দুর্গত এলাকায় ত্রাণ সহায়তা জোরদার করা হোক

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন
  প্রকাশিত : ৩০ আগস্ট ২০২৪, ১৩:১২
অ- অ+

এটা খুবই আশার কথা যে- ধীরে ধীরে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতিও হচ্ছে। বন্যাদুর্গত এলাকার রাস্তাঘাটগুলো প্রায় জেগে ওঠছে। যদিও সেসব রাস্তা কোনো গাড়ি চলার উপযোগী হয়নি এখনো পর্যন্ত। আর রাস্তা সংস্কার না করে সেসব রাস্তায় গাড়ি চলাচল সম্ভবও নয়। কেননা, বন্যার তীব্র স্রোতের মুখে এসব রাস্তা এমনভাবে ভেঙেছে যে তা পুরোপুরি মেরামত করতে লেগে যাবে অনেকটা সময়। সর্বগ্রাসী বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের বাড়িঘর ও রাস্তাঘাটে বন্যার ভয়াল থাবা এমন ক্ষয়ক্ষতির স্বাক্ষর রেখে গেছে যে তা কাটিয়ে ওঠতে লেগে যাবে কয়েক বছর। পত্রপত্রিকায় দেখা যাচ্ছে এ পর্যন্ত বন্যাদুর্গত ১২ জেলায় মোট মানুষ মারা গেছে ৫২ জনের মতো। সরকারি ও বেসরকারি আশ্রয় শিবির থেকে মানুষজন তাদের বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে। অনেক মানুষ তাদের বাড়িতে ফিরে বাড়ির যে অবস্থা দেখতে পাচ্ছে তা অকল্পনীয়। অনেক বাড়িতে শুধু বাড়ির ভিটাটুকুই আছে কোনো ঘর নেই। বন্যার প্রবল তোড়ের মুখে তাদের ঘর ভেসে গিয়েছে। এমন অবস্থায় তারা এখন কোথায় থাকবে সে চিন্তায় একবোরেই অস্থির হয়ে ওঠছে। বাড়িতে গৃহপালিত গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি এসব তো অনেক আগেই হারিয়েছে অনেকে। এখন মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও অনেক হারিয়ে ফেলেছে। এর ওপর এখন পানি কমতে শুরু করায় দেখা দিয়েছে এখানকার মানুষের বিভিন্ন রোগব্যাধি। ডায়রিয়া, আমাশয়, চর্ম রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে এখানকার লোকজন। এদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে সরকারসহ দেশের সকল শ্রেণিপেশার মানুষের সমন্বিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়।

আমরা সকলেই জানি যে- সাগরে গভীর নিম্নচাপজনিত বৃষ্টিপাত, মৌসুমি ভারী বৃষ্টিপাত এবং ভারতের উজানের ঢলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে যে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছিল তাতে এখানকার ১২টি জেলার বিভিন্ন অঞ্চল বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল প্রায় ষাট লাখেরও বেশি মানুষ। হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে দ্রুত পানি বেড়ে যাওয়ার ফলে বন্যায় মানুষের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট সবকিছু তলিয়ে গিয়েছিল পানির নিচে। কোথাও কোথাও নদীসংলগ্ন এলাকায় এত বেশি স্রোত বয়ে গেছে যে ঘরবাড়ি সে স্রোতে অবলীলায় ভেসে যেতে দেখা গেছে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডম্বুরু ও গজলডোবা বাঁধ খুলে দেওয়ার দরুনই যে এই বন্যা ত্বরান্বিত হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে এই বাঁধ খুলে দেওয়ার বিষয় নিয়ে কঠোর সমালোচনাও করা হয়েছিল তখন। পানির অস্বাভাবিক চাপে গেট খুলে দেওয়ার যদি প্রয়োজনও হয় তাহলে তার আগে ভাটির দেশকে অন্তত অবহিত করা উচিত ছিল ভারত সরকারের, যাতে নিকটবর্তী দেশের অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভারত গেট খুলে দেওয়ার আগে বাংলাদেশকে কোনোভাবেই বিষয়টি অবহিত করেনি। এটা নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক রীতিনীতির সাধারণ নিয়মকে উপেক্ষা করেছে তারা। অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিবেশী দেশের প্রতি ভারতের এই ভূমিকা অর্থাৎ এই অসৌজন্যমূলক আচরণ কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। ইতোমধ্যে বিষয়টি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে।

কিছুটা পানি কমলেও এখনো বন্যার পানিতে ডুবে আছে কিছু কিছু এলাকা। বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে গেলে কীভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্য ও ঔষধসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিপত্রের জোগান দেওয়া সম্ভব, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে সবাইকে। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এই ভয়াবহ বন্যায় একদিকে মানুষের ঘরবাড়ি যেমন ডুবে গিয়েছিল, অন্যদিকে রাস্তাঘাটসহ খেতের ফসলও পানির নিচে কয়েকদিন থেকে তা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখন কোনোভাবেই সেসব ফসল আর ফিরে পাওয়া যাবে না। এছাড়াও এই বিশাল অঞ্চলের যত মাছ চাষের পুকুর ছিল তার সবই পানিতে ভেসে গেছে।

বন্যাদুর্গত অঞ্চলের বাঁধগুলো কোনো কাজে লাগেনি। এই সময়ে যদি বাঁধগুলোও কার্যকর থাকতো, তাহলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। আসলে বন্যার আগেই প্রয়োজন ছিল বাঁধগুলো বন্যা প্রতিরোধে সক্ষম কি না তা নিশ্চিত করার। প্রতি বর্ষার শুরুতেই কর্তৃপক্ষের দেশের সব অঞ্চলের সব বাঁধ পরীক্ষা করা প্রয়োজন। আর অতীত ইতিহাস বলে আগস্ট মাসে বন্যা হওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আর এই বন্যা শুধু একবার নয়- পরপর কয়েকবারও হতে পারে। ২০২৪-এর বর্ষাকালে দেখা গেছে সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারসহ কোনো কোনো অঞ্চল চারবারও বন্যাক্রান্ত হয়েছে।

এবারের নোয়াখালী, কুমিল্লা ও ফেনী অঞ্চলের বন্যা একেবারেই আকস্মিক। এখানে সাধারণত এত ভয়াবহ বন্যা কখনো হয় না। এ অঞ্চলের বয়স্ক মানুষরা বারবার এটাই বলছে যে- গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে আমাদের এই অঞ্চলে এ ধরনের বন্যা হয়নি। এত পানির স্রোত আমরা কখনো দেখিনি। আর এবারের এই অঞ্চলের বন্যায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বাঁধ ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে। তারা কেন অবিবেচকের মতো বাংলাদেশকে না জানিয়ে এই বাঁধ খুলে দিলো। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো- বাঁধগুলো খুলে দেওয়ার আগে ভারতের বাংলাদেশকে আগাম নোটিশ দেওয়া উচিত ছিল। এর আগে দিনাজপুরে এমন একটি ইতিবাচক পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল। সেখানে ভারত কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে বাঁধ খুলে দেওয়ার বিষয়ে দিনাজপুর জেলা প্রশাসককে আগে থেকেই জানিয়েছিল। কিন্তু এবার তারা এটা কেন করেনি তা বোধগম্য নয়।

আসলে পাশাপাশি দুটি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর ওপর একটি দেশ কখনোই ব্যারেজ নির্মাণ করতে পারে না। এটা হলো সবচেয়ে মৌলিক কথা। আলো, বাতাস ও পানি- এই তিনটি হলো প্রকৃতির অশেষ দান। এই তিনটি প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর কোনো দেশই কর্তৃত্ব ফলাতে পারে না। যখন পানি বাড়বে তখন সবদেশেই পরিস্থিতি অনুযায়ী বাড়বে। আবার যখন পানি কমবে তখন সব দেশেই একই পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে পানি কমবে। এটাই নিয়ম হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখে আসছি ভারত ফারাক্কা বাঁধসহ অনেকগুলো বাধঁ তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রয়োজন অনুযায়ী পানি বঞ্চিত করছে। আবার তাদের সুবিধা অনুযায়ী পানি বেশি হলে তা বাংলাদেশের দিকে ছেড়ে দিয়ে আকস্মিক বন্যার কারণ ঘটাচ্ছে।

বছরের পর বছর ধরে পাশাপাশি দুইটি বন্ধপ্রতীম দেশের মধ্যে এই স্বার্থহানীর বিষয়টি চলতে পারে না। বাংলাদেশের উচিত এই বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করা। তবে যেটাই হোক, বন্যার একমাত্র কারণ অবশ্য এই বাঁধ খুলে দেওয়াই না, অতিবৃষ্টিই মূল কারণ। এছাড়া আমাদের নিজেদের দুর্বলতাগুলোর দিকেও নজর দিতে হবে, যাতে আমাদের প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপগুলো যথাযথভাবে প্রস্তুত থাকে। আরো একটি কারণকেও আমরা উপেক্ষা করতে পারি না; সেটা হলো- বন্যার আগমন ঘটে এবং বন্যার ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয় আমাদের নদীগুলো নাব্য না থাকার কারণে। পলি জমতে জমতে প্রায় সকল নদীর তলদেশই ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষার ও উজানের ঢলের পানি নদী দিয়ে নামতে পারে না, তখন নদীর দুই পাড়ে থাকা জনবসতি ও ফসলি জমি ভাসিয়ে পানি সাগরে যায়। তাই নদীগুলো নাব্য করার উদ্যোগ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

আর আমরা এটা তো অস্বীকার করতে পারি না যে- ভারত বাঁধ খুলে পানি ছাড়ার আগেই বন্যাদুর্গত অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে মৌসুমি বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাগরে গভীর নিম্নচাপজনিত টানা বর্ষণ। বলার অপেক্ষা রাখে না- ফেনী এবং অন্যান্য অঞ্চলের বর্তমান প্রজন্ম এর আগে এমন একটিও বন্যা দেখেনি। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, এই বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনীর তিনটি উপজেলা। এগুলো হচ্ছে পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা। এসব উপজেলার রাস্তাঘাট, ফসলি জমি, মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। দেড় মাস আগেও বন্যায় এই জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। আমি মনে করি, বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে সাধারণ মানুষকে বন্যা সম্পর্কে সতর্ক করা এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার উপায় সম্পর্কে জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল সংশ্লিষ্টদের।

এখন এই অবস্থায় সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা বজায় রাখা। রাস্তাঘাটগুলো অবশ্য জেগে ওঠছে। গাড়ি না চললেও মানুষ হেঁটে তাদের গন্তব্যে যাতায়াত করতে শুরু করেছে। দুর্যোগের সময় মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল কোনো কোনো জায়গায়, এখন আস্তে আস্তে সেসব জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক পুনঃচালু হচ্ছে। বিদ্যুতের পুনঃসংযোগও স্থাপন করা হয়েছে অনেক বন্যাদুর্গত অঞ্চলে। দেখা গেছে, নিরবচ্ছিন্ন মোবাইল ফোনের নেওয়ার্ক না থাকার দরুন সাহায্যকারীদের ত্রাণতৎপরতাও চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে প্রথম থেকে।

এখন বন্যা পরিস্থিতির যেহেতু উন্নতি হচ্ছে তাই প্রয়োজন- বন্যাদুর্গতদের উদ্দেশ্যে ত্রাণ কার্যক্রমগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হওয়া। সেনাবাহিনী, বিজিবি এবং খণ্ড খণ্ডভাবে সাধারণ মানুষের বিভিন্ন দল এখন বন্যাদুর্গতদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে বটে তবে বিশাল বিপদগ্রস্ত মানুষের তুলনায় তা সামান্যই বলা যায়।

এটা পরম আশার কথা যে- বর্তমান বন্যা পরিস্থিতিতে সহায়তা করতে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ সাধ্যমতো এগিয়ে এসেছেন। খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা দিতে বন্যাদুর্গত এলাকায় সাধারণ মানুষের বিভিন্ন দল কাজ করে চলেছে- এটা অবশ্যই মানবিক দিক। ত্রাণ সহায়তাকারীরা মূলত প্রমাণ করছে মানুষ মানুষেরই জন্য। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা উদ্ধার অভিযানে সাধ্যমতো অংশ নিয়েছেন। এখন খাদ্যের পাশাপাশি প্রয়োজন ঔষধ সামগ্রী ও চিকিৎসা সেবা। কেননা, বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় মানুষের বিভিন্ন রোগব্যাধি দেখা দিচ্ছে। মেডিকেল টিমের সংখ্যা আরো বাড়ানো দরকার বলে আমি মনে করি। সকলের সম্মিলিত চেষ্টায় মানবিকভাবে বন্যাকে মোকাবিলা করা হোক।

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন: কলাম লেখক ও সাবেক কলেজ শিক্ষক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
গণতন্ত্রের সমাজভূমি নির্মিত হলেই শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে: তারেক রহমান
শেখ পরিবারের ৫ সদস্যের জমি-বাড়ি ক্রোক, রিসিভার নিয়োগের আদেশ
ধাওয়া খেয়ে পিছু হটল ভারতের চার যুদ্ধবিমান
নিজের ওপর চলা নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বিচার চাইলেন রাশেদ খান
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা