কোরবানির ইতিহাস, আমল ও বিধিনিষেধ
পবিত্র ঈদুল আজহা সমাগত। মুসলমানদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধর্মীয় উৎসব কোরবানির ঈদ। পবিত্র কোরআনে "কুরবান" শব্দ ব্যবহৃত হলেও ফারসী ও হিন্দি-উর্দুতে শব্দটিকে "কোরবানি" রুপ দেয়া হয়েছে। অর্থ, 'নৈকট্য'। অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধির ও পবিত্রতার প্রধান মাধ্যম হলো, কোরবান বা কোরবানি। কোরবানি বা কোরবান শব্দটি ‘কুরবুন’ মূলধাতু থেকে উদ্ভূত। যার বঙ্গানুবাদ সান্নিধ্যলাভ বা নৈকট্য অর্জন করা। অর্থাৎ বান্দা হিসেবে তার প্রিয়বস্তুকে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা।
আল্লাহতায়ালার কাছে জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব এই চারটি মাস বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। এসব মাসে যুদ্ধবিগ্রহ, কলহবিবাদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২, যা আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী সেদিন থেকে চালু আছে, যেদিন আল্লাহ তাআলা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাপূর্ণ। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান।’ (সুরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ৩৬)
জিলহজ মাসের ১০ তারিখে বিশ্বের মুসলমানরা তাদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব কোরবানির ঈদ উদযাপন করেন। এই উৎসবে পশু কোরবানি দেওয়া হয়, যার মধ্য দিয়ে নিজের ভেতরের কলুষতাকে বর্জন এবং সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভই ইসলামের শিক্ষা।
কোরবানি হল চিত্তশুদ্ধির এবং পবিত্রতার মাধ্যম। এটি সামাজিক রীতি হলেও আল্লাহর জন্যই এ রীতি প্রবর্তিত হয়েছে। কাফির- মুশরিকরা তাদের দেব-দেবী ও কবর-বেদীতে পুজো দেয় এবং মূর্তির সম্মানে পশু বলী দেয়। প্রতিবাদস্বরূপ সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হযরত ইব্রাহিম(আঃ)কে তাঁর উদ্দেশ্যে বা সমীপে 'ছালাত' আদায়ে কোরবান বা কোরবানি করার আদেশ দান করেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারেকাছে না আসে।’ (ইবনে মাজাহ)
আল্লাহ বলেন, আর কোরবানির পশু সমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে’ (হজ্জ ৩৬)।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যারা আল্লাহ ও পরকালের ভয় কর তাদের জন্যে ইব্রাহিম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (মুমতাহিনা ৪-৬)। কোরবানি কেবল পশু কোরবানি নয়। নিজের পশুত্ব, নিজের ক্ষুদ্রতা, নীচতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, দীনতা, আমিত্ব ও অহংকার ত্যাগের কোরবানি। নিজের ছালাত, কোরবানি, জীবন-মরণ ও বিষয়-আশয় সব কিছুই কেবল আল্লাহর নামে, শুধু তারই সন্তুষ্টির জন্য চূড়ান্তভাবে নিয়োগ ও ত্যাগের মানস এবং বাস্তবে সেসব আমল করাই হচ্ছে প্রকৃত কোরবানি।
কোরবানির ইতিহাস খুবই প্রাচীন। আদি পিতা আদম (আলাইহিস সালাম)-এর যুগ থেকেই কোরবানি বিধান চলে আসছে। আদম (আলাইহিস সালাম)-এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের কোরবানি পেশ করার কথা আমরা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন থেকে জানতে পারি। মহান আল্লাহ বলেন, আদমের দুই পুত্রের (হাবিল ও কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হল এবং অন্য জনের কোরবানি কবুল হল না। তাদের একজন বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন বলল, আল্লাহ তো সংযমীদের কোরবানিই কবুল করে থাকেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আদম (আ.)–এর পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত আপনি তাদের শোনান। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো আর অন্য জনেরটা কবুল হলো না। অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিনদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা-৫ মায়িদা, আয়াত: ২৭)
মহান আল্লাহ বলেন, আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির বিধান দিয়েছি; যাতে আমি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলির উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য। সুতরাং তোমরা তাঁরই নিকট আত্মসমর্পণ কর। আর সুসংবাদ দাও বিনীতগণকে; যাদের হৃদয় ভয়ে কম্পিত হয় আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে, যারা তাদের বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করে, নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রুজি দিয়েছি তা হতে ব্যয় করে।
কালক্রমে কোরবানি বিভিন্নরূপে প্রচলন চালু ছিল। ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম)-এর কোরবানির আদর্শ হওয়ার ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, অতঃপর সে (ইসমাঈল) যখন পিতা (ইবরাহিমের)র সাথে চলা-ফিরার (কাজ করার) বয়সে উপনীত হল, তখন ইবরাহিম তাকে বলল, ‘হে বেটা! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ।’ সে বলল, ‘আব্বা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলরূপে পাবেন।’ অনন্তর পিতা-পুত্র উভয়েই যখন আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহিম তাকে যবেহ করার জন্য অধোমুখে শায়িত করল, তখন আমি ডেকে বললাম, ‘হে ইবরাহিম! তুমি তো স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তার পরিবর্তে যবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু দিয়ে তাকে মুক্ত করে নিলাম। আর তার জন্য এ বিষয়টি পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম।
ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর হুকুমে পুত্র কোরবানি করেছিলেন। মূলতঃ তিনি এর দ্বারা পুত্রের মুহাব্বতকে কোরবানি করেছিলেন। আল্লাহর ভালোবাসার চাইতে যে পুত্রের ভালোবাসা বড় নয়, এটিই প্রমাণিত হয়েছে তার আচরণে। আল্লাহ এটাই চেয়েছিলেন। আর এটাই হল প্রকৃত তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি। ইব্রাহিম (আ.) তার প্রিয়পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করে এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যাতে অনাগত ভবিষ্যতের অগণিত মানুষ আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণের বাস্তব শিক্ষা লাভ করতে পারে।
জিলহজ মাস হজের মাস। জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ—এই ছয় দিনেই হজের মূল কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। কোরবানির স্মৃতিবাহী যিলহজ্জ মাসে হজ্জ উপলক্ষে সমগ্র পৃথিবী থেকে লাখ লাখ মুসলমান সমবেত হয় ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মৃতি বিজড়িত মক্কা-মদিনায়। তারা ইব্রাহিমী আদর্শে আদর্শবান হওয়ার জন্য জীবনের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেন। হজ্জ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক অনন্য উদাহরণ।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হজ সম্পাদন সুবিদিত মাসসমূহে। অতঃপর যে কেউ এই মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে তার জন্য হজের সময়ে অশালীন, অন্যায় আচরণ ও কলহবিবাদ বিধেয় নয়। তোমরা উত্তম কাজে যা কিছু করো, আল্লাহ তা জানেন এবং তোমরা পাথেয় ব্যবস্থা করবে, আত্মসংযমই শ্রেষ্ঠ পাথেয়। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা তোমরা আমাকে ভয় করো।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৯৭)
জিলহজের ১০, ১১ ও ১২ যেকোনো দিন কোনো ব্যক্তির মালিকানায় নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রুপা বা এর সমমূল্যের সম্পদ থাকলে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। পুরুষ ও নারী—সবার জন্য এ বিধান প্রযোজ্য। (ইবনে মাজাহ: ২২৬)
সাহাবারা বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! এ কোরবানি কী?’ তিনি বললেন, ‘তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ.)–এর সুন্নত।’ তাঁরা পুনরায় বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! তাতে আমাদের জন্য কী সওয়াব রয়েছে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি সওয়াব রয়েছে।’ তাঁরা আবার প্রশ্ন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! ভেড়ার লোমের কী হুকুম?’ তিনি বললেন, ‘ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি সওয়াব রয়েছে।’ (ইবনে মাজাহ: ২২৬) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত।
জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার পর থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত দিনে রোজা পালন করা, রাতে বেশি বেশি ইবাদত করা উত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, জিলহজের ১০ দিনের ইবাদত আল্লাহর কাছে অন্য দিনের ইবাদতের তুলনায় বেশি প্রিয়, প্রতিদিনের রোজা এক বছরের রোজার মতো আর প্রতি রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের মতো। (তিরমিজি, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা: ১৫৮)
আরাফাতের দিন, অর্থাৎ জিলহজের ৯ তারিখের নফল রোজা রাখা বিশেষ সুন্নত আমল। তবে আরাফাতে উপস্থিত হাজিদের জন্য এ রোজা প্রযোজ্য নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আরাফাতের দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী যে আল্লাহ তাআলা তার (রোজাদারের) বিগত এক বছরের ও সামনের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (তিরমিজি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ১৫৭)
জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তাকবির বলা ওয়াজিব। পুরুষেরা স্বাভাবিক স্বরে আর নারীরা নিম্ন স্বরে তাকবির বলবেন, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ (আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; আল্লাহ মহান, আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই; সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আল্লাহ মহান।)
জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার আগে প্রয়োজনীয় ক্ষৌরকর্ম করা, অর্থাৎ নখ কাটা, গোঁফ ছাঁটা, চুল কাটা, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি জরুরি। জিলহজের চাঁদ ওঠার পর থেকে ১০ তারিখে কোরবানির পশু জবাইয়ের আগপর্যন্ত কোনো প্রকার ক্ষৌরকর্ম না করা এবং কোরবানির পশু জবাইয়ের পর ওই দিনের মধ্যে ক্ষৌরকর্ম করা (অন্তত নখ কাটা)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা কোরবানি করবে, তারা যেন (এই ১০ দিন) চুল ও নখ না কাটে।’ (মুসলিম: ৫২৩৩, ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা: ২২৭) এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনি বলুন, (যদি আমার কোরবানির পশু কেনার সামর্থ্য না থাকে) কিন্তু আমার কাছে এমন উট বা বকরি থাকে, যার দুধ পান করা বা মাল বহন করার জন্য তা প্রতিপালন করি। আমি কি তা কোরবানি করতে পারি?’ তিনি বললেন, ‘না। বরং তুমি তোমার মাথার চুল, নখ, গোঁফ কেটে ফেলো এবং নাভির নিচের চুল পরিষ্কার করো। এ-ই আল্লাহর কাছে তোমার কোরবানি।’ (আবুদাউদ, নাসাই, ত্বহাবি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা: ৩০৫)
মানুষ আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবে, এই শিক্ষাই ইব্রাহিম (আ.) আমাদের জন্য রেখে গেছেন। মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) আমাদের জন্য ঐ ত্যাগের আনুষ্ঠানিক অনুসরণকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে গেছেন। আর ঈদুল আজহার মূল আহ্বান হল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করা। সকল দিক হতে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। সম্পদের মোহ, ভোগ-বিলাসের আকর্ষণ, সন্তানের স্নেহ, স্ত্রীর মুহাববত সবকিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রতি আত্মসমর্পণ করে দেওয়াই হল ঈদুল আজহার মূল শিক্ষা।
(ঢাকাটাইমস/১২ জুন/আরজেড)