সেই ছাত্রলীগ এই ছাত্রলীগ
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার চার দিন আগে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ব্যবধান আড়াই মাসের কিছুটা বেশি সময়। ঠিক একই রকম অভিযোগে আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
জামায়াত ও শিবিরকে নিষিদ্ধ করে ১ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ চালানোর অভিযোগের কথা বলা হয়েছিল।
অন্যদিকে ২৩ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সংঘঠনটির বিরুদ্ধে কোটা সংস্কার ও সরকার পতন আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতা ’হত্যা’ ও অসংখ্য মানুষের ‘জীবন বিপন্ন’ করা এবং বিভিন্ন সময় ‘সন্ত্রাসী’ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ক্ষমতার পালাবদলের পর গত ২৮ আগস্ট জামায়াত ও শিবিরকে নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জামায়াত, ছাত্রশিবিরসহ এর অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাস-সহিংসতার সঙ্গে সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দলটির মতোই একেবারে ‘চুপসে’ গেছে ছাত্রলীগ। উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ ছাত্র সংগঠনটির শীর্ষ নেতারাসহ পদধারীরা হয় আত্মগোপনে, নয় পালিয়ে আছেন।
সেই ছাত্রলীগ এই ছাত্রলীগ
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পরের বছরের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অ্যাসেম্বলি হল থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নামে একটি ছাত্র সংগঠনের জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া ওই ছাত্র সংগঠন নানান ধাপ পেরিয়ে একাত্তরে স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামধারণ করে।
এরপর থেকে পাকিস্তানের শাসনামলে ছাত্র অধিকার আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলনসহ জাতির সংকটকালে রাজপথে বরাবরই নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিল ছাত্রলীগ। স্বাধীনতা যুদ্ধে ও দাবি আদায়ের সংগ্রামে সংগঠনটির বহু নেতাকর্মীর প্রাণ ঝরেছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সামরিক শাসনবিরোধী লড়াইয়ে সোচ্চার থাকা ছাত্রলীগের ভূমিকা বরাবরই ছিল প্রশংসনীয়। তবে এরশাদ পতনের আন্দোলন ঘিরে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর বদলে যাওয়া পরিস্থিতির মধ্যে নানা ঘটনায় সমালোচনায় পড়তে হয় সংগঠনটিকে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার পরবর্তী ১৫ বছর ধরে কমিটি বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা অনিয়মে ছাত্রলীগ অভযুক্ত হয়। এমন গুরুতর অভিযোগে ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থাকা সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে অপসারণ করা হয়।
২০১২ সালে ঢাকায় আলোচিত দর্জি দোকানের কর্মী বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ড, একই বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ হত্যাকাণ্ড, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সাজাও হয়েছে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কতিপয় নেতারা যেসব বক্তব্য রেখেছে, যারা নিজেদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে, তার জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট।
ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের পর বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ। সংগঠনটির নেতাকর্মীদের হামলায় সহিংস রূপ নেয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সশস্ত্র কর্মীদের কর্মকাণ্ডের ছবি সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়।
এ হামলার জন্য ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কদিনেই পরিস্থিতি পুরোপুরি সহিংস হয়ে পড়ে। হতাহতের সংখ্যা বেড়ে চলার মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
সরকারি চাকরিতে কোটা ইস্যু থেকে সৃষ্ট ওই আন্দোলন পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক দফায় রূপ নেয়। এক পর্যায়ে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার।
সরকার পতনের পর থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছিল। গত কয়েকদিন তাদের দাবি জোরালো হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই দাবিতে নানা কর্মসূচিও পালন করে আন্দোলন থেকে তৈরি ছাত্র সংগঠনটি।
সবশেষ মঙ্গলবার ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক বিক্ষোভ সমাবেশে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ও সংবিধান বাতিলের পাশাপাশি ছাত্রলীগ নিষিদ্ধসহ পাঁচটি দাবি তুলে ধরেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
এমন দাবির মুখে বুধবার (২৩ অক্টোবর) অন্তর্বর্তী সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার কথা জানায়। স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগের ’সন্ত্রাসী’ কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে।
এতে আরও বলা হয়, ‘স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুম কেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকান্ডে জড়িত ছিল এবং এতৎসম্পর্কিত প্রামাণ্য তথ্য দেশের সকল প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হইয়াছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হইয়াছে।’
(ঢাকাটাইমস/২৩অক্টোবর/ডিএম)
মন্তব্য করুন