পোলট্রি ফিডের উচ্চমূল্যের নেপথ্যে যারা 

লিটন মাহমুদ, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ২৩ মে ২০২৪, ১২:৪৫ | প্রকাশিত : ২৩ মে ২০২৪, ০৯:১৬

দেশের পোলট্রি খাতে চলছে এক ধরনের অরাজকতা। কখনো এ খাতের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ায় ডিম ও মুরগির, কখনও আবার পোলট্রি ফিডের বা হাঁস-মুরগির খাবারের। খামারিরা বলেছেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে খাবার তৈরি করা বড় কোম্পানিগুলো নিজেদের পকেট ভারী করছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পোলট্রি ফিডে প্রতি কেজিতে অন্তত ২০ টাকা ও প্রতি বস্তায় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। এভাবে বছরে পোলট্রি ফিড থেকে কোম্পানিগুলো বাড়তি মুনাফা করছে অন্তত চার হাজার কোটি টাকা।

তথ্য বলছে, করপোরেট কোম্পানিগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ইতোমধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস শুরুর আগে দেশে এক লাখের মতো পোলট্রি খামার ছিল। গত চার বছরে সেটা কমে এখন ৭০/৭৫ হাজারে নেমে এসেছে।

ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে পোলট্রি ফিডের দাম বেড়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে পোলট্রি ফিড তৈরির উপকরণের দাম কমলেও স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত ফিডের দাম এখনও কমছে না।

জানা গেছে, ফিড বানানো কোম্পানিগুলো আগে শুধু হাঁস-মুরগির খাবার উৎপাদন করলেও বর্তমানে পোলট্রি ফার্মও আছে তাদের। ফলে বাজারে শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করতে পেরেছেন তারা।

পোলট্রি ফিডের উচ্চমূল্যের পেছনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও করপোরেট গ্রুপগুলোকে দায়ী করেন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার। তার দাবি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাহায্যে দেশের ছয়টি ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এই বাজার কারসাজির পেছনে কাজ করে। তিনি বলেন, নারিশ, প্যারাগণ, কাজী ফার্মস, আফতাব, প্রভিটা আবতাব বাংলাদেশ— এরা ফিডের প্রতিনিধিত্ব করে। এরা মিল্টন সমাদ্দারের (মানবিক কাজের নামে প্রতারণাকারী) চেয়ে ভয়ংকর। এর পেছনে কাজ করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে। এই অধিদপ্তরের সাহায্যে তারা ফিডের দাম বাড়াচ্ছে।

পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বলেন, ‘প্রতি ১০০ কেজি ফিড উৎপাদনে ৬০ শতাংশ কাঁচামাল ভূট্টা। আট মাস আগে প্রতি কেজি ভুট্টার দাম ছিল ৪০ টাকা। তবে কমতে কমতে ভুট্টার দাম বর্তমানে ২৭ টাকা। এছাড়া ফিড তৈরিতে ব্যবহৃত অন্যান্য কাঁচামালের দামও কমেছে। কিন্তু ফিডের দাম কমেনি। করপোরেট সিন্ডিকেট পোলট্রি ফিডে প্রতি কেজিতে ১৫-২০ টাকা বেশি নিচ্ছে। কিন্তু দেখার কেউ নাই। কারণ এতে আছে টাকার ক্ষণি।

সুমন হাওলাদার বলেন, ‘দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের যথেষ্ট মনোযোগ আছে। কিন্তু সরকার যাদের দায়িত্ব দেয় তারাই করপোরেটদের লোক হয়ে যায়। তো দায়িত্ব পালন করবে কে, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনবে কে, জবাবদিহি কে করবে। পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের এই নেতার তথ্য মতে, দেশে বছরে পোলট্রি খাদ্য উৎপাদন হয় ৮০ লাখ টন। ফিড মালিকরা এখন প্রতি টনে বাড়তি মুনাফা করছেন পাঁচ হাজার টাকা। সে হিসাবে বছরে তারা পোলট্রি ফিড থেকে বাড়তি মুনাফা করছেন চার হাজার কোটি টাকা।

সুমনের ভাষ্য, দেশের মানুষ যাতে কম দামে পোলট্রি পণ্য খেতে পারে এ জন্য সরকার পোলট্রি ফিডের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। পোলট্রি ফিডের কাঁচামাল আমদানিতে দেশের ফিড ব্যবসায়ীরা ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৭৮ কোটি টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯৭৮ কোটি টাকার শুল্ক ছাড় পেয়েছে। অথচ তারা পোলট্রি ফিডের দাম না কমিয়ে বাড়িয়েই চলেছেন।

পটুয়াখালীর খামারি ইলিয়াস খন্দকার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পোলট্রি খাদ্যের দাম নাগালের ভেতরে নাই। ধাপে ধাপে কোম্পানি খেয়ালখুশি মতো বাড়ায়। সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। কাঁচামালের দাম বাড়লে ফিডের দাম বেড়ে যায়, কিন্তু কাঁচামালের দাম কমলে ফিডের দাম আর কমে না। প্রতি বস্তা ফিডে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কোম্পানি লাভ করে। এ অবস্থায় খামারিরা দিনে দিনে নিঃশ হয়ে যাচ্ছে, খামার বন্ধ করে দিচ্ছে। পটুয়াখালীর এই খামারি বলেন, ‘করপোরেট গ্রুপগুলো পোলট্রি খাদ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এদের তদারকিতে যারা কাজ করবে যেমন: প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়, কৃষি অধিদপ্তর- তারা এগুলো সেভাবে তদারকি করে না।

নারিশ ফিডের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) এস এম এ হক ঢাকা টাইমসকে বলেন, কাঁচামালের দাম বাড়লে ফিডের দাম বাড়ে। কাঁচামালের দাম না বাড়লে ফিডের দাম আমরা বাড়াব কেন। এছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, ডলারের দাম, গরম, ভুট্টার দাম বৃদ্ধির কারণে ফিডের দাম বেড়েছে।

খামারিদের অভিযোগ বড় কোম্পানিগুলো কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে বেশি লাভের জন্য দাম বাড়ায়, আর কাঁচামালের দাম কমলেও ফিডের দাম কমে না। এ প্রসঙ্গে নারিশ ফিডের জিএম বলেন, ‘এটা বলা সহজ। দাম বাড়ালে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হয়। সেখানে কোনো ফর্মুলা খাটে না। আমরা চেষ্টা করি খামারি বাঁচাতে, তারা না বাঁচলে আমরা বাঁচব না। কোনো কোম্পানির খামারি মেরে ব্যবসা করা উচিত না, করেও না।

নারিশ ফিডের এই কর্মকর্তার ভাষ্য, ২০২১-২২ সালে ফিডের দাম অনেক বেশি বেড়েছে। কিন্তু ২০২৩-২৪ এ তেমন বাড়ে নাই। বর্তমান মূল্য থেকে দাম কমারও সুযোগ নেই।

এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (সম্প্রসারণ) ডা. মো. শাহিনুর আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘করোনার পরবর্তী বৈশ্বিক কারণসহ বিভিন্ন কারণে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও হাঁস-মুরগির খাদ্য-দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পায়। এই উত্তাপ এখনও আমাদের দেশে আছে। শুধু ফিডে না, সব পণ্যেই বাড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘পোলট্রি ফিডের দাম দুবছর আগেও যেটা ছিল তার থেকে অনেক দাম বেড়েছে। এটাতে আমাদের হাত নেই। তবে দামটা কীভাবে খামারিদের সহনীয় পর্যায়ে আনা যায়, সেটা নিয়ে আমাদের কাজ চলছে। একটু সময় লাগবে। আমরাও প্রতি মাসেই উপাদনকারীদের নিয়ে সভা করছি। এছাড়া কৃষি বিপণন আইন আছে, তারা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সঙ্গে কাজ করছে।’

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুভাষ চন্দ্র ঢাকা টাইমসকে বলেন, বর্তমানে বাজারে পোলট্রি খাবারের দাম সেটা কতটুকু যৌক্তিক সেটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট গবেষণা নেই, তথ্য নেই। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে এ নিয়ে মূল্য নির্ধারণ কমিটি আছে। আমি নিজেও সেই কমিটির সদস্য। কিন্তু এই কমিটির কাছে পোলট্রি খাদ্যে উৎপাদন খরচ বা যে দামে বিক্রি হচ্ছে সে সংক্রান্ত যৌক্তিক তথ্য নাই।

অধ্যাপক সুভাষ চন্দ্র বলেন, ২০০০ সালে দেশে ১ লাখ ৪৮ হাজার পোলট্রি খামারি ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালে তা অর্ধেকে নেমেছে। দেশে মেট্রোরেল হলো, পদ্ম সেতু হলো, এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ে হলো, কিন্তু পোলট্রি খামার কীভাবে অর্ধেক হলো? এই কমে আসার পেছনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সবার দায় আছে বলে মনে করেন তিনি।

এই পোলট্রিবিজ্ঞানী বলেন, ‘মূলত বড় খামারি ও ছোট খামারিদের অসম লড়াইয়ের কারণে পোলট্রি খাদ্যের দাম বেশি। অতীতে আফতাব বহুমুখী লিমিটেড কোম্পানি ছাড়া কেউই বাণিজ্যিকভাবে ডিম ও ব্রয়লার উৎপদন করত না। কিন্তু ২০১৫-১৬ সালের দিকে হঠাৎ করে পোলট্রি খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিক ডিম ও ব্রয়লার উপাদন শুরু করে। এতে করে ছোট খামার ও বড় খামারগুলোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়। আর এই লড়াইয়ে ক্ষুদ্র খামারিরা তুসের আগুনের মতো পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এটা আমার মনে কষ্ট দেয়। এটা সঠিক নয়, তাদের বাঁচিয়ে রাখা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব, মৌলিক দায়িত্ব।

(ঢাকাটাইমস/২৩মে/এলএম/ইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

ফাঁকা রাজধানীর নিরাপত্তায় তালিকভুক্ত চোর ধরছে পুলিশ

সংকটে চামড়া খাত, পর্যাপ্ত জোগানেও বন্ধ হচ্ছে না আমদানি

কোরবানির পশু জবাই ও মাংস বানানোর সরঞ্জাম তৈরিতে ব্যস্ত কারিগররা 

পল্টনে অগ্নিঝুঁকিতে ১৫টি ভবন, নেই কোনো ব্যবস্থা

নেতৃত্ব বাছাইয়ে ছাত্রদল সততা, মেধা ও পরিশ্রমের মূল্যায়ন করে: সাধারণ সম্পাদক

রি-টেন্ডার করিয়ে শতকোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নিতে চায় ‘মিঠু চক্র’

সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা উত্তম কুমার: বিলাসী বাসা ছেড়েছেন, গ্যারেজে পড়ে আছে গাড়ি

দালাল চক্রের আখড়া মিটফোর্ড হাসপাতাল

ঢাকায় ফ্ল্যাট-গাড়ি, অঢেল টাকা: সিআইডির সাবেক কর্মকর্তা উত্তমের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে

উচ্ছৃঙ্খল হিজড়াদের দমাতে ডিএমপির অল-আউট অ্যাকশন

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :