ছেলের খোঁজে ঢাকায় শেখ লুৎফর রহমান

ইমরুল ইউসুফ
| আপডেট : ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৬ | প্রকাশিত : ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৫৩

শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন রাজনীতি-সচেতন মানুষ তিনি সরাসরি রাজনীতির মাঠে ছিলেন না কিন্তু ছেলেকে রাজনীতিতে বাধা দেননি মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর নিখিল ভারত মুসলিম লীগ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল দলটি মুসলিম লীগ গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, আগা খান ও নওয়াব ভিকার উল-মূলুক ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের বিভাজন এবং পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ পাকিস্তান মুসলিম লীগ হয়ে ওঠে ওই বছর কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় চলে আসেন বাবার ইচ্ছায় ভর্তি হন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগে মুসলিম লীগ সরকারের গণবিরোধী ভূমিকার বিরোধিতা করে তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন ৪ঠা জানুয়ারি গঠন করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ

১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন ওই অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পালিত হয় ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষার সংগ্রামকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ফজলুল হক হলে ২রা মার্চ গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ই মার্চ পূর্ব বাংলার সর্বত্র সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে কিন্তু পূর্ব বাংলার সরকার বাংলা ভাষার আন্দোলনকে প্রচার করে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে সরকারি পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ করে ছাত্রদের মিছিল ও সমাবেশে এই আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সম্মুখসারির নেতা সাধারণ ধর্মঘট পালনকালে ওইদিন সচিবালয়ের সামনে থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়

শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন গ্রেফতার করা হয় তখন শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন গোপালগঞ্জে ছেলেকে গ্রেফতারের খবর শুনে তিনি খুবই বিচলিত হন এবং মুষড়ে পড়েন গ্রামের এক ছাত্রের মুখে শুনলেন খোকাকে তিন চার দিন পর জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হবে এই খবর শুনে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকায় যাবেন তখন পাটগাতি হয়ে লঞ্চ, স্টিমার ঢাকায় চলাচল করত তিনি খোকার ছাড়া পাওয়ার সংবাদ শুনে স্টিমারে চেপে বসলেন খোকার মা সায়েরা খাতুন, বড়োবোন ও সন্তানেরা শেখ লুৎফর রহমানকে বিদায় জানালেন

লুৎফর রহমান স্টিমারে বরিশাল হয়ে এলেন ঢাকার সদরঘাটে জায়গাটি তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অচেনা তিনি সদরঘাট থেকে হেঁটে পুরাতন ঢাকার নাজিমুদ্দীন রোডের জেলখানার সামনে এলেন তখন সকাল ১০টাও বাজেনি জেলগেটের সামনে সাধারণ কোনো লোকজন নেই আছে শুধু প্রহরী গেটে গিয়ে বললেন, আজ জেল থেকে রাজবন্দিদের মুক্তি পাওয়ার কথা আছে প্রহরী শেখ লুৎফর রহমানের বেশভূষা দেখে সমীহ করে বললেন, জেলে কি আপনার কোনো কয়েদি আছে?

লুৎফর রহমান বললেন, আছে, আমার ছেলে ছেলের সঙ্গে অনেক লোকজনও আছে দেশে বসে শুনেছি সরকার তাদের আজ ছেড়ে দেবে

প্রহরী বলল, আপনি কোথা থেকে এসেছেন? আপনার ছেলের নাম কী?

আমি ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ থেকে এসেছি আমার ছেলের নাম মুজিবুর রহমান পলিটিক্স করে

এবার বুঝলাম উনি রাজবন্দি ঠিক আছে আপনি সামনের ওই টুলটায় বসুন রাজবন্দিদের দুপুর দুইটার পরে ছাড়ে কোর্টের অর্ডার আসতে দেরি হয়

বেল দুইটার পরপর হবে জেলগেটে বেশ কয়েকটি গাড়ি এসে থামলো সব গাড়িতেই লোকজন ভরা তাঁরা লুৎফর রহমানের অচেনা তবে লুঙ্গিপরা আধাবয়সী একজনকে তাঁর চেনা চেনা লাগছে কোথায় যেন দেখেছে একটি গাড়িতে কয়েকটি গাঁদা ফুলের মালা লুৎফর রহমান ভাবলেন- আজ যাঁরা মুক্তি পাবে তাঁরা নিশ্চয় রাজবন্দি এবং সবার পরিচিত মানুষ তাই জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ফুলের মালা পরিয়ে দেওয়া হবে

শেখ লুৎফর রহমান আবার ভাবলেন- খোকা যদি আজ না ছাড়া পায়! তাহলে তো মনে কষ্ট নিয়ে বাড়িতে ফিরে যেতে হবে আবার কীভাবে সংবাদ পাবেন, কীভাবে আবার আসবেন- এসব ভাবতে ভাবতে জেলের বিরাট গেট খুলে গেল গেটের আশপাশে জেলপ্রহরী ও পুলিশের কমতি নেই শেখ লুৎফর রহমান গেটের কাছাকাছি গেলেন সামনে অনেক মানুষের ভিড় লুঙ্গিপরা সেই মানুষটিও অনেক মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন অনেকে বলাবলি করছেন, মানুষটি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী শেখ লুৎফর রহমান দেখলেন গেট দিয়ে মাত্র দুজন রাজবন্দি বের হয়েছে একজন তাঁর খোকা অন্যজন তাঁর অচেনা তিনি পরে জেনেছিলেন খোকার সঙ্গে মুক্তি পাওয়া ওই রাজবন্দির নাম বাহাউদ্দিন বাড়ি বরিশালে

শেখ লুৎফর রহমানের আদরের খোকা ও খোকার সঙ্গে থাকা মানুষটি গেটের বাইরে এলেন আসতেই গেটের সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলো ফুলের মালা নিয়ে ছুটে গেলেন তাঁদের কাছে দুজনের গলায় পরিয়ে দেওয়া হলো ফুলের মালা সবার কণ্ঠে স্লোগান খোকা একটু সামনে এগিয়েই দেখলেন- মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছেন দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর প্রাণপ্রিয় বাবা বাবাকে দেখে খোকা সঙ্গে সঙ্গে সালাম করলেন সালাম করলেন মওলানা ভাসানীকে খোকা ভিড়ের মধ্যে আরও দেখলেন- আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক দাঁড়িয়ে তিনি তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন আনন্দ প্রকাশ করলেন বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন- ‘জেলগেট থেকে বের হয়ে দেখি, আমার আব্বাও উপস্থিত তিনি আমাকে দেখবার জন্য বাড়ি থেকে এসেছেন আমি আব্বাকে সালাম করে ভাসানী সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁকেও সালাম করলাম সাথে সাথে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ, ছাত্রলীগ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উঠল জেলগেটে এই প্রথম ‘আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’ হলো শামসুল হক সাহেবকে কাছে পেয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানালাম এবং বললাম, “হক সাহেব, আপনার জয়, আজ জনগণের জয়” হক সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, “চল, এবার শুরু করা যাক” (পৃ. ১২১)

শেখ লুৎফর রহমান অবাক বিস্ময়ে এসব দেখছিলেন আর খোকার জনপ্রিয়তার কথা ভাবছিলেন খোকার নেতা হয়ে ওঠার কথা ভাবছিলেন পরে সবাই গাড়িতে উঠে বসলেন খোকার বাবাও চললেন তাঁদের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন- “আমি আব্বাকে বললাম, ‘আপনি বাড়ি যান, আমি সাত-আট দিনের মধ্যে আসছি’ আমার টাকার দরকার, বাড়ি না গেলে টাকা পাওয়া যাবে না বৃদ্ধ মা, আর স্ত্রী ও মেয়েটিকে দেখতে ইচ্ছা করছিল” (পৃ. ১২২-১২৩) ওই বইয়ে তিনি আরও লিখেছেন- ‘আমি কয়েকদিন বাড়িতে ছিলাম আব্বা খুবই দুঃখ পেয়েছেন আমি আইন পড়ব না শুনে বললেন, “যদি ঢাকায় না পড়তে চাও, তবে বিলাত যাও সেখান থেকে বার এট ল’ ডিগ্রি নিয়ে এস যদি দরকার হয় আমি জমি বিক্রি করে তোমাকে টাকা দিব” আমি বললাম, “এখন বিলাত গিয়ে কি হবে, অর্থ উপার্জন করতে আমি পারব না” আমার ভীষণ জেদ হয়েছে মুসলিম লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, এখন দেখি তার উল্টা হয়েছে এর একটা পরিবর্তন দরকার’ (পৃ. ১২৫-১২৬)

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন- বাঙালিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে তিনি পরিত্রাণের পথ অনুসন্ধান করতে থাকেন এ ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের অগ্রণী ভূমিকা উপলব্ধি করেন ১৯৭৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি গণভবনে খ্যাতিমান সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন- ‘সেই ১৯৪৭ সালে ... একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলা ভাষা আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে পরে এমন একদিন আসে যেদিন আমি আমার দলের লোকদের জিজ্ঞাসা করি, আমাদের দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে, পাক বাংলা কেউ বলে, পূর্ব বাংলা আমি বলি, না, বাংলাদেশ তারপর স্লোগান দিই জয় বাংলা ... জয় বাংলা বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছিলুম বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জয়, যা সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে’ (কালি ও কলম, জানুয়ারি ২০২০)

পূর্ব বাংলায় প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিল সীমিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা ভর্তি হতেন, তাঁদের সবাই সম্মান করতেন ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চের আন্দোলনের এক বছর পর বঙ্গবন্ধুর সামনে আরেকটি বড়ো উপলক্ষ্য আসে ১৯৪৯ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভুক্ত কর্মচারীরা বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘট ডাকে ওই ধর্মঘটের সমর্থন জানিয়ে ছাত্রলীগ তাঁদের পাশে দাঁড়ায় পরিশ্রম, সাংগঠনিক দক্ষতা, মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে বঙ্গবন্ধু তখন ছাত্রলীগের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন জানানোর কারণে ২৭ জন ছাত্রনেতা বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের রোষের শিকার হন বঙ্গবন্ধুকে ১৫ টাকা জরিমানা করা হয় এই টাকা দিতে তিনি অস্বীকৃতি জানান এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয় বলা হয়, দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে শাস্তি প্রত্যাহার করা হবে কিন্তু বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের পথ বেছে নেন উপাচার্য ড. মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসভবনের সামনে অবস্থান শুরু করেন নিম্নবেতনভোগী কর্মচারীদের পক্ষে উপাচার্য পুলিশ ডাকেন আন্দোলনকারীরা সরলেন না নির্ভীক শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পাঠানো হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্ড দিয়ে মুক্তির কথা বলা হলে তিনি অসম্মতি প্রকাশ করেন এই ঘটনা শুনেও বঙ্গবন্ধুর বাবা ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন বলেছিলেন, এজন্যই কি পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করেছিলাম!

১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ কারাবন্দি অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান এই সংগঠনের যুগ্ম-সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং জুন মাসের শেষের দিকে মুক্তিলাভ করেন

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :