ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-১১

মুসা-ইউনুস আ. এর আলোচিত তিন ঘটনার শিক্ষা ও অন্যান্য

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
| আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৪, ২০:২৭ | প্রকাশিত : ২১ মার্চ ২০২৪, ২০:০৮

প্রিয় পাঠক,

আজ আমরা কোরআনুল কারীমের ১১তম পারা থেকে ধারাবাহিকভাবে জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। দশম পারার শেষে মুমিনদের আলোচনার পাশাপাশি ওইসব মুনাফিকের আলোচনাও করা হয়েছে, যারা বাহন-জন্তু, অর্থ-সম্পদ ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাবুকযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি।

আগের পর্ব: বদর যুদ্ধে সফলতার রহস্য

এগারো পারার শুরুতেও মুনাফিকদের আলোচনা করা হয়েছে। তাবুকবৃদ্ধ থেকে ফেরার প্রাক্কালে আল্লাহ তায়ালা— রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানিয়ে দেন যে, ‘যখন আপনি মদিনায় পৌঁছবেন তখন মুনাফিকরা আপনার নিকট এসে কসম খেয়ে বিভিন্ন ওজরখাহি করবে, আমরা একান্ত অপারগ হয়ে আপনার সাথে যুদ্ধে শরিক হতে পারিনি। অন্যথায় আমরা তো যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প করেছিলাম।’ আর বাস্তবে এমনই হয়েছিল। মুনাফিকরা কসম করে রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের কথার সত্যতা উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করেছিল। বাস্তবতা জানা সত্ত্বেও উত্তম চরিত্র-গুণে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিশ্চুপ ছিলেন। তাদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করেননি।

আল্লাহ তায়ালা এরপর মুনাফিকদের পরিবর্তে মুসলমানদের কিছু গুণ উল্লেখ করেছেন, ‘যারা ভুলের স্বীকারোক্তি করেছে, মিথ্যা বলে ভুলকে সঠিক প্রমাণের চেষ্টা করেনি, আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রশংসা করেছেন।’

এরপর পুনরায় মুনাফিকদের আলোচনা করা হয়েছে। যারা ইসলামের ক্ষতিসাধন, কুফরের শক্তি যোগানো এবং মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য মসজিদে জিরার নির্মাণ করেছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তারা সে মসজিদ উদ্বোধনের জন্য আবেদন জানায়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা নবীকে সে মসজিদে নামাজ আদায় করতে নিষেধ করে দেন। এরপর আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে মসজিদ নামের সেই ঘাঁটিটি জ্বালিয়ে ছাই বানিয়ে দেওয়া হয়।

মসজিদে জিরারের পরিপ্রেক্ষিতে মসজিদে কুবা; আর নিফাকের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মুমিনদের আলোচনা করা হয়েছে, জান্নাত অর্জনের জন্য যারা আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের জানমাল সবকিছু কোরবান করে দিয়েছিলেন।

মুমিনদের নয়টি গুণ

মুমিনদের নয়টি গুণ উল্লেখ করা হয়েছে, প্রত্যেক মুমিনের মধ্যে যা থাকা উচিত। গুণসমূহ হচ্ছে;

১. তারা তাওবাকারী, ২. ইবাদতগুজার, ৩. প্রশংসাকারী, ৪. রোজাদার, ৫. রুকুকারী, ৬. সিজদাকারী, ৭. ভালো কাজের নির্দেশদাতা, ৮. অসৎকাজ থেকে বারণকারী এবং ৯. আল্লাহর সীমারেখা সংরক্ষণকারী। (১১২)

যে তিনজন তাবুকযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি

তাবুকযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করতে পারেনি, তাদের মধ্যে তিনজন মুসলমানের ঈমান ও ইখলাসের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল না। তারা হলেন। ১. হযরত কা’ব বিন মালেক, ২. হজরত হেলাল বিন উমাইয়া, ৩. হজরত মুবারা বিন রাবি রাদিয়াল্লাহু আনহুম।

এই তিনজন কোনো ধরনের ওজর পেশ করেননি। বরং পরিষ্কার ভাষায় স্বীকার করেছেন যে, অলসতা ও ভুলবশত তারা পেছনে রয়ে গিয়েছিলেন। তাদের বিষয়টি ভিন্নভাবে দেখা হয়। পঞ্চাশ দিন পর্যন্ত তাদেরকে বয়কট করা হয়। সত্য বলায় ওহীর মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে তাদের তাওবা কবুল করা হয়। এ ঘোষণা তাদের জন্য এতটাই সুসংবাদের কারণ ছিল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে কা’ব বিন মালিককে বলেন, ‘তোমার মা জন্ম দেওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এ দিনের চেয়ে উত্তম কোনো দিন তোমার জন্য অতিবাহিত হয়নি।’

১১৭-১১৮ নং আয়াতে তাদের তাওবা কবুল করার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। সামনের আয়াতে মুমিনদের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেনে চলার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে:

১. তারা প্রকাশ্যে ও গোপনে তাকওয়া অবলম্বন করবে। ২. মুনাফিকদের থেকে তারা দূরে থাকবে। সত্যবাদীদের সাহচর্য গ্রহণ করবে। ৩. রিজিকের প্রশস্ততা ও সংকীর্ণতার ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দেবে। ৪. বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ওয়াদা। বলা হয়েছে, ‘সকল ইবাদতের সাওয়াব আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে পাওয়া যাবে। এই দীনের জন্য যে পরিমাণ কষ্ট করা হবে, ততই সাওয়াব অর্জিত হবে।’ (১২০-১২১)

দীন শেখার জন্য কিছু লোক থাকা উচিত

জিহাদের ফজিলত ও গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সমস্ত মুসলমান যেন জিহাদে বের হয়ে না যায়; বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে কিছু লোকের থাকা উচিত, যারা তার থেকে দীন শিক্ষা করবে। (১২২)

ইসলামের সূচনালগ্নে শত্রুর শক্তি খর্ব করার জন্য যেমন জিহাদের প্রয়োজন ছিল তেমনিভাবে ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত রচনা করার জন্য কিছু মূলনীতির প্রয়োজন ছিল। এ লক্ষ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ধারাবাহিকভাবে বিধান অবতীর্ণ হতে থাকে।

সর্বদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কিছু লোক তৈরি করার এষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে যারা শিক্ষক, মুরুব্বি, নির্দেশক, বিচারক, শাসক ও ব্যবস্থাপক হতে পারবে। এ কারণে কিছুসংখ্যক মুসলমানকে থেকে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা দীন শিখতে পারে। ইসলামি রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোনিবেশ করার পরিবর্তে শুধু ইলম শিক্ষা করাও অনেক বড় কাজ। এ কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দীনের গভীর জ্ঞান দান করে থাকেন।’ তিনি এও বলেছেন যে, ‘শয়তানের নিকট একজন ফকিহ এক হাজার আবেদের চেয়েও ভারী।’

জিহাদের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি

জিহাদের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি বলা হয়েছে, আকরাব ফাল আকরাব-এর ভিত্তিতে জিহাদ করা হবে। অর্থাৎ নিকটবর্তী কাফেরদের সাথে প্রথমে জিহাদ করা হবে এরপর ধীরে ধীরে এর পরিধি বৃদ্ধি পাবে। (১২৩)

সূরা তাওবার শেষআয়াতে দ্বিতীয়বার মুনাফিকদের নিন্দা করা হয়। এই দুর্ভাগারা কোরআন থেকেও কোনো উপকার হাসিল করতে পারে না; বরং কোরআনের মাধ্যমে তাদের নোংরা চিন্তাধারার আরও বৃদ্ধি ঘটে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসা

শেষআয়াতে আল্লাহ তায়ালা আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসা করেছেন। তিনি তার জন্য আসমাউল হুসনা থেকে দুটি নাম নির্বাচন করেছেন। তা হচ্ছে রউফ এবং রহিম। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় উম্মত; বরং গোটা মানবজাতির প্রতি অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন। হুসাইন বিন ফজল রহ. বলেন, আল্লাহ তায়ালা একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যই নিজের নাম-দুটো নির্বাচন করেছেন। অন্য কারও জন্য একত্রে তা ব্যবহার করেননি।

সুরা ইউনুস

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ১০৯। রুকূ সংখ্যা: ১১

এ সূরায় ঈমানের মৌলিক বিষয় আকিদা-বিশ্বাস এবং বিশেষ করে কোরআনুল কারিমের আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলোচনার মাধ্যমে সূরাটি শুরু হয়েছে। বলা হয়েছে, খাতামুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত মুরসালিত আশ্চর্য কিছু নয়। কেননা তাকেই প্রথম নবী হিসেবে পাঠানো হয়নি; প্রত্যেক জাতিতে কোনো-না-কোনো নবী-রাসুল এসেছেন।

রুবুবিয়্যাত, উলুহিয়্যাত ও উবুদিয়্যাত

এরপর রুবুবিয়্যাত, উলুহিয়্যাত ও উবুদিয়্যাতের বাস্তবতা এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যকার সম্পর্কের ভিত্তিমূল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি প্রতিপালক এবং স্রষ্টা, তিনিই ইবাদতের উপযুক্ত। বিশ্বজগতের সমস্ত ব্যবস্থাপনা

তার রুবুবিয়্যাত ও কুদরতের সাক্ষ্য বহন করে।

বিশ্বজগতের এই ব্যবস্থাপনা এবং তার কুদরতের দলিল-প্রমাণ নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে মানুষ দু-দলে বিভক্ত। মিথ্যাপ্রতিপন্নকারী ও সত্য সাব্যস্তকারী। মিথ্যাপ্রতিপন্নকারীদের ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম। আর সত্য সাব্যস্তকারীদের ঠিকানা জান্নাত। (৭)

মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণ হচ্ছে, মানুষের স্বভাবে ত্বরিতকর্মা প্রবণতা রয়েছে। কোনো কোনো সময় তারা নিজের ও নিজ সন্তানদের জন্যও শাস্তি ও ধ্বংসের বদদোয়া করে থাকে। (১১)

মিথ্যাপ্রতিপন্নকারীরা কোরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে এবং তাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতেও পিছপা হয় না। আল্লাহর নবীর সঙ্গে বিদ্রুপ করে তারা বলে, ‘আপনি অন্য কোনো কোরআন নিয়ে আসুন কিংবা তাতে কিছুটা পরিবর্তন করুন।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিয়েছেন, ‘এ দুটোর কোনোটিই করার অধিকার আমার নেই। আমি তো কেবল ওহীর অনুসরণ করে থাকি। তোমরা কি মনে করো-নাউজুবিল্লাহ- আমি নিজেই তা বানিয়ে আল্লাহর প্রতি সম্বন্ধযুক্ত করি? আমি তোমাদের মাঝে আমার জীবনের চল্লিশটি বছর কাটিয়ে দিয়েছি। তোমরা আমাকে কখনো মিথ্যা বলতে শোনোনি। কারও নিকট থেকে জ্ঞান অর্জন করতেও দেখোনি। যখন তোমরা আমাকে কখনো মিথ্যা বলতে শোনোনি, কারও থেকে জ্ঞান অর্জন করতেও দেখোনি তা হলে তোমরা এটা কীভাবে বলো যে, হঠাৎ করে আমি মিথ্যা বলা শুরু করে দিলাম! তোমাদের সামনে এমন মুজিজাময় কোরআন পেশ করলাম! আমি তো মানুষের সঙ্গে মিথ্যা বলি না; তা হলে আল্লাহ তায়ালার ব্যাপারে আমি কীভাবে মিথ্যা বলতে পারি?’

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবন এবং সত্যবাদী জবানের এ দিকটি শত্রুপক্ষও স্বীকার করতে বাধ্য ছিল। আবু সুফিয়ান যখন কাফের ছিলো তখন রোমের বাদশাহ হেরাক্লিয়াস তাকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, এই লোক কি নবুওয়াত দাবি করার পূর্বে মিথ্যা বলত? তাকে কি তোমরা কখনো মিথ্যা বলতে দেখেছিলে? কাফের ও মুশরিক হওয়া সত্ত্বেও আবু সুফিয়ান না-সূচক উত্তর দিতে বাধ্য হয়েছিল। হেরাক্লিয়াস তখন বলেছিলেন, ‘এটা কীভাবে হতে পারে যে, সে মানুষের সাথে মিথ্যা বলবে না; কিন্তু আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলবে!’

ইমাম রাজি রহ. বলেন, শৈশব থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর কোরআন অবতীর্ণ হওয়া পর্যন্ত তার জীবনপ্রবাহ মুশরিকরা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তারা নিজেরা দেখেছে। তারা জানত, তিনি কোনো কিতাব অধ্যয়ন করেননি। তিনি কারও শিষ্য ছিলেন না। এরপর চল্লিশ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি হঠাৎ এক মহা কিতাব নিয়ে তাদের নিকট আসেন, যা ইলমুল উসুল (মূলনীতি সংক্রান্ত বিদ্যা), ইলমুল আহকাম (বিধান সংক্রান্ত বিদ্যা) ও ইলমুল আখলাক (আচার-আচরণ ও আদব- শিষ্টাচার সংক্রান্ত বিদ্যা) এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও দুর্লভ বিষয়াদিতে ভরপুর, বড় বড় কবি-সাহিত্যিকরাও যার সাহিত্যের মোকাবেলায় অক্ষম বনে গেছে। যার সুস্থ বিবেক রয়েছে সে নিশ্চয় জানে যে, ওহী ছাড়া এমনটা কখনোই সম্ভব নয়।

মূর্তিপূজা ও একত্ববাদ

সামনের আয়াতগুলোতে মুশরিকদের মূর্তিপূজা এবং একত্ববাদের দলিল উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বড়ধরনের বিপদের সময় মুশরিকরাও মিথ্যা উপাস্যদের ভুলে গিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে খাঁটি মনে ডাকতে বাধ্য হয়। (২২)

এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হয়েছে, ‘আপনি তাদের জিজ্ঞেস করুন, আকাশ ও পৃথিবী থেকে তোমাদের কে রিজিক দেন? তোমাদের কান ও চোখের মালিক কে? মৃত থেকে জীবিত প্রাণী এবং জীবিত থেকে মৃত প্রাণী কে বের করেন? এবং কে যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন? তারা বলবে, আল্লাহ! আপনি জিজ্ঞেস করুন, তবু কি তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে না?’ (৩১)

কোরআনের সত্যতার চ্যালেঞ্জ

কোরআনের সত্যতার ব্যাপারে তাদের সাথে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোরআন যদি মানবরচিত হয়ে থাকে তা হলে তোমরাও এর মতো কোনো সূরা বানিয়ে দেখাও। এজন্য আরবদের মধ্য থেকে যাকে যাকে খুশি তার সহযোগিত নিতে পারো। আল্লাহ তায়ালা এরপর তাদের ঈমান না আনার কারণ নিজেই বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের স্বভাব হচ্ছে সে যে বিষয়ে জানে না এবং যার প্রকৃতি উপলব্ধি করতে পারে না সে তা সরাসরি অস্বীকার করে বসে।’

অশিরিকদের তাওহিদ, পুনরুত্থান এবং কোরআনের সত্যতা অস্বীকারের মূল কারণ হচ্ছে তাদের মূর্খতা ও অজ্ঞতা। এ সূরায় কোথাও ধমকের স্বরে, কোথাও কল্যাণকামিতার স্বরে এ তিনটি মৌলিক বিশ্বাসের ব্যাপারে হঠকারিতা ছেড়ে ঈমান আনার দাওয়াত দেওয়া হয়েছে।

কোরআনের উত্তম গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘হে লোকসকল— তোমাদের নিকট এমন জিনিস এসেছে, যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এক উপদেশ ও রুগ্ন হৃদয়ের আরোগ্য, মুমিনদের জন্য হেদায়েত ও রহমত। আপনি বলে দিন যে, এ কিতাব আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ও রহমতের মাধ্যমে অবতীর্ণ হয়েছে। এতে মানুষের আনন্দিত হওয়া উচিত। তাদের জমাকৃত ধনসম্পদের তুলনায় এটা বহুগুণ উত্তম।’ (৫৭, ৫৮)

শিক্ষা ও উপদেশগ্রহণের তিনটি ঘটনা

তাওহিদের দলিল-প্রমাণ, পুনরুত্থানের অনিবার্যতা, কোরআনুল কারিমের সত্যতা এবং মুশরিকদের ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করার পর শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণের জন্য তিনটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রথম ঘটনা

প্রথম ঘটনাটি শাইখুল আমবিয়া হযরত নুহ আলাইহিস সালামের। তার দাওয়াতি কাজের সময়কাল অন্যান্য নবীর চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু তার অনুসারীর সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম।

দ্বিতীয় ঘটনা

এরপর মুসা আলাইহিস সালাম ও হারুন আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, যারা প্রভুত্বের দাবিদার ফেরাউনের মোকাবেলা করেছিলেন।

তৃতীয় ঘটনা

তৃতীয় ঘটনা ইউনুস আলাইহিস সালামের। এ সুরাটি তার নামেই নামকরণ করা হয়েছে। কোরআনের চার জায়গায় ইউনুস আলাইহিস সালামের নাম স্পষ্টভাবে এসেছে। অন্য এক স্থানে তাকে যুননুন (মাছওয়ালা) বলে সম্বোধন করা হয়েছে। তিনি তার সম্প্রদায়ের ঈমান আনার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়েছিলেন। আল্লাহর আজাব আসা সুনিশ্চিত জেনে তিনি নিনাওয়া ভূখণ্ড ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।

যাওয়ার জন্য যখন তিনি জাহাজে উঠে বসেন তখন সমুদ্রে প্রচণ্ড ঝড় উঠলে জাহাজের অন্য যাত্রীরা তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে। একটি বড় মাছ তাকে গিলে ফেলে। আল্লাহ তাকে সেই মাছের পেটে বাঁচিয়ে রাখেন। কিছুদিন পর মাছ তাকে সাগরতীরে এক মরুভূমিতে উগরে ফেলে। ওইদিকে তার সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সকলেই মরুভূমিতে চলে আসে। তারা আহাজারি, তাওবা-ইসতিগফার শুরু করে। তারা খাঁটি মনে ঈমান আনে। আল্লাহ তাদের থেকে আজাব তুলে নেন।

এই তিনটি ঘটনা উল্লেখ করার পর মুশরিকদের সতর্ক করা হয়েছে যে, যদি তারা কুফর-শিরক থেকে বিরত না হয় তা হলে কেয়ামতের পূর্বেই তাদের উপর আজাব চলে আসতে পারে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুমিনদের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে। এটাই আমার রীতি যে, আমি পরিশেষে মুমিনদের মুক্তি দিয়ে থাকি।

কোরআনুল কারিমের আলোচনার মাধ্যমে যেমনিভাবে সূরা ইউনুসের সূচনা হয়েছিল তেমনি এই সত্য কিতাবের অনুসরণের নির্দেশের মাধ্যমে সুরাটি শেষ হয়েছে। বলা হয়েছে, আপনি বলে দিন, ‘হে মানবজাতি— তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে হক চলে এসেছে। যে-ব্যক্তি হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে সে নিজেই তার ফল ভোগ করবে। আর যে গোমরাহির পথ অবলম্বন করবে, সেই তার পরিণতি ভোগ করবে। আমি তোমাদের ব্যাপারে উকিল নই। হে নবী, আপনার নিকট যে কোরআন ওহী হিসেবে এসেছে, আপনি তার অনুসরণ করুন। আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা করা পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করুন। তিনি সর্বোত্তম ফয়সালাকারী।’

চলবে ইনশাআল্লাহ...

লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতীব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।

(ঢাকাটাইমস/২১মার্চ/এসআইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :