মাদক থেকে মুক্তি: পরিবার ও রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা

নন্দিনী লুইজা
  প্রকাশিত : ২২ মে ২০২৪, ০৯:৪৪
অ- অ+

অনেক ত্যাগের বিনিময়ে এ দেশকে আমরা স্বাধীন করেছি। যদিও বলা হয় এ দেশের মানুষ মাটির মতোই উর্বর। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে যে- আমাদের তরুণ সমাজ আজ কোন এক অপশক্তির ছোবলে দিশেহারা। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ। তারা এতটাই বুদ্ধিমান এবং অনুকরণ প্রিয় যে তারা যা দেখে তাই করতে উৎসাহী হয়। উৎসুক হওয়া ভালো কিন্তু এর একটা মন্দ দিকও আছে। আমরা আজ আতঙ্কিত কারণ আমাদের যুব সমাজের অনেকেই এখন পথভ্রষ্ট। আমরা অভিভাবকবৃন্দ তাদেরকে বুঝি না অথবা তারা আমাদের বুঝতে পারে না। এই যে একটি বিপরীতধর্মী সংঘাত; এটা আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে।

আগের দিনে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারতাম একজন ভালো ছেলে ডাক্তার হবে, শিক্ষক হবে কিন্তু বর্তমানে কোনোক্রমেই এটা বলা যায় না এই যুবসমাজ কী করবে। আমরা অকপটে মেনে নিচ্ছি এসবের জন্য আমরা অভিভাবক, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই কমবেশি দায়ী। তাদেরকে ভালো মন্দের পার্থক্য আমরা বোঝাতে পারছি না। বাইরের চাকচিক্য আমাদের বুঁদ করে ফেলেছে। আমরা হীরা ফেলে কাঁচকেই হীরা বলে চালিয়ে দিচ্ছি। ভয়াল মরণ নেশা ও প্রযুক্তির অপব্যবহারের থাবা হায়নার মতো আমাদের দিকে ধেঁয়ে আসছে। আমরা বাঁচতে চাই, বাঁচাতে চাই আমাদের যুব সমাজকে।

আজই আমাদের সকলের থেকে আওয়াজ তুলতে হবে এবং সবাই মিলে সজাগ হতে হবে যদি আমরা এই সমস্যাকে ব্যক্তিগত সমস্যা না মনে করে সামাজিক সমস্যা বলে মনে করি। তাহলে আমরা আমাদের যুব সমাজকে বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবো বলে বিশ্বাস করি।

আমি এই লেখায় দুইটি বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। প্রথমে মাদকাসক্ত বিষয়ে বলতে চাই এবং পরে প্রযুক্তির খারাপ নেশা সম্পর্কে বলতে চাই। এই দেশের যদি কোনো পরিবারের কোনো সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে কিংবা মোবাইল ফোনের খারাপ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে সে ক্ষেত্রে আমরা যদি তা অনেক সময়ই লুকিয়ে ফেলি অথবা মিথ্যা বলি অথবা যে নেশাযুক্ত হয় তাকে তিরস্কার করি তাহলে তা একেবারেই ঠিক নয়। মাদকাসক্ত পরিবেশে যারা আছে তারা কোনো পাগল না, তারা একটি পরিস্থিতির স্বীকার মাত্র। তাদেরকে সঠিকভাবে বুঝাতে সক্ষম হলে কোনো এক সময় জীবনে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারবে এবং তাদেও মধ্যে অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরেও আসতে পারবে।

আমি মনে করি, আমরা ভালোবাসা দিয়ে সহজে একটি জাতীয় সমস্যা সমাধান করতে পারি। প্রত্যেক সন্তানের জন্য পরিবারটা হতে হবে নিরাপদ বাসস্থান। একমাত্র পরিবারই পারে তাদেরকে সঠিক সময়ে সঠিক পরিচর্যা দিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে তুলতে। আগামী প্রজন্ম যদি সঠিকভাবে মানুষ হয়ে ওঠতে সক্ষম হয় তাহলে তারা মাইলফলক হয়ে ওঠবে আগামীর বাংলাদেশের জন্য। আমরা নিজেরা যদি ঘরে ঘরে সচেতন হয়ে ওঠি তবে আপনা-আপনিই বন্ধ হয়ে যাবে মাদকের ব্যবহার, মাদক-ব্যবসা ও প্রযুক্তির অপব্যবহার। আমাদেরকে সেদিকে নজর দিতে হবে। যদি প্রতিটি পরিবারের অভিভাবক একটু আন্তরিক হয়, একটু সহনশীল হয় এবং সর্বোপরি ধৈর্যশীল হয় তবেই আমাদেও সমাজ ও রাষ্ট্রের যথাযথ মুক্তি ঘটতে পারে। আমরা তখন পেতে পারি একটি মাদকমুক্ত ও প্রযুক্তির কুফলমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

এবার একটু বর্তমান সময়ের প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহারের কথা আলাদাভাবে বলতে চাই। আমরা জানি, অনলাইন বা ডিজিটাল মাধ্যম যেমন অনেক কাজকে সহজ ও সাশ্রয়ী করে তুলেছে তেমনি আবার রয়েছে এর অনেক মারাত্মক বিড়ম্বনাও। অনলাইন প্রযুক্তি কেড়ে নিয়েছে বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের স্বর্ণালি অতীত ও শৈশব। ছেলেমেয়েদের সেই শৈশবের দুরন্তপনা এখন আর নেই। তারা এখন ক্রমশ প্রযুক্তির দেওয়ালে বন্দি হয়ে পড়ছে। যে বয়সে ছেলেমেয়েদের বাধাহীন জীবনযাপন করার কথা, খেলার মাঠে ছুটে বেড়ানোর কথা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠার কথা; সে বয়সেই ছেলেমেয়েরা অন্ধকার ঘরবন্দি থেকে স্মার্টফোনসহ প্রযুক্তির বিভিন্ন ডিভাইসের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা নেট নামক ডিজিটাল দুনিয়ায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে দিনরাত। তারা ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রামসহ নানা এ্যাপসভিত্তিক ওয়েবসাইটে পড়ে থাকছে দিনরাতের বেশিরভাগ সময়। যেখানে তারা ভালো সাইটের পাশাপাশি পর্নো সাইটেও সময় ব্যয় করছে। সন্দেহ নেই এটা তাদের অপরাধপ্রবণতার দিকে ধাবিত করছে। যার কুফলে তারা জড়িয়ে পড়ছে মোবাইলে বিভিন্ন ন্যুড দৃশ্যধারণ ও ধর্ষণের মতো মারাত্মক সামাজিক অপরাধে। এছাড়া মাদকসহ নানা সামাজিক অপকর্ম তো রয়েছেই। এটা কে না জানে যে- একটা অপরাধ আরেকটা অপরাধকে ডেকে নিয়ে আসে। কেননা, অপরাধবিজ্ঞানের মতে মানুষের মস্তিষ্কের গঠনটাই এমন যে- অপরাধ প্রবণতাগুলো একলা চলে না; তারা সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্য প্রবণতাগুলোকেও আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে। সমাজের এই ভয়াবহ নেতিবাচক দিক থেকে বের হয়ে আসার কোনো বিকল্প আছে কি?

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে এখনো এ ব্যবস্থার যথাযথ উপযোগী হয়নি। শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পাঠদানের নামে অবলীলায় স্মার্ট ফোন হাতে তুলে দেওয়ার কারণে তাদের মধ্যে প্রযুক্তির সহজলভ্যতা তৈরি হয়েছে বটে কিন্তু তার ভয়াবহতাও কম নয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে শিক্ষা অর্জনের চেয়ে গেমসের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার ফলে হয়তো শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই পড়াশোনা করতে পারছে, ব্যবসায়ীরা ব্যবসাবাণিজ্যে লাভজনক প্রক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারছে কিন্তু এর কুফল থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সতর্ক থাকতে হবে সবসময়। এখন ই-কমার্সের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পণ্যের বাজার সৃষ্টি হয়েছে, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের গতিকে ত্বরান্বিত করছে। ঘরে বসেই জিনিসপত্র কেনাকাটা করা যাচ্ছে, মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটাচ্ছে, ই-গভর্নেন্স চালুর মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের মধ্যে কাজের সমন্বয় ঘটানো সম্ভব হচ্ছে। সড়কপথ, রেলপথ, জলপথ এবং আকাশপথের যোগাযোগের ক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার যোগাযোগ ব্যবস্থাকে করেছে সহজতর, দ্রুত, নিরাপদ এবং আরামদায়ক। কিন্তু এতকিছুর পরও প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলোকে অস্বীকার করা যায় না কোনোভাবেই।

প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও অপব্যবহার তরুণ প্রজন্মকে দিন দিন বিপথগামিতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে- যা রূপ নিচ্ছে নিদারুণ ভয়াবহতায়। প্রযুক্তির আরও একটি ভয়াবহ দিক হলো অনলাইনে জুয়াখেলা। চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই অনলাইনের জুয়াখেলায় নিজেদের যুক্ত করে ফেলে। একটা সময় অনেক টাকা খোয়ানোর পরে বুঝতে পারে তারা একটা প্রতারণার মধ্যে পড়ে গিয়েছে। তখন দেখা যায় মুহূর্তের মধ্যেই তারা ফকিরে পরিণত হয়েছে।

প্রযুক্তি আসক্তিতে পড়ে অনেক ছেলেমেয়ে মাদকাসক্তও হয়ে পড়ছে, এ নিয়ে শিশু-কিশোরসহ বড়োদের মধ্যেও তৈরি হচ্ছে এক ধরনের হতাশা। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও অপব্যবহার তরুণ প্রজন্মকে দিন দিন এমন বিপথগামিতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে যে, যা রূপ নিচ্ছে নিদারুণ এক ভয়াবহতায়। শহরগুলোতে শিশুবান্ধব পরিবেশ, পর্যাপ্ত খেলার মাঠও তেমন একটা নেই, সেখানে ছেলেমেয়েরা একটু সময় কাটাবে, খেলবে। অস্বীকার করা যাবে না যে, পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও একটু খোলামেলা জায়গার অভাবের কারণেও প্রযুক্তি ও মাদকাসক্ত বিষয়ক নেতিবাচক দিকগুলো আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশগুলোর তুলনায় এখন খুব বেশি পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশ আজ ডিজিটাল পর্যায় থেকে চলে এসেছে স্মার্ট পর্যায়ে। আজ বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা থেকে শুরু করে সব স্তরের জনগণ জানে এবং বুঝে অনলাইন মাধ্যমটি কী এবং কীভাবে তার ব্যবহার করতে হয়? অনলাইনের মাধ্যমে কী কী কাজ এবং কী কী সমস্যার সমাধান করা যায় তাও তারা জানে।

প্রযুক্তির আগ্রাসনে এবং উদাসীনভাবে প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে অনেক ব্যক্তির গোপনীয়তাও প্রকাশ হয়ে পড়ছে- যা ব্যক্তি হয়তো নিজেও জানে না। প্রযুক্তির ব্যবহার সহজীকরণ না থাকলে হয়তো ব্যক্তির এমন নৈতিক স্খলন হতো না। তাই এখন প্রত্যাশা একটাই- বাবা-মাসহ সব শ্রেণির অভিভাবককে সতর্ক হতে হবে- বিশেষ করে প্রযুক্তির এমন অপব্যবহার থেকে ছেলেমেয়েদের দূরে রাখতে হবে সবসময়। তার জন্য সম্ভাব্য যাকিছুই প্রয়োজন সেটা করতে হবে দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে। আগামীর প্রজন্মকে রক্ষা করতে প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহারের দিকেই সকল সচেতন নাগরিককে মন ও মেধা বিনিয়োগ করতে হবে।

মনে রাখতে হবে- আমাদের ব্যর্থতা মানে সমাজের ব্যর্থতা। সমাজের ব্যর্থতা মানে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। সর্বোপরি আমি সবার হয়ে বলতে চাই, চিৎকার দিয়ে বলতে চাই আজকের এই নষ্ট সন্তানেরা মায়ের গর্ভ থেকেই নষ্ট হয়ে আসেনি। এটা আমার এবং আপনার অদূরদর্শিতা এবং কৃতকর্মের ফল। আমরা জানি না একটা সন্তান তার কী চাওয়া এবং কী পাওয়া থাকতে পারে। মূলত সে কী চায় সেটা অনুধাবন করে এবং তাকে সঠিক নির্দেশনা দিয়ে আমরা তাদেরকে কি বড়ো করে তুলতে পারি না। নিশ্চয়ই পারি। আমি মনে করি, এখনো সময় আছে। আমাদের সন্তানদেরকে সঠিক পথে আনতে এখনো সময় আছে। এ দেশের প্রতিটা সন্তান এক টুকরো মানিক রত্ন সন্দেহ নেই। এই রত্নদেরকে আমাদের সঠিক পরিচর্যায় লালন করতে হবে। আর সময় নষ্ট নয়। আসুন হাতে হাত মিলিয়ে মাঠে নেমে পড়ি-

সমাজ বাঁচাও, দেশ দেশ বাঁচাও, বাঁচাও বাংলার মুখ।

মাদকমুক্ত ও প্রযুক্তির খারাপ নেশামুক্ত হয়ে

ঘোচাই সমাজ-রাষ্ট্রের সকল দুঃখ।

নন্দিনী লুইজা: কবি, লেখক ও সমাজকর্মী

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
জো বাইডেন প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত, ছড়িয়ে পড়েছে হাড় পর্যন্ত
হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব গেছেন ৪৯ হাজার ৯০৪ বাংলাদেশি
যেসব লক্ষণে বুঝবেন প্রস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত, বাঁচার উপায়
ঢাকাসহ দেশের ১৮ অঞ্চলে ৬০ কিমি বেগে ঝড় হতে পারে, নদীবন্দরে সতর্কতা
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা