়ানোর প্রতি ছিল তার বিশেষ আগ্রহ। তিনি নিজে জ্ঞান অর্জনকে প্রাধান্য নিতেন। আমরা প্রতিদিন এটা উপলব্ধি করতাম। তিনি বলতেন, শৈশব থেকেই জেনেছি, পড়াশোনার স্থান সবকিছুর ওপরে। জ্ঞান হচ্ছে শক্তি। এটা অর্জন করতে হয়। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে- জানার কোনো শেষ নেই। যতই পড়বে, ততই জানবে- এ বিশ্বাস ছিল একেবারে মজ্জাগত। এটা নিজের ক্ষেত্রে অনুসরণ করতেন, অন্যদের মধ্যেও তা ছড়িয়ে দিতে চাইতেন। শিক্ষার প্রসারে সহায়তা করতে তিনি আমার তৎকালীন কর্মস্থল সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য সহযোগিতা দিয়েছেন।

সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রের বিকাশে তিনি সহযোগিতা করেছেন বুদ্ধি দিয়ে, বই দিয়ে। আমার প্রতিটি ছাত্রের বাড়িতে ও পাড়ায় পাঠাগার গড়ে তোলার স্বপ্ন প্রকল্প নিয়ে কাজের ব্যস্তবতার নানা সম্ভাবনা ও সংকট নিয়ে আলোচনা করতাম। আমার ‘আলোকিত মানুষ চাই, করি দৃঢ় অঙ্গীকার, গড়ি পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার’ স্মরণ বাণীর ‘নিস্ফল’ প্রচেষ্টাকে তিনি ভীষণ পছন্দ করেছিলেন বলেই সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছিলেন শুরু থেকেই। আমার আমন্ত্রণে তিনি বেশ কয়েকবার তার শৈশবের স্মৃতিতাড়িত শহর মানিকগঞ্জও গেছেন। মানিকগঞ্জের নদীকেন্দ্রিক এলাকার দরিদ্র ছাত্রদের জন্য বিশেষত জেলে পেশার সাথে সরাসরি জড়িত ছাত্র-ছেলেদের জন্য নৌকায় পাঠাগার গড়ে তোলার ব্যর্থ প্রচেষ্টাকালে তিনি আমাকে বলেছিলেন, শিক্ষক হবেন নদীর মতো, যেমন নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল মানবসভ্যতা। একজন শিক্ষককে তার কাছে নদীর মতোই মনে হতো। তিনি মনে করতেন শিক্ষকের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে সভ্যতা, সংস্কৃতির ঊর্বরা পলিমাটি। সুশিক্ষার মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় মানবিক সংস্কৃতির, যার মূল ভিত্তি গড়েন শিক্ষক। মানবজীবনে সনদমুখী শিক্ষার চেয়ে সৎ আদর্শিক সংস্কৃতিকে তিনি অনেক সময়ই বেশি জরুরি বিবেচনা করতেন বলে জেনেছি। শিক্ষার্থীদের জীবনে মানবিক মূল্যবোধ গড়ার প্রতি জোর দিতে উৎসাহ জোগাতেন। কত কথাই না হতো আমাদের। পাঠাগার সংষ্কৃতি জাগাতে, বই পাঠের অভ্যাস বাড়াতে নানা সমস্যাজনিত দুঃখ ও বিষাদের আমার অভিজ্ঞতাকে তিনি সমাধানে সচেষ্ট ছিলেন সবসময়। মানিকগঞ্জের তেউতায় যমুনার তীরে ‘প্রমীলা নজরুল নন্দন বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার, গড়ে তোলার আজন্মের স্বপ্ন ছিল আমার। সেই আশাবাদী চেষ্টাকালে নানা বিঘ্নতা নিয়েও আলোচনা করতাম। সেসব স্মৃতিও আজ মন যমুনায় ভীড় করছে, মনের মহাসুমুদ্রে ঢেউ তুলছে।

কেউ কেউ এমনই হন- যারা পর্যাপ্ত আলো বিকীরণ করেন এবং তাদের ছায়ায় দাঁড়াতে পারলে ধন্য হয় অন্যরা। তেমনই একজন স্মরণীয় মানুষ ছিলেন মিজারুল কায়েস। শান্ত, সৌম্য, স্নিগ্ধ কোনো মানুষের মুখের কথা মনে করতে হলে মনে পড়ে মিজারুল কায়েসের মুখচ্ছবি। তিনি বড়ো মানুষ ছিলেন। বড়ো ছিলেন প্রজ্ঞায় ও সংস্কৃতিবান মানুষ হিসেবে। প্রকৃত শিক্ষিত ও পরিশীলিত অনন্য মানুষ ছিলেন তিনি। এমন বড়ো মনের মানুষ খুব-একটা দেখা যায় না। তাই তাকে স্মরণ করা মানে আমাদের মূল্যবোধ জাগ্রত হওয়া, নিজেদের মধ্যে আস্থাকে পুনরায় উচ্চারণ করা। তাঁর প্রয়াণ দিনে আবারো প্রিয় মানুষ, ‘জীবন শিক্ষক’ মিজারুল কায়েস ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আবদুল্লাহ আল মোহন: লেখক. গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :