আম নিয়ে কষ্টগাথা

আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ এসে উচ্ছ্বসিত ছিলাম। বিশাল বিশাল আম বাগানে ঘুরছি-ফিরছি, নানা জাতের সুমিষ্ট আম খাচ্ছি। আমের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ উপভোগ করার মজাই আলাদা। এর মধ্যেই যে আমচাষী আর বাগান মালিকদের রক্তক্ষরণ, কষ্ট কান্না শুনতে পাবো তাতো কল্পনাতেও ছিল না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ কানসাটের অদূরে শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সন্নিকটে উদ্যোক্তা ও গণমাধ্যমকর্মী আহসান হাবিবের আম বাগানে পৌঁছেই যেন চোখ কান খুলে গেল।
নিজের বহুমুখী আম বাগান প্রকল্পটি দেখানোর ফাঁকে ফাঁকেই আহসান হাবিব জানালেন কষ্টের কথাগুলো। বললেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৩৮ হাজার হেক্টর জুড়ে আম উৎপাদন হয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক লাখ আম চাষী। আম মৌসুমে জেলায় কর্মযজ্ঞে জড়িয়ে পড়ে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। প্রতি মৌসুমেই আম ঘিরে লেনদেন ঘটে ৫ হাজার কোটি টাকার। অথচ স্থানীয়ভাবে আম কেনার ক্ষেত্রে ফড়িয়া, ব্যাপারী, দালাল, আড়ত মালিক সিন্ডিকেট ৪০ কেজির স্থলে ৫২-৫৪ কেজিতে আমের মণ ধরে। এভাবে প্রকাশ্য চাঁদাবাজি প্রক্রিয়ায় প্রতি বছর হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে ৫০০ কোটি টাকা। এর একবিন্দু সুবিধাও ভোক্তারা পাচ্ছেন না। বছরের পর বছর ধরে এই যে বিশাল অংকের চাঁদাবাজি ঘটে চলছে তা বন্ধের ব্যাপারে কৃষি বিভাগ তথা সরকারের কোনোরকম উদ্যোগ নেই।
ধান চালের ক্ষেত্রেও বস্তার গায়ে নির্দিষ্ট করে ওজন, উৎপাদনের তারিখ ও জাত লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, আমের ক্ষেত্রে সেইটা কেন হচ্ছে না? চাষীরা বলেছেন, সারা দেশের সব আম বাজার ও আড়তে কাঁচা পণ্য হিসেবে ওজনে প্রতি মণে আমরা ৪/৫ কেজি আম বেশি দিতে রাজি আছি কিন্তু সেটাও সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন দেওয়া হোক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এখানকার কৃষি বিভাগ নয়- আড়ত মালিকরাই কৃষি অফিসের সহায়তায় দিয়ে থাকেন আইএসও ক্লিয়ারেন্স। প্রশিক্ষিত চাষীরা অতিরিক্ত খরচের মাধ্যমে যে উন্নতমানের আম চাষ করছেন সেগুলো কিনছে না রফতানিকারকরা। তারা বিভিন্ন আড়ত থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে নানা মিশেল দেওয়া ও গ্যাপ মেইনটেনেন্সের বাইরের আম কিনে বিদেশে রপ্তানি করে থাকে। এতে যেকোনো সময় নিম্নমানের আম চিহ্নিত হয়ে আম রফতানি বন্ধের আশঙ্কাও রয়েছে। অথচ সরকারের দায়ীত্বশীল মহলও অনেক বাগানকেই আদর্শ খামার হিসেবে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে থাকে। সচিব, কুটনীতিক, এমপি, মন্ত্রী সেখানেই বারবার যান পরিদর্শনে। এটা ওই বাগান মালিকের জন্য একক ব্যবসার পুঁজি হয়ে উঠেছে।
কৃষি বিভাগ আমচাষীদের জন্য নানা প্রকল্প নেওয়ার ঘোষণা দিলেও মাঠ চাষীরা নামকাওয়াস্তে মাত্র কয়েক বস্তা সার ছাড়া কিছু পান না বললেই চলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম সর্বপ্রথম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও ব্যান্ডিং, ট্যাগিং, মার্কেটিং ও প্রচারণা নিয়ে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। ৬-৭ বছর পার হলেও এর ট্রেডমার্ক ব্যবস্থা পর্যন্ত হয়নি। এমন সব কষ্ট লুকিয়ে রেখে আম চাষীরা প্রতি বছর উন্নত আম উৎপাদনের উদ্যোগ দেন, সে আম ছড়িয়ে দেন দেশ বিদেশে।
যেসব বাধা রয়েছে আম রপ্তানিতে:
চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতিবছর পাঁচ হাজার কোটি টাকার সাড়ে ৪ লক্ষ মেট্রিকটন আম উৎপাদন হয়। এ সময় কর্মযজ্ঞে জড়িত থাকে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ । চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্থনীতিতে জোরালো ভূমিকা রাখে আম। বাংলাদেশের আম অন্য যেকোনো দেশের আমের চেয়ে স্বুস্বাদু হলেও কার্গো খরচ বেশি হওয়ায় রফতানিতে টিকতে পারছে না। বাংলাদেশ ছাড়া যেকোনো দেশ বিমানে আম পাঠায় অর্ধেকেরও কম খরচে। আম রফতানিতে দেশে সরকারের নির্দ্দিষ্ট নীতিমালা না থাকা একটা বড়ো সমস্যা। অন্যদিকে কার্গো বিমানে ভাড়া বেশি ও বিমান লোডারদের স্মোথলি লোড না করার জন্য আম নষ্টের ঝুঁকি থাকে। আম রফতানিতে এসব সমস্যা বড়ো বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সুইডেন প্রবাসী ও আম আমদানীকারকের মতে, ভারত ও পাকিস্তান থেকে বিমানে সুইডেনে আম আসতে যে খরচ, বাংলাদেশ থেকে আসতে তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ভাড়া কার্গো বিমানে। পরিবহণ খরচ কমের কারণে ভারত-পাকিস্তানের সাথে পাল্লা দিয়ে পারা যায় না। অথচ বাংলাদেশি আমের স্বাদ ভিন্নতার কারণে যেকোনো দেশের চেয়ে ভালো ও চাহিদাও রয়েছে বেশি। ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব ও আম উদ্যোক্তা আহসান হাবিব জানান, আম রফতানিতে কার্গো ভাড়া কমানো, উৎপাদনকারীদের বিমার ব্যবস্থা করা জরুরি। রফতানিসহ আমের ন্যায্য দাম ও সরবরাহে সমস্যা না থাকলে সব ধরনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
চাঁপাইনবগঞ্জের আম রফতানিযোগ্য প্যাকিং নিশ্চিতকরণ, সহনীয়ভাবে সঙ্গনিরোধ সনদের ব্যবস্থা, ভ্যাপার হিট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের সুযোগ তৈরি করা, আধুনিক পদ্ধতিতে উৎপাদনের ক্ষেত্রে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান ও কৃষি বিমা প্রদানের ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবহণ বিমানে ভাড়ার হার সহনীয় না থাকা, আম রপ্তানির জন্য নীতিমালা না থাকা এবং ভ্যাপার ও হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট সুবিধা না থাকার কারণে আম রফতানিতে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ।
বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে বাজার অনুসন্ধান, বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আম মৌসুমে আম উৎপাদনকারী জেলাগুলো পরিদর্শন করার ব্যবস্থা, সরকারি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা প্রেরণের মাধ্যমে বাজার অনুসন্ধান, আম রফতানি করার জন্য প্যাকেজিং সামগ্রির ওপর ভর্তুকি প্রদান, বিদেশে সম্প্রসারণ করার জন্য সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। এসব সমস্যার সমাধান করা হলে আম রফতানির মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনার পাশাপাশি উৎপাদকরা নিশ্চিত ন্যায্যমূল্য পাবে।
সমস্যা সমাধানে করণীয়:
১. আম রপ্তানিতে পিছিয়ে থাকার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, আম উৎপাদনে কৃষির উত্তম চর্চার অভাব, রফতানিযোগ্য জাতের অপর্যাপ্ততা, নিরাপদ ও আন্তর্জাতিক গুণগত মানসম্পন্ন আমের জাত নির্বাচন, বাজার যাচাই ও সৃষ্টিতে সমন্বয়ের অভাব, প্রান্তিক কৃষকদের অবকাঠামোগত ও লজিস্টিক প্রাপ্তিতে সমস্যা, কার্গো বিমান ভাড়া বেশি, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি আমের ব্র্যান্ডিং ইমেজ সৃষ্টি না হওয়া, আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিংয়ের অভাব।
২. আমের বিকল্প পণ্য উৎপাদনে উন্নত প্রশিক্ষণ ও যান্ত্রিকীকরণে সহায়তা দেওয়া হলে কয়েক হাজার কর্মসংস্থান সুযোগের পাশাপাশি স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভুমিকা রাখা সম্ভব বলে মনে করছেন উৎপাদনকারী ও উদ্যোক্তারা।
৩. আমের মান ভালো রাখতে আমদানীকৃত আম ব্যাগের ট্যাক্স মওকুফ ও কৃষি বিমার আওতায় আমচাষীদের আনা দরকার।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক সময় ছিল আম গবেষণা কেন্দ্র। অনেক আগে থেকেই তা হয়ে যায় আঞ্চলিক উদ্যানত্বত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র। এতে করে আমকেন্দ্রিক যে গবেষণা তা বারীতেই সীমাবদ্ধ। দরকার একক আম গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার।
৪. খাওয়ার উপযোগী সময়ে গাছ থেকে সংগ্রহ, প্যাকেটজাত, পরিবহণ, উৎপাদন, সার ও সেচ ব্যবস্থা, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিবহণে লোড-আনলোড বিষয়ে উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা।
৫. আম বাগানীদের সোলার সেচ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হলে পরিবেশ রক্ষা হবে, উৎপাদন খরচ কমবে এবং ডলার সাশ্রয় হবে।সাঈদুর রহমান রিমন: সিনিয়র সাংবাদিক

মন্তব্য করুন